বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২১
ক্যাপিটল হিলে গত ৬ জানুয়ারি সশস্ত্র হামলার এক সপ্তাহ পর বিদ্রোহ উস্কে দেয়ার অভিযোগে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিশংসিত করেছে হাউজ। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পই একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি দু’বার অভিশংসনের সম্মুখীন হলেন। হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে প্রথম অভিশংসন বা ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব এনেছিলো ক্ষমতার অপব্যবহার ও কংগ্রেসের কাজে পদে পদে বাধা সৃষ্টির জন্য। এবার দ্বিতীয় ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব আনা হয়েছে বিদ্রোহ ও দাঙ্গায় উস্কানি দেয়ার কারণে।
গত ১৩ জানুয়ারি বুধবার হাউজে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির মেয়ে লিজ চেনিসহ ১০ জন রিপাবলিকান নেতা ভোট দেন ডেমোক্র্যাটদের আনা এই প্রস্তাবে। ৪৩৫ সদস্যের প্রতিনিধি পরিষদে প্রস্তাবটি ২৩২-১৯৭ ভোটে পাস হয়। ভোট দানে বিরত থাকেন ৪জন। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রদ্রোহ, ঘুষ নেওয়া কিংবা অপরাধমূলক কোনো কাজে জড়িত হলে তাকে সরানোর অস্ত্র এই অভিশংসন।
এর আগে দু’জন প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ করা হয়েছিল। তারা হচ্ছেন ১৯৬৮ সালে এন্ড্রু জনসন এবং ১৯৯৮ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। ১৯৭৪ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট৫ প্রস্তাব আনার আগেই তিনি পদত্যাগ করেন। কিন্তু কোন প্রেসিডেন্টর বিরুদ্ধে দু’বার ইমপিচমেন্ট আনা হয়নি। ক্ষমতাসীন কোন প্রেসিডেন্টকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তিও দেওয়া হয়নি। কিন্তু ট্রাম্প প্রথম প্রেসিডেন্ট হতে পারেন, যাকে ক্যাপিটল হিলে হামলার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হতে পারে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ইমপিচমেন্ট প্রস্তাবের বৈশিষ্ট হচ্ছে গত ৬ জানুয়ারী ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্পের প্রত্যক্ষ উস্কানিতে তার সমর্থকদের দ্বারা ক্যাপিটল হিলে প্রবেশসহ তান্ডব সৃষ্টিতে ক্ষুব্ধ রিপাবলিকান পার্টির দশজন কংগ্রেসম্যান ইমপিচমেন্ট প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। গত ১৩ জানুয়ারি বুধবার যখন হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভে ইমপিচমেন্ট প্রস্তাবের উপর যখন উত্তপ্ত আলোচনা চলছিল তখন জনগণের প্রতিনিধিদের এই স্থানটি যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ নিয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অব্যাহত হামলার হুমকির মধ্যে ন্যাশনাল গার্ডের অসংখ্য সদস্যের কড়া প্রহরাধীনে হাউজের ইমপিচমেন্ট অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ আগে হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ ৬ জানুয়ারির ঘটনার জন্য ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে পদ থেকে হটানোর দৃঢ় সংকল্প নিয়ে ইমপিচমেন্টের পক্ষে জোরালো বক্তব্য প্রদান করেন।
গত ৬ জানুয়ারি ট্রাম্প সমর্থকরা যখন ক্যাপিটল হিলে হামলা চালায় তখন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটের সার্টিফিকেশনের উপর আলোচনা চলছিল। হামলায় অধিবেশন বন্ধ হয়ে যায় এবং কংগ্রেসম্যানরা নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইকেল পেন্স ও হাউজ স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিকে কড়া নিরাপত্তাধীন ভিন্ন পথে নিরাপদে ক্যাপিটল হিল থেকে বের করে নেয়া হয়। আমেরিকার ইতিহাসে সংঘটিত নজীরবিহীন এ ঘটনার পরও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোনরূপ দু:খ প্রকাশ না করে ডেমোক্রেটদের বিরুদ্ধে গত নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ করা অব্যাহত রেখেছেন, যদি বিভিন্ন স্টেটের আদালত তার পক্ষ থেকে দায়ের করা ভোট কারচুপির মামলাগুলো খারিজ করে দিয়েছে। এদিকে ফেডারেল এজেন্সিগুলো আগামী ২০ জানুয়ারী জো বাইডেনের শপথ গ্রহণের দিন পর্যন্ত ট্রাম্প সমর্থকদের দ্বারা দেশব্যাপী যে হাঙ্গামা ও নাশকতার আশঙ্কা করছে তার প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দেয়া এক বিবৃতি রিপাবলিকান হাউজ মেম্বাররা হাউজে পাঠ করেন। কিন্তু প্রথম ইমপিচমেন্টে রিপাবলিকানরা জোটবদ্ধভাবে ট্রাম্পের সমর্থনে দাঁড়ালেও দ্বিতীয় ইমপিচমেন্টে তার জোট ভেঙে যাওয়ার সকল লক্ষণ সুস্পষ্ট এবং অনেক রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান কোন রাখঢাক না করেই তার বিরুদ্ধে কথা বলছেন।
স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি হাউজ মেম্বারদের অনুরোধ জানিয়েছেন উদ্ভুত পরিস্থিতির নিস্পত্তি সাংবিধানিকভাবে করার জন্য, যাতে মহান আমেরিকান রাষ্ট্র এহেন একজন ব্যক্তির কবল থেকে থেকে নিরাপদে থাকে, যিনি রাষ্ট্রের মূল সত্তাকে পর্যন্ত তছনছ করে দিতে সচেষ্ট। তিনি বলেন, “তাকে অবশ্যই যেতে হবে। যে জাতিকে আমরা ভালোবাসি সেই জাতির জন্য তিনি মূর্তমান বিপদ। একথা বলে আমি আনন্দ উপভোগ করছি না, বরং একথা বলতে আমার হৃদয় ভেঙ্গে যাচ্ছে।”
রিপাবলিকান হাউজ মেম্বার ও হাউজ রিপাবলিকান লিডার ক্যালিফোর্নিয়ার কেভিন ম্যাকার্থি অবশ্য ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তার মতে এর ফলে জাতির বিভক্তি আরো বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু ৬ জানুয়ারীর ঘটনার জন্য তিনি ট্রাম্পকে দোষারূপ করতে ছাড়েননি। তিনি ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব আনার পরিবর্তে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং প্রেসডেন্টের প্রতিও আহবান জানান ক্যাপিটল হিলের ওপর হামলার দায় স্বীকার করার জন্য।
তাহলে কি মেয়াদ ফুরোনোর আগেই ট্রাম্পকে বিদায় নিতেই হচ্ছে? সেই প্রশ্নের উত্তর এখনই মিলছে না। হাউজে পাস হওয়া এই প্রস্তাব যাবে এখন কংগ্রেসের উচ্চ কক্ষ সিনেট শুনানিতে। ১০০ সদস্যের সিনেট এখন ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান সমান সমান। সেখানে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য সম্মতি দিলে তবেই ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়তে বাধ্য হবেন। সিনেটে ৫০ জন ডেমোক্র্যাটের সাথে কমপক্ষে ১৭ জন রিপাবলিকান সিনেটার যোগ দিলেই তা সম্ভব হবে।
তবে আর সেই প্রক্রিয়া সারতে যদি ২০ জানুয়ারি পেরিয়ে যায়, তবে এবার কিছু না হলেও ভবিষ্যতে আর কখনও প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না ট্রাম্প। হাউজে ১৩ জানুয়ারি বুধবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসন প্রস্তাবে ভোটগ্রহণ হয়। এক মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের পর এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে হারেন এই ধনকুবের। ২০ জানুয়ারি নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবেন বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে ২০২০ সালে একবার প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিত হয়েছিলেন। তবে সে দফায় সিনেট ভোটাভুটিতে তার পদ রক্ষা হয়। এবার গত নভেম্বরে ভোটের পর হার স্বীকার না করে উল্টো কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচনকে বিতর্কিত করার দৃষ্টিকটূ প্রয়াস চালান ট্রাম্প। তার ধারাবাহিকতায় গত ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসে জো বাইডেনের বিজয়ের স্বীকৃতি দেওয়ার দিনে বিক্ষুব্ধ ট্রাম্প সমর্থকরা ক্যাপিটল ভবনে নজিরবিহীন হামলা চালায়। তাতে নিহত হয় পাঁচজন।ওই হামলার ঠিক আগেই ট্রাম্প তার সমর্থকদের উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে উগ্রতার প্ররোচনা ছিল বলে সব মহল থেকে সমালোচনা ওঠে। রিপাবলিকান পার্টির অনেক নেতাও এর সমালোচনায় মুখর হন। এই অবস্থায় প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব পালনের ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করে ট্রাম্পের হাত থেকে ক্ষমতা নিতে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের প্রতি আহ্বান জানায় কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাট সদস্যরা।
এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ২৫তম সংশোধনী প্রয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্সকে। ২৫তম সংশোধনীতে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট যদি শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে দায়িত্ব চালিয়ে যেতে ‘অপারগ’ হন, তাহলে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ভাইস-প্রেসিডেন্ট ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব নিতে পারেন। ওই সংশোধনীর ৪ নম্বর ধারায় বলা আছে, প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে না পারলে ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য তাকে ‘দায়িত্ব পালনে অপারগ’ ঘোষণা করতে পারেন। কিন্তু পেন্স সেই আবেদনে সাড়া না দিলে প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসনের প্রস্তাব আনার পথে হাঁটেন ডেমোক্র্যাট নেতারা। তবে এর মধ্যে ট্রাম্প এক বিবৃতিতে তার সমর্থকদের সহিংসতা পরিহারের আহ্বান জানান।
দেড়শ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধের পর ন্যাশনাল গার্ড সদস্যরা এই প্রথম কংগ্রেস ভবনের ভেতরে অবস্থান নেন নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনে।
ভোটাভুটির আগে কয়েক ঘণ্টা উত্তপ্ত বিতর্ক চলে প্রতিনিধি পরিষদের অধিবেশনে। প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ডেমোক্র্যাট নেতা ন্যান্সি পেলোসি বলেন, “ইতিহাসকে এড়িয়ে যেতে আমরা পারি না। আমরা দেখেছি, প্রেসিডেন্ট দাঙ্গায়, সশস্ত্র বিদ্রোহে উসকানি দিয়েছেন। তাকে (ট্রাম্প) যেতেই হবে। তিনি জাতির জন্য স্পষ্ট ও জাজ্বল্যমান এক হুমকি।”
এর বিরোধিতায় রিপাবলিকান নেতারা এই অভিশংসন প্রস্তাবকে ডেমোক্র্যাটদের বাড়াবাড়ি বলে মন্তব্য করেন। তারা বলেন, সহিংসতা নিয়ে এখন উচ্চকণ্ঠ হলেও সম্প্রতি বর্ণ বিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীরা সহিংস বিক্ষোভ করলেও তখন ডেমোক্র্যাটদের কোনো রা ছিল না।
তবে প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকান পার্টির যে ক’জন সদস্য ট্রাম্পকে অভিশংসন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন, তারা দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলে জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা স্টেনি হয়ার যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরাতে কংগ্রেসকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। তবে সিনেট রিপাবলিকানদের নেতা মিচ ম্যাককনেল প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ট্রাম্পকে সরাতে অভিসংশন নিয়ে সেনেটের জরুরি অধিবেশন ডাকার সম্ভাবনা নাকচ করেছেন বলে রয়টার্স জানিয়েছে। তার মানে দাঁড়ায় বিদায়ের আগে ট্রাম্পের পদ হারানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ; অর্থাৎ ভবিষ্যতে যাই হোক না কেন, এই দফায় মেয়াদ পূর্ণ করতেই যাচ্ছেন তিনি।
Posted ৭:৫৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh