শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪ | ১৬ কার্তিক ১৪৩১

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক : একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ

জয়ীতা ভট্টাচার্য   |   শনিবার, ০৮ আগস্ট ২০২০

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক : একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি হৃদ্যতাপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান। প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের পুস্তকীয় উদাহরণ হিসেবে এই সম্পর্ককে বিবেচনা করা হয়। তবে সম্প্রতি দুই দেশের সম্পর্কে উষ্ণতায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে বলে দাবি উঠেছে। এই ধরনের ধারণার মূল ভিত্তি হলো ভারতের একটি জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের একটি বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত একটি নিবন্ধকে উদ্ধৃত করে দাবি করা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৪ মাসে ভারতীয় হাইকমিশনারকে সাক্ষাতের সময় দিচ্ছেন না। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর ভারতে কিছুটা দ্বিধার সৃষ্টি হয়েছে, কেননা অতীতে ভারতীয় দূতের এই ধরনের অনুরোধ গ্রহণে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ সাধারণত দ্রুতই সাড়া দিয়েছে। তবে দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো অনুসিদ্ধান্ত টানার আগে, সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত দাবির সত্যতা প্রতিপাদনে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর চুলচেরা বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
এখানে উল্লেখযোগ্য হলো, সংবাদ মাধ্যমের এই দাবি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, ভারতীয় হাইকমিশনারের সাক্ষাতের অনুরোধে সাড়া না দেয়ার প্রশ্নই উঠে না।

মন্ত্রণালয় বলছে যে, কভিড-১৯ মহামারির কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছেন। ফলে তিনি বিদেশীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন না। গত কয়েক মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো বিদেশীর সঙ্গেই সাক্ষাৎ করেননি। ফলে ভারতীয় দূতের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে এত চেঁচামেচি কেন!
তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে বিদেশী মিশনের করা অনুরোধের ওপর। কিন্তু ভারতীয় হাইকমিশন এই কয়েক মাসে এই ধরনের কোনো বৈঠকের অনুরোধও করেনি। সবে ২২শে জুলাই সাক্ষাত চেয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয় হাইকমিশন থেকে।

এই ঘটনা বাংলাদেশে এক ধরণের বিরক্তির মনোভাব তৈরি হয়েছে। এছাড়া ভারতীয় মিডিয়ার উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশে ভারতীয় মিডিয়া খুবই ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ বা দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে করা সংবাদের দিকে আলাদা নজর রাখা হয়। বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতীয় মিডিয়ায় ইতিবাচক কিছু আনন্দেরই অনুভূতি জন্মায়। তবে নেতিবাচক কিছু রীতিমত গণ-অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর তার ভিত্তিতে কিছু কায়েমী গোষ্ঠি ভারত-বিরোধী বাগাড়ম্বর প্রচারের সুযোগ পায়। এই জটিলতা নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার সচেতন হওয়া বা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে প্রতিবেদন লেখার আগে সুক্মা দতিসুক্ষ্ম বিষয়ের দিকে নজর দেয়া যে জরুরী, তা-ই যেন এই ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অবনতি হয়েছে, এমনটা ধরে নেয়ার একটি মুখ্য কারণ হলো পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ফোনালাপ। দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উষ্ণ নয়। বিশেষ করে ২০০৯ সালে নির্বাচন জয়ের পর শেখ হাসিনা সরকার ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর এই অবস্থা সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানি মিডিয়ায় বলা হয়েছে, দুই নেতার এই সাম্প্রতিক ফোনালাপ দুই দেশের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। ভারতীয় মিডিয়া এই ঘটনায় সতর্ক হয়ে উঠে। মিডিয়ায় বলা হয়, ভারত থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে বাংলাদেশ, তারই লক্ষণ এটি।

২০১৬ সালে সীমান্তে সন্ত্রাসবাদ লালনের অভিযোগে পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় সার্ক সম্মেলন থেকে সরে আসে ভারত। এরপর বাংলাদেশও ওই সম্মেলনে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ভারতীয় মিডিয়ায় বলা হচ্ছে, ভারতে জাতীয় নাগরিকপুঞ্জি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের কারণে বাংলাদেশে জন-অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। ভারত নিয়ে এই অস্বস্তিরই প্রতিফলন ঘটেছে বাংলাদেশের ওই পদক্ষেপে।

তবে সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশ সম্পর্ক অত্যান্ত সুদৃঢ়। গত কয়েক বছর ছিল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের স্বর্ণযুগ। ইমরান খানের সঙ্গে শেখ হাসিনার ফোনালাপের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান নীতি হলো সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। এই নীতির কারণেই প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ওই ফোনালাপে সম্মত হন।
কিন্তু ওই একটি ফোন কলই কি পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ধরণ পাল্টে গেল? এর উত্তর লুকিয়ে আছে দুই দেশের সরকারের ইস্যু করা দুই পৃথক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। পাকিস্তানের জারি করা প্রেস রিলিজে বলা হয়, দুই দেশ কভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিতি ছাড়াও, কাশ্মীর ও সার্কের বিষয়ে আলাপ করেছে। অপরদিকে বাংলাদেশ সরকারের জারি করা প্রেস রিলিজে সার্ক ও কাশ্মীরের বিষয়টি একেবারেই অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দুই নেতা শুভেচ্ছামূলক আলাপ করেন। এছাড়া বাংলাদেশে কভিড-১৯ মহামারি ও বন্যা মোকাবিলায় সরকারের নেয়া পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ দাবি করে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি অর্থবহ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হলে পাকিস্তানকে ১৯৭১ সালের নৃশংসতা নিয়ে প্রথমে ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের কাছ থেকে এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য প্রায় দেখা যায়নি বললেই চলে। দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের অস্বস্তি এই দুই ঘটনায় প্রতিভাত হয়ে উঠে।

এছাড়া ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে ভারতীয় মিডিয়ায় যেভাবে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে, তা নিয়েও বাংলাদেশের জনগণ বিরক্ত। বাংলাদেশে এই ধারণাই বিরাজমান যে, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক একেবারেই অনন্য, রক্তে বাঁধা। এই সম্পর্ক অন্য আরেক দেশের সঙ্গে তুলনীয় নয়। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারে অত্যান্ত সতর্ক। তিনি নিজেও খুবই দক্ষতার সঙ্গে দুই সম্পর্কের পার্থক্য ব্যাখ্যা করেছেন।

২০১৯ সালের জুলাইয়ে চীন সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক প্রাকৃতিক, যা কয়েক বিলিয়ন ডলার দিয়ে বিচার্য নয়। অপরদিকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক হলো মেগা প্রজেক্টে আংশিদারিত্ব ও অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা। এই বিবৃতিতেই ফুটে উঠে দুই শক্তিধর এশিয়ান রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের সংজ্ঞা।

তবে চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বেশ বেড়েছে বলেই সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় ইঙ্গিত মিলে। তাই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কহানির বিষয়ে যেই ভবিষ্যদ্ববাণি প্রচলিত রয়েছে, তা নিয়েই সংশয় বেড়েছে। কিন্তু বিপরীতে, কভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলা ও পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। কভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেই আঞ্চলিক জরুরী তহবিল প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছেন, তার সমর্থক বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ২০২০ সালের মার্চে এই তহবিলে ১৫ লাখ ডলার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ভারত বাংলাদেশকে মেডিকেল সহায়তাও দিয়েছে এই মহামারি মোকাবিলায়। দুই দেশের রেল যোগাযোগ বেড়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রেল সার্ভিস বৃদ্ধি করা হয়েছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হলো বাংলাদেশকে অনুদান হিসেবে ভারতের ১০টি লকোমোটিভ ইঞ্জিন প্রদান করা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে নতুন ইঞ্জিন আসার আগে এই ইঞ্জিনগুলো বাংলাদেশের দরকার ছিল, কারণ বিদ্যমান ইঞ্জিনগুলোর বেশিরভাগই মেয়াদহীন।

ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলে পরীক্ষামূলকভাবে সমুদ্রপথে মালামাল পরিবহণ শুরু হয়েছে। জুলাইয়ে এই পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ভারতকে এই সুবিধা দিলেও, শেখ হাসিনা সরকারের জন্য রাজনৈতিক ঝুঁকি ছিল প্রবল। অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগও শক্তিশালী হয়েছে। মে মাসে দুই দেশ অভ্যন্তরীণ নৌ বাণিজ্য ও ট্রানজিট নীতিমালার পরিসর বৃদ্ধিতে সম্মত হয়। দু’টি নতুন রুট ও ৫টি পোর্ট অব কল যুক্ত হয় এই প্রটোকলে। দুই দেশের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাওয়ারই প্রতিফলন এসব ঘটনা।
এছাড়া দুই দেশের নেতাদের বক্তব্য থেকেও সম্পর্কের উষ্ণতার আঁচ পাওয়া যায়। জুলাই মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয় একটি ভিডিও কনফারেন্সে মিলিত হয়েছিলেন। দুই মন্ত্রীই ওই সভায় সম্পর্ক নিয়ে আশাবাদী মন্তব্য করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দলের দুই নম্বর ব্যক্তি ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ভারতীয় হাইকমিশনার। দুই দেশের সম্পর্কে সম্প্রতি যেই অগ্রগতি হয়েছে, তা সম্ভব হতো না যদি দুই দেশের মধ্যে ইতিবাচক বোঝাপড়া না থাকতো।
ভারত-বাংলাদেশের এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে সকল পক্ষের সমর্থন প্রয়োজন। বিশ্লেষণের সময় এই সম্পর্কের অনন্য বৈশিষ্ট্যের কথা মাথায় রাখলে দ্বিপক্ষীয় বন্ধন শক্তিশালীকরণে অসামান্য ভূমিকা রাখবে।

[ভারতের প্রভাবশালী থিংকট্যাংক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ ফেলো জয়ীতা ভট্টাচার্যের এই নিবন্ধ প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে প্রথম প্রকাশিত হয়।]

Posted ৯:৩৮ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০৮ আগস্ট ২০২০

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

কাঁঠাল সমাচার
কাঁঠাল সমাচার

(1569 বার পঠিত)

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বু বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩১৫
১৬১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭
৩০  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

86-47 164th Street, Suite#BH
Jamaica, New York 11432

Tel: 917-304-3912, 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: weeklybangladesh@yahoo.com

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.