বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর ২০২০
যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত ৩ নভেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠানের চারদিন পর জো বাইডেনকে ৪৬তম প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হয়েছে। সবগুলো রাজ্যের চূড়ান্ত ফলাফল এখনো পাওয়া যায়নি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার জন্য ইলেকটোরাল কলেজের ৫৩৮ ভোটের মধ্যে প্রয়োজন ২৭০টি ভোট। জো বাইডেন ইতোমধ্যেই ২৯০টি ভোট নিশ্চিত করেছেন। চূড়ান্ত ফলাফলে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৩০৬ এ। আমেরিকার ৮০ শতাংশ মানুষ মেনে নিয়েছেন নির্বাচনের এ ফলাফল। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ অভিনন্দিত করেছেন জো বাইডেনকে। ট্রাম্পের নিজ দলীয় সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং বেশ ক’জন সিনেটরসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দ অভিনন্দন জানিয়েছেন বাইডেনকে।
বিজয়ী প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিস আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ী ভাষণ দিয়ে জানিয়েছেন জাতীয় ঐক্যের আহবান বাইডেন। দলমত-জাতিধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নিজেকে সকলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। এবার হোয়াইট হাউজের ক্ষমতা হস্তান্তরের পালা। যুক্তরাষ্ট্রের ২৪০ বছরের প্রথা মাফিক আগামী বছরের ২০ জানুয়ারী আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করবেন বাইডেন। তার আগে বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিজের পরাজয় স্বীকার করে নতুন প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দিত করবেন। নতুন প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণ জানাবেন হোয়াইট হাউজে। এজন্য কোন বাধ্যবাধকতা না থাকলেও এটাই রীতি এবং এ দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের অনুসঙ্গ। এটাই স্বাভাবিক সৌজন্যবোধ, শিষ্ঠাচার মার্কিন রাজনীতির। ট্রাম্পের এই নজিরবিহীন গোয়ার্তুমিতে আমেরিকান হতাশ, হতবাক।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোন ধরনের সৌজন্য না দেখিয়ে উল্টো আদালতের পথে হাঁটছেন। অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন ক্ষমতা হস্তান্তরে। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন স্টেটের আদালতে ঠুকেছেন মামলা। তার এ আচরণে বিব্রত রিপাবলিকান অনেক নেতা। ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় কোন ধরনের সহযোগিতা না করে বায়বীয় ও মিথ্যা অভিযোগ করছেন নির্বাচনে ভোট চুরি ও জালিয়াতির। এদিকে নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে যে দেশের প্রতিটি স্টেটের নির্বাচন পরিচালনা কর্তৃপক্ষ কোথাও অনিয়মের কোন প্রমাণ পায়নি। এদিকে জো বাইডেনও আইনি ব্যবস্থার কথা ভাবছেন। তাগিদ দিয়েছেন জেনারেল সার্ভিস এডমিনিষ্ট্রেশনকে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল এই প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করে থাকে।
নির্বাচনে অনিয়ম, প্রতারণা বা ত্রুটির প্রমাণ মিলেনি
এদিকে ডেমোক্রেট ও বিপাবলিকান নির্বিশেষে প্রতিটি ষ্টেটের নির্বাচন কর্মকর্তারা বলেছেন যে তারা ভোট প্রদানে কোন অনিয়ম, প্রতারণা বা ত্রুটির প্রমাণ পাননি। ফিলাডেলফিয়ার রিপাবলিকান সিটি কমিশনার আল-শিমিডট গত বুধবার বলেছেন যে তিনি মেইলে আসা ভোট ও প্রভিশনাল ব্যালট গণনায় কোন অনিয়ম দেখতে পাননি। তিনি সামাজিক মাধ্যমে ভোট গণনার অনিয়মের অভিযোগকে হাস্যকর বলে বর্ণনা করেন। ভোট প্রতারণা হয়েছে এবং ভোটের ফলাফল চুরি করা হয়েছে মর্মে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবীকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, তিনি নামে মাত্র একজন রিপাবলিকান। তিনি সিএনএনকে বলেন, আমি মনে করি জনগণ এই নির্বাচনের ব্যাপারে অত্যন্ত আনন্দিত। যে অভিযোগের কোন সত্যতা নেই সেটিকে কেন্দ্র করে কারো কতক্ষণ অটল থাকা সম্ভব। মৃত ব্যক্তিও ভোট দিয়েছে মর্মে অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি ভোটার তালিকায় মৃতদের নাম চিহ্নিত করে বলেন, লোকগুলো মারা যাওয়ার পর তাদের একজনও ফিলাডেলফিয়ার কোন নির্বাচনে ভোট দেয়নি।
নিউইয়র্ক টাইমসের পক্ষ থেকে ৪৫টি ষ্টেটের নির্বাচন কর্মকর্তাদের সাথে যোগায়োগ করার পর তারা প্রায় একই সুরে বলেছেন ভয়াবহ মহামারীর জটিলতার মধ্যেও রেকর্ড পরিমাণ ভোটারের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ এক নজীরবিহীন সাফল্য। ওহাইয়োর একজন রিপাবলিকান সেক্রেটারী অফ স্টেট ফ্র্যাঙ্ক লারোজ বলেছেন, নির্বাচনের ব্যাপারে যা সত্য নয় তা উদ্ভাবনের সামর্থও কোন মানুষের জন্য বিরাট ব্যাপার। তিনি নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এ ধরনের অভিযোগ রূপকথার কাহিনীর মতো।
মিনেসোটার এক ডেমোক্রেটিক নেতা বলেছেন, নির্বাচনে কোন অনিয়ম ঘটেনি এবং গণণায় কোন প্রতারণার সুযোগ নেই। কোন কোন ষ্টেটে নির্বাচন কর্মকর্তারা ছোটখাট ত্রুটির কথা বলেছেন, যা প্রতিটি নির্বাচনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেগুলো মূলত ডাবল ভোটিং বা যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত। মিশিগানের ডেমোক্রেটিক সেক্রেটারী অফ স্টেট হোসেলিন বেনসন বলেছেন, আমরা নির্বাচনে কোন অনিয়ম বা গণনায় কারচুপির ঘটনা দেখিনি বা স্থানীয়ভাবে কোন অভিযোগ পাইনি। অত্যন্ত সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে ভোটগ্রহন সম্পন্ন হয়েছে।
নির্বাচনের ফল নিয়ে আইনি লড়াই
ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের জয় এখনো মেনে নেননি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। উল্টো তিনি আইনি লড়াই শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার। কোনো প্রমাণ ছাড়াই এই অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পর পদত্যাগ করেছেন বিচার বিভাগের ঊর্ধ্বতন আইনজীবী রিচার্ড পিলজার। ভোট জালিয়াতি সংক্রান্ত অভিযোগ তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এদিকে পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যে আনুষ্ঠানিক ফলাফল প্রকাশের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়েছে ট্রাম্পের প্রচারণা টিম। অন্যদিকে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের টালবাহানা বন্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে বাইডেনের প্রচারণা টিমও।
কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নির্বাচনে জো বাইডেন নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু এই নির্বাচনের ফল মানতে নারাজ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে ফল জালিয়াতির অভিযোগ তুলে আইনি লড়াই শুরু করেছেন। গত ৯ নভেম্বর হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র কেইলি ম্যাকএনানি এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, নির্বাচন এখনো শেষ হয়নি। আইনি লড়াই মাত্র শুরু হয়েছে। তিনি নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুললেও এর সমর্থনে কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি। তার দাবি, পেনসিলভেনিয়ার ফিলাডেলফিয়াতে রিপাবলিকান পর্যবেক্ষকদের কেন্দ্রে পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি বরং কর্মকর্তারা ডেমোক্র্যাট ভোটারদেরকে তাদের ভুলভাল ব্যালট ঠিক করে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। অবশ্য ভোট কার্যক্রমের প্রত্যক্ষদর্শী সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, কেন্দ্রে সব দলের পর্যবেক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। করোনার কারণে ভোট গণনার টেবিলের ১৩ থেকে ১০০ ফুট দূরে ছিলেন তারা।
পদত্যাগ করলেন বিচার বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তা : প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার। আইনজীবীদের এই নির্দেশ দেওয়ার পর পদত্যাগ করেছেন বিচার বিভাগের ঊর্ধ্বতন আইনজীবী রিচার্ড পিলজার। সাধারণত এই ধরণের তদন্ত তদারকির দায়িত্ব ছিলো তার।
পেন্টাগনের এক শীর্ষ কর্মকর্তার পদত্যাগ : মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগনের নীতি-বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা জেমস অ্যান্ডারসন পদত্যাগ করেছেন। গত ১০ নভেম্বর পদত্যাগ করেন অ্যান্ডারসন। দেশটির প্রতিরক্ষা দপ্তরের দুজন কর্মকর্তা এই তথ্য জানিয়েছেন। সিএনএন এক প্রতিবেদনে এ কথা জানায়। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে মার্ক এসপারকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বরখাস্ত করার পরদিনই অ্যান্ডারসন পদত্যাগ করলেন।
রিপাবলিকান নেতারা ট্রাম্পের পাশে : আইনি লড়াইয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর অনেক রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সিনেটে রিপাবলিকান পার্টির নেতা মিচ ম্যাককনেল। তিনি বলেছেন, আইন অনুযায়ী ভোট জালিয়াতির যেকোনো অভিযোগ তদন্তের দাবি তোলার শতভাগ অধিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রয়েছে। সংবিধানের আলোকে ধনী সংবাদমাধ্যমগুলোর এই প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। এদিকে রিপাবলিকান রাজ্যগুলোর সরকারের পক্ষ থেকে ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছে।
আইনি ব্যবস্থা নেবে বাইডেন শিবিরও : জো বাইডেনের যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে আগামী ২০ জানুয়ারি শপথ নেওয়ার কথা। এর আগেই বিদায়ী ও নতুন প্রশাসনের মধ্যে দায়িত্ব হস্তান্তরের কাজটি সেরে নিতে হয়। তবে ট্রাম্প এখনো হার মেনে না নেওয়ায় সেই কাজ শুরু হয়নি। বাইডেনের প্রচারণা টিমের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে এখন আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছেন তারা। দুই প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়ের কাজটি করে থাকে জেনারেল সার্ভিসেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিএসএ)। রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, জিএসএ কখন সরকার বদলের এ প্রক্রিয়া শুরু করবে সে ব্যাপারে আইনে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। তবে বাইডেন শিবির বলছে, তাদের বিজয় পরিষ্কার। ফলে এখানে বিলম্ব বা কালক্ষেপণ করার কোনো সুযোগ নেই।
বাইডেনের জয় ও ট্রাম্পের কারচুপির অভিযোগে বিভক্ত রিপাবলিকানরা
ডেমোক্রেটিক পার্টি জো বাইডেনের জয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দলে বিভক্তির সৃষ্টি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন, এই নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে। যদিও তিনি কোনো তথ্যপ্রমাণ দেননি। নির্বাচন কমিশনের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, কোনোরকম ভোট জালিয়াতির তথ্য প্রমাণ নেই। প্রায় ৭০ ভাগ রিপাবলিকান বাইডেনের জয়কে সমর্থন করছেন। মাত্র ৩০ শতাংশ বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই আবার জয়ী হয়েছেন। বাইডেনের জয়ে রিপাবলিকান দলের সভানেত্রী রনা ম্যাকড্যানিয়েল টুইট করেছেন, নির্বাচনে কে জিতবে সে সিদ্ধান্ত মিডিয়ার নয়, সে সিদ্ধান্ত ভোটারদের। তিনি আরো বলেছেন, অনিয়ম ও জালিয়াতির তদন্ত করতে সময় লাগবে। মিসৌরির রিপাবলিকান সিনেটর জশ হলিও টুইটারে ম্যাকড্যানিয়েলের মতো একই দাবি করেছেন। রিপাবলিকান সিনেটর রয় ব্ল্যান্ট দাবি করেন, আমি মনে করি না যে, বেসরকারি এই ফলাফল গ্রহণ করা বাইডেনের জন্য অযৌক্তিক। তবে ট্রাম্পকে আদালতে গিয়ে তথ্যপ্রমাণ দিলে তাতে কোনো সমস্যা দেখি না। সিনেট বিচার বিভাগীয় কমিটির চেয়ারম্যান লিন্ডসে গ্রাহাম জানান, বিভিন্ন রাজ্যে মামলা চালাতে তিনি ট্রাম্পকে ৫ লাখ ডলার দেবেন। এছাড়া ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারণা কমিটি এরই মধ্যে ৬০ মিলিয়ন ডলার তুলেছে যা দিয়ে তারা মামলা পরিচালনা করবেন।
তবে ট্রাম্পের সমালোচক রিপাবলিকান সিনেটর মিট রমনি সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও সদ্য নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে অভিনন্দন জানিয়ে টুইট করেছেন। তিনি লিখেছেন, তিনি ও তার স্ত্রী মনে করেন তারা সজ্জন মানুষ এবং তাদের সদিচ্ছা রয়েছে।
Posted ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh