বাংলাদেশ প্রতিবেদন : | বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন ২০২২
উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশী চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা-বিএমএএনএ ভেঙ্গে গেলো। আসন্ন ফোর্থ জুলাই উইকএন্ডে একই দিনক্ষণে নিউইয়র্ক সিটির হোটেল ম্যারিয়ট মার্কিস ও লাগোর্ডিয়া এয়ারপোর্ট ম্যারিয়টে অনুষ্ঠিত হবে পৃথক দু’টি সম্মেলন।
একদিকে বিএমএএনএ’র ৪১তম এই সম্মেলনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে উভয় পক্ষে। অপরদিকে বিভক্তি নিয়ে বিব্রত সাধারণ সদস্যরা। ম্যানহাটানের হোটেল ম্যারিয়ট মার্কিসে ৪১তম বিএমএএনএ সম্মেলন আয়োজন চূড়ান্ত করেছে সংগঠনটির আরেক অংশ। তিনদিন ব্যাপী এই সম্মেলন চলবে ১ থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত। নিউইয়র্কের স্থানীয় চিকিৎসক ও কেন্দ্রীয় বিএমএএনএ’র নির্বাহী কমিটির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত হচ্ছে এবারের সম্মেলন। অধিকাংশ চিকিৎসক এই সম্মেলনে যোগদান করবেন এমন আশাবাদ আয়োজকদের। বড় বাজেটের উভয় সম্মেলনই হবে বিলাসবহুল।
অপরদিকে বিএমএএনএ’র একাংশ নিউইয়র্ক লাগোর্ডিয়া ম্যারিয়ট হোটেলে ৪১তম সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএমএএনএ নিউইয়র্ক চ্যাপ্টার এই সম্মেলনের আয়োজক সংগঠক। তিনদিনব্যাপী এই সম্মেলন ৩০ জুন থেকে চলবে ৩ জুলাই পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহর থেকে বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক এবারের সম্মেলনে অংশ নিবে এমনটিই ধারণা আয়োজকদের।
সংগঠন ভাঙ্গার নিখুঁত কারিগরের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশীদের অবস্থান বরাবরই শীর্ষে। এখানে সংগঠন গড়ে উঠে যেমন দ্রুত এবং ব্যাঙ্গের ছাতার মতো, ভাঙ্গেও তেমনি কারণে অকারণে। সামাজিক, আঞ্চলিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সহ প্রায় সব সংগঠনেই রয়েছে একাধিক বিভক্তি। পেশাজীবী সংগঠনগুলো এর বাইরে নয়। আমেরিকান বাংলাদেশী ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, সাংবাদিক সহ অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠনগুলোও দ্বিধা-ত্রিধা বিভক্ত। বাকি ছিলো চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন। শেষ পর্যন্ত এই সংগঠনটিও ভেঙ্গে গেল। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, ব্যক্তি ইগু ও নেতৃত্বের কোন্দলের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছিলো বিএমএএনএ। নানাবিধ ইস্যুতে কেন্দ্রীয় বিএমএএনএ স্পষ্ট দু’টি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। বিভেদ-বিভ্রান্তি ও কাঁদা ছুড়াছুড়ি এমন পর্যায়ে পৌছায় যে সংগঠনের তহবিল ও নির্বাচন নিয়ে তারা বার কয়েক জড়িয়ে পড়েন মামলা মোকদ্দমায়। মাত্রাহীন পর্যায়ে পৌছায় অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ। গত বছর ৪০তম সম্মেলনকে ঘিরে বিভক্তি অনেকটাই চূড়ান্ত হয়ে যায়। এবারের ৪১তম সম্মেলন ভেঙ্গে যাওয়া বিএমএএনএ’র আনুষ্ঠানিক অভিষেক বলে মন্তব্য করেছেন বেশ ক’জন সাধারণ সদস্য। একটি মর্যাদাশীল পেশাজীবী সংগঠনের এমন ভাঙ্গন অনেকেই সহজভাবে নিতে পারছেন না। একই শহরে অনুষ্ঠিত একই নামের দু’টি সম্মেলনের কোনটিতে অংশ নিবেন এ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কেউ কেউ।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশী চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা বা বিএমএএনএ। অলাভজনক, অরাজনৈতিক, শিক্ষা ও সেবার ব্রত নিয়ে ১৯৮১ সালে কতিপয় চিকিৎসকের উদ্যোগে সংগঠনটির জন্ম মিশিগানে। সময়ের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে বিএমএএনএ’র ১৮টি শাখা গড়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় বিএমএএনএ প্রতি বছর আয়োজন করে থাকে একটি জাতীয় কনভেনশন। প্রতিষ্ঠার চার দশক পর ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪০টি সম্মেলন অনুর্ষ্ঠিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭টি শহরে। এসব সম্মেলনের মধ্য দিয়ে প্রবাসী চিকিৎসক ও তাদের পরিবারের মাঝে পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ঝালাইয়ের সুযোগ অবারিত হতো। পাশাপাশি পরিচালিত হতো শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক ও মানবিক দিক দিয়ে বিষয়ে কর্মকান্ড। দেশ ও প্রবাসে দুযোগ ও দুর্বিপাকে আর্থিক সহায়তার জন্য একটি তহবিলও রয়েছে সংগঠনটির। এছাড়া সীমিত পরিসরে হলেও বাংলাদেশী আমেরিকান চিকিৎসকদের মাঝে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি এবং স্বদেশ থেকে চিকিৎসা পেশার সন্ধানে আসা তরুণদেরকে সহায়তা করে আসছে বিএমএএনএ।
কিন্তু সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে একধরণের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সংগঠনটিতে। বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের নিবন্ধিত চিকিৎসকগণ বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন’র সদস্য হতে পারেন বাংলাদেশে। ভোটাধিকার প্রয়োগ সহ সমূহ অধিকার সংরক্ষণ করেন কর্মকর্তা নির্বাচিত হওয়ার। বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন উত্তর আমেরিকা দেশের আদলে প্রতিষ্ঠিত একটি সংগঠন হলেও সদস্য করণের ক্ষেত্রে শুরুতেই তুলে দেয়া হয় বৈষম্যের দেয়াল। শুধুমাত্র উত্তর আমেরিকায় প্র্যাকটেসিং চিকিৎসকদের জন্যই সদস্য সুযোগ উন্মুক্ত রাখা হয়। এ বিষয়টি নিয়ে নন-প্র্যাকটেসিং এমনকি অনেক প্র্যাকটেসিং চিকিৎসকের মাঝেও বিরাজ করছিলো অসন্তুষ্টি। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় তিন সহস্র চিকিৎসক থাকা সত্বেও বরাবরই বিএমএএনএ’র সদস্য সংখ্যা ছিলো হাজারের কোঠায়। সংগঠনটির সার্বিক কার্যক্রমও ঘুরপাক খাচ্ছিলো একটি গন্ডির মধ্যে। এসব কারণেই বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত-নতুন প্রজন্মের চিকিৎসকদের সাথে এখনো নূন্যতম সংম্পৃক্ততা গড়ে উঠেনি সংগঠনটির।
সাধারণ সদস্যদের অভিযোগ সংগঠনটিতে মহল বিশেষের নেতৃত্ব ধরে রাখার প্রবণতা, আত্মকেন্দ্রীকতা ও প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক অভিলাষ বিএমএএনএকে ক্রমান্বয়ে বিবাদমান ও কোন্দলমুখী করে তুলে। বিশেষ করে নিউইয়র্ক চ্যাপ্টারের নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। সংবিধানের সদস্যকরণ নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ মূল বিএমএএনএ’র বাইরে আরো একটি সমান্তরাল সংগঠন সৃষ্টিতে খোরাক যোগায়।
গত বছর টেক্সাস সম্মেলনে সদস্যকরণ বিধিতে আনা হয়েছে আংশিক সংশোধনী। নূতন এই সংশোধনীতে এক শ্রেনীর নন প্র্যাকটিসিং চিকিৎসকের জন্য সদস্য হওয়ার পাশাপাশি নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশী চিকিৎসকদের মাঝে শ্রেনী বৈষম্য নিয়ে বিভেদ বিভ্রান্তির সুরাহা হতে না হতেই চূড়ান্ত ভাঙ্গনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে বিএমএএনএ। নেতৃত্বের কোন্দল, কোটারী স্বার্থ, ব্যক্তিগত খবরদারি সহ নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিরোধ নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে চলে আসছিলো সংগঠনটি। চিকিৎসকদের অভিজাত ও পেশাজীবী এ সংগঠনের বিভক্তিতে ক্ষুব্ধ সাধারণ সদস্যরা। যেকোন মূল্যে এক ও অভিন্ন বিএমএএনএতে বিশ্বাসী তারা। কতিপয় চিকিৎসকের ব্যক্তি ইগু স্বার্থের কারণে সংগঠনটির এমন বিপর্যয় তারা মেনে নিতে অনাগ্রাহী।
এদিকে বিভক্ত বিএমএএনএ’র নাম ও ট্যাক্স আইডি’র ব্যবহার নিয়ে দেখা দিয়েছে বড় ধরণের জটিলতা। একই নাম ও ট্যাক্স আইডি ব্যবহার করছে বিভক্ত সংগঠনটির উভয় অংশ। গত এক বছর ধরে এই প্রক্রিয়া চলছে। লেনদেন হচ্ছে হাজার হাজার ডলার। বিভক্ত বিএমএএনএ’র একাংশ নিয়ম মাফিক ট্যাক্স রিটার্ন করলেও অপরাংশ কিভাবে লেনদেন করছে এনিয়ে কেউ কেউ স্বচ্ছতা ও অনৈতিকতার প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। । অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান যেভাবে আইআরএস’র চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব করছে তা সংগঠনটিকে ভয়াবহ বিপদে ফেলতে পারে বলে আশংকা করছেন তারা।
Posted ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh