জাফর আহমাদ | বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫
ছবি : সংগৃহীত
পরিবার আল্লাহর দেয়া অসংখ্য নিয়ামতের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামত। পরিবার মানুষের বেঁচে থাকার জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল, মানসিক প্রশান্তি লাভের একটি বিশেষ স্থান। ভবিষ্যত সভ্যতা গড়ার এক বিশেষ বিদ্যাপীঠ। এ বিদ্যাপীঠে এমন একজন প্রশাসনিক প্রাধ্যক্ষ রয়েছেন, যিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ট ও সর্বোত্তম অধ্যক্ষ। এবং এমন একজন শিক্ষক রয়েছেন যিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ট শিক্ষক। যার সাথে পৃথিবীর কোন শিক্ষকের তুলনা চলে না। সম্মানিত শিক্ষকদ্বয় হলেন, বাবা-মা। এটি এমন এক বিদ্যাপীঠ, যেখানে বহুমূখী শিক্ষা প্রদান করা হয়। নৈতিক,মানসিক ও চারিত্রিক শিক্ষার পাশাপাশি মেডিকেল সাইন্স, নার্সিং,হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, সামাজিক বিজ্ঞান, মানবিক ও অর্থনৈতিক শিক্ষা উল্লেখযোগ্য।
মানব জীবনে পরিবার এক গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। পরিবার ছাড়া মানুষ সুস্থভাবে বেঁেচ থাকতে পারে না। মানুষের জীবনে বিপদ-আপদ, সুখ-দু:খ, আনন্দ-বেদনা, অসুখ-বিসুখ, ব্যথা-বেদনা ইত্যাদি নিত্যদিনের সংগী। যা মানুষের জীবনকে বীতশ্রদ্ধ করে তুলে। কিন্তুপরিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হলে,এই বিষয়গুলোর সহজেই উত্তরণ ঘটানো সম্ভব। পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের পরিস্পরিক দেখাশোনার কারণে বিপদগ্রস্থ সদস্য সহজেই বিপদমুক্ত হতে পারে এবং নিরাপদ ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারে। পরিবার মানবসভ্যতা গঠনের প্রাথমিক ও অত্যন্ত শক্তিশালী কারখানা। পৃথিবীর কোন ধর্ম বা কোন মনিষী ও সমাজ বিজ্ঞানীরা পরিবারের গুরুত্বকে খাটো করে দেখেননি। তাদেরসকলেই এর গুরুত্ব অপরিসীম গণ্য করেছেন। বিশেষত: একজন শিশুর উজ্জল জীবনের ভীত রচনার জন্য পরিবার হলো তার প্রাথমিক পাঠশালা। একান্তই ব্যতিক্রম ছাড়া এই ভীত রচনার জন্য অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করা বৃথা। পরিবারই এই ভীত রচনার জন্য উপযুক্ত।
এই পাঠশালার পাঠ্য তালিকায় যে ধরনের বই সিলেকসন করা হবে, শিশুর জীবনের ভীত রচিত হবে সে সিলেবাসেরই উপড়। যেমন এই পাঠশালার প্রধান ও অত্যন্ত শক্তিশালী দ’ুজন শিক্ষক বা সদস্য পিতা ও মাতার গুরুত্ব অপরিসীম। এই দূ’জন শিক্ষককে খুব ভালো করে মনে রাখতে হবে যে, তাদের দৈনন্দিন মৌখিক পাঠ দানের চেয়ে তাদের আচরণ, কথা-বার্তা ও কাজ-কর্মকে ছেলে-মেয়েরা বেশী অনুসরণ করে। ছেলে-মেয়েরা তাদের জীবনের মডেল হিসাবে পিতামাতাকে গ্রহণ করে থাকে। তাই অনুকরণ প্রিয় শিশুর পিতা-মাতা যদি ব্যক্তিগতভাবে সৎ,আল্লাহভীরু ও ইসলামী অনুশাসণের পূর্ণ অসুসারী হন এবং পারিবারিক পর্যায়ে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদর্শিত পন্থায় পরিবেশকে গড়ে তুলেন, তাহলে তাদের সন্তানেরা সেভাবেই গড়ে উঠবে। ছেলে-মেয়েদের নৈতিক চরিত্র গঠণ করা পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা সুষ্পষ্ট জুলুম হিসাবে বিবেচিত হবে।
আল¬াহ তা’আলা বলেন: “তোমাদের নিজেদেরকে ও পরিবার পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।”(সুরা তাহরীম:৬) রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “সুন্দর নৈতিক চরিত্র ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়ার চাইতে উত্তম কিছুই মা বাপ সন্তানদের দান করতে পারে না।”(তিরমিযি) আবু দাউদে বর্ণিত যে, হযরত রাসুলে করীমসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: কোন বালকের সাত বৎসর বয়স হলেই তাকে নামাযের আদেশ দাও। আর দশ বৎসর বয়স হলে সে জন্য প্রহার করো ও বিছানা আলাদা করে দাও।”(হাদীস নং ৪৯৫, কিতাবুস সালাত, বাবু মাতা ইউমারুল গোলামু….., আহমাদ ৬৬৮৯) প্রত্যক্ষ করুন আল-কুরআনের সুরা লোকমানে একজন আদর্শ পিতা তাঁর ছেলেকে কিভাবে উপদেশ দিচ্ছেন,“ স্মরণ করো যখন লোকমান নিজের ছেলেকে উপদেশ দিচ্ছিল, সে বললো ‘হে পুত্র ! আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না। যথার্থই শিরক অনেক বড় জুলুম।”(সুরা লোকমান : ১৩)
পরিবার ছাড়া কোন মানুষ তার সঠিক লক্ষ্যপানে চলতে পারে না। একমাত্র পরিবারই তাকে একটি স্থানে ও একটি লক্ষ্যে চলতে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারে। কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে, পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা তাকে সঠিক পথে চলতে ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ফিরিয়ে আনতে তৎপর হয়। পারিবারিক বন্ধনমুক্ত যে কোন ব্যক্তি ভালো-মন্দ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে, লক্ষ্যহীন দিক বেদিকে ইচ্ছা চলে যেতে পারে। অনেক হালহীন বা মাঝিবিহিন নৌকার মতো। পানির ঘূর্ণাবর্তে পড়ে জীবনের তরে হারিয়ে যেতে পারে। তাই অনিশ্চয়তা ও লক্ষ্যহীন জীবন থেকে বাঁচার জন্য পারিবারিক বন্ধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে পরিবারের দু’জন শক্তিশালী সদস্য পিতা ও মাতা অবশ্যই রুচিশীল আদর্শবান হতে হবে। মনে রাখতে হবে, আল-কুরআনে পিতা-মাতার এতবেশী সম্মান,ইজ্জত ও অধিকার দান করার পিছনে কি কারণ থাকতে পারে? আমি মনে করি বহুবিদ কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ হলো, যেহেতু পিতামাতা অত্যন্ত পরিশ্রম করে নিজের সন্তানদেরকে নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন, সুচরিত্রবান ও সামাজিক দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব হিসাবে গড়ে তুলেন। এবং এর পিছনে পিতা-মাতার অবদানই সবচেয়ে বেশী। যার দরুন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর আলোচনার পরপরই পিতামাতার কথা বলেছেন। আল্ল¬াহ তা’আলা বলেন:“তোমরা আল্ল¬াহর দাসত্ব করো। তার সাথে কাউকে শরীক করো না, আর পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো।”(সুরা নিসা ঃ ৩৬) হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত এক ব্যক্তি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আরয করেনঃ হে আল্লাহর রাসুল! আমার ভাল ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে বেশী অধিকারী কে ? তিনি বললেন তোমার মা। এভাবে তিনবার মার কথা বলার পর চতুর্থবার পিতার কথা বলেন। (আদাবুল মুফরাদ, পর্ব পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা, পরিচ্ছদ: মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার করা) পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এছাড়াও আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও রাসুলের হাদীসে পিতামাতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করে সম্মানিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“আর আমি মানুষকে তার পিতামাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি।”(সুরা লোকমান:১৪) কিন্তু এ পিতামাতাই যদি নিজ হাতে নিজের সন্তানদেরকে ধ্বংসের রাজপথে তুলে দেন তবে সে সমস্ত পিতামাতাকে মুলতঃ দেশ ও জাতির শুত্রু বলে আখ্যায়িত করব। কারণ অপরিণামদর্শী এসব পিতা-মাতাই জাতীয় সন্ত্রাসী, গডফাদার, আন্তর্জার্তিক চোরাচালানী, চোর-ডাকাত ও বদমায়েশী শিক্ষার সবগুলো উপাদান চেতনে বা অবচেতনে পারিবারিক পরিবেশে ছোট্র কচি মনের শিশুটির জন্য প্রধানযোগানদাতার ভুমিকা পালণ করেন। তাই সকল পিতামাতাকে বলব আপনার প্রাণপ্রিয় শিশুটিকে সৎ, আল্লাহভীরু ও ইসলামী অনুশাসণের পূর্ণ অসুসারী হিসাবে গড়ে তোলার নিমিত্তে পারিবারিক পরিবেশে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদর্শিত পন্থায় সুস্থ বিনোদন ব্যবস্থা চালু করুন।
সুন্থ পরিবার নিয়ে সুস্থ সমাজ গড়ে উঠে। সুস্থ সমাজ নিয়ে সুস্থ রাষ্ট গড়ে উঠে। কিন্তু আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার অবক্ষয় ও সামাজিক বিপর্যয় কোন ক্রমেই ঠেকানো যাচ্ছে না। সামাজিক এই বিপর্যয়ের জন্য আমাদের পরিবারগুলো বহুলাংশে দায়ী। কারণ পরিবার নিয়েই তো সমাজ গড়ে উঠে। সুতরাং পরিবার যদি খারাপ হয়, তা সরাসরি সমাজকে প্রভাবিত করে। বর্তমান পরিবারগুলো ডিস, সিডি, ইন্টারনেট, মোবাইল, সাইবারক্যাফ ইত্যাদির মাধ্যমে পর্ণোছবি দেখা, ব্লাক মেইলিং, ইভটেজিং এর মতো খারাপ কাজ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এগুলো আরো ব্যাপকতা লাভ করেছে অশালীন পোশাক, রূপচর্চা, ফ্যাশন, অশালীন উদ্যাম নাচগান, অবাধ মেলামেশা যত্রতত্র আড্ডা, প্রেমালাপ, মাদক, পরকীয়া, অবৈধ যৌনাচার ও সন্ত্রাস-এর কারণে। এগুলো জন্য আজ্ঐতিহ্যবাহী পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে বসেছে। আমরা নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে আমরা এক বিশাল ধ্বংসের দিকে দিকে ধাবিত হচ্ছি। এই মহাধ্বংসযজ্ঞ থেকেবর্তমান সমাজকে উদ্ধার করার জন্য পরিবারিক পরিসরে নৈতিক শিক্ষা চালু করতে হবে। ইসলামী শিক্ষার অনুশীলন, ইসলামী মূল্যবোধেরচর্চা, ইসলামী সংস্কৃতি প্রচলন করতে হবে।
পিতামাতা উভয়ে পারিবারিক বন্ধনকে অরো শক্ত করার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিজেরা সংসার বিরাগী বা বৈরাগ্য হবেন না এবং পরিবারের কেউ যাতে এ পথে যেতে না পারে সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তাদেরকে জনাতে হবে যে, ইসলাম বৈরাগ্য জীবন যাপন করার অনুমতি প্রদান করে না। আল্লাহ তা’আরা বলেন, “আর বৈরাগ্যবাদ তো তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করে নিয়েছে। আমি ওটা তাদের ওপর চাপিয়ে দেইনি।”(সুরা হাদিদ:২৭) পরিবারের সদস্যদেরকে কোন অবস্থাতেই বন্ধনহীন অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়া যাবে না। একেকটি পরিবার মূলত: কতগুলো হৃদয়ের সমষ্টি, যেখানে জীবনের প্রবাহ আছে, মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালবাসা, সেবা-পরিচর্যা, শ্রদ্ধা-উদার্যতা ও সহনশীলতা আছে। যেখানে সুখ-দু:খ, আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগির করার মানসিকতা সম্পন্ন একদল লোক থাকবে। কিন্তু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোন মানুষ এই সুযোগ-সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে তাকে ভবঘূরের জীবন বেঁচে নিতে হয়। যা কোনক্রমেই কাম্য নয়।
Posted ১১:৩৪ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh