বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট ২০২২
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হাউজিং খাত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে জটিল মন্দাবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ হোম বিল্ডার্স (এনএএইচবি)। অ্যাসোসিয়েশনের সিইও জেরি হাওয়ার্ড সম্প্রতি ব্লুমবার্গ নিউজ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বর্ণনা করেছেন যে আবাসিক ভবন নির্মাণ কীভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ব্যাপক কমে যাওয়ার প্রেক্ষিতে হাউজিং খাত জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, আবাসিক রিয়েল এস্টেট আমেরিকান অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ হোম বিল্ডার্স এর মতে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে হাউজিং তৎপরতার বার্ষিক অবদান ১৫ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত। অতএব এই খাতের অবনতি অর্থনীতির অবশিষ্ট অংশের ওপর গুরুতর বাজে প্রভাব ফেলবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হাউজিং খাতে এমন শোচনীয় পরিস্থিতি আর কখনও সৃষ্টি হয়নি বলে জেরি হাওয়ার্ড জানান। অ্যাসোসিয়েশনের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী ক্রেতা ও বিল্ডাররা উভয় হাউজিং মার্কেট থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছে, যা ২০২২ সালে আমেরিকার অর্থনৈতিক দিগন্তে আরেকটি সম্ভাব্য মন্দার ইঙ্গিত।
হাউজিং মার্কেটে চাহিদার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে সম্ভাব্য বাড়ি ক্রেতারা বাজর থেকে ক্রমেই সরে যাচ্ছে। বিদ্যমান হাউজিং মার্কেট থেকে গত জুন মাসে বাড়ি বিক্রয় হ্রাস পেয়েছে ৫.৪ শতাংশ। সূদ হার অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় সম্ভাব্য বাড়ি ক্রেতাদের ঋণ করার সামর্থও হ্রাস পেয়েছে। গড় মর্টগেজ হার গত ৩৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুততার সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে। পনের বছর মেয়াদী নির্ধারিত মর্টগেজ রেট এক বছর আগে ছিল মাত্র ২.২ শতাঙশ, যা এখন ৪.৮ শতাংশ। এসব কারণে বাড়ির চাহিদা আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে।
এদিকে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য এবং শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিও নতুন বাড়ি নির্মাণের ব্যয় বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে। সেজন্য হোম-বিল্ডারদের বাড়ি নির্মাণের আগ্রহে গত জুন মাসে ১২ পয়েন্ট হ্রাস পেয়েছে বলে অ্যাসোসিয়েশন অফ হোম বিল্ডার্স সূত্র নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছে। অ্যাসোসিয়েশনের সিইও জেরি হাওয়ার্ড ব্লুমবার্গ নিউজকে আরও বলেছেন যে হাউজিং চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে মৌলিক দুর্বলতাগুলোই এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, হাউজিং খাত যে প্রতিবারের জাতীয় অর্থনৈতিক মন্দায় ভূমিকা রেখেছে, তা যেমন সত্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিটি অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠতেও হাউজিং খাত ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এবার মন্দা কাটিয়ে ওঠার গতি মন্থর হবে। নির্মাণ সামগ্রীর বর্ধিত মূল্য এবং শ্রমিক ঘাটতি বা শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির বিষয়গুলো সহ সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে আসতে বিলম্ব হলে মন্দা থেকে উদ্ধারও বিলম্বিত হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে বিগত দুই শতাব্দিতে হাউজিং বা রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় বড় ধরণের ৫টি ধস নামে। প্রথম ধস নামে ১৮৩৭ সালে। এসময় অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে মানুষ। এর প্রায় চার দশক পরে ১৮৭৩ সালে স্টক মার্কেট ভেঙ্গে পড়লে মন্দা দেখা দেয় হাউজিং ক্ষেত্রে। ১৯২৯ সালে ওয়ালস্ট্রিটের শেয়ার বাজারে ধসের কারণে ব্যাপক মন্দা দেখা দেয় রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়। পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে স্মরণকালের ভয়াবহ মন্দায় রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীগণসহ দিশেহারা হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। এসময় বিপুল সংখ্যক বাড়ি ফিরে যায় ব্যাংকের মালিকানায়। সাম্প্রতিককালে সর্বশেষ ২০০৮ সালে রিয়েল এস্টেট ও মর্টগেজ ব্যবসায় জালিয়াতি প্রতারণার কারণে বড় ধরনের আর্থিক মন্দায় পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। অসংখ্য মানুষের হাত ছাড়া হয়ে যায় ঘর-বাড়ি। অনেকটাই ভেঙ্গে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে। প্রায় এক দশক লেগে যায় হাউজিং খাতের এ ধকল কাটিয়ে উঠতে। অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রিয়েল এস্টেট ব্যবাসয়ী, মর্টগেজ-ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট মহল হাউজিং খাতে আরো একটি মন্দাবস্থার আশঙ্কা করছেন। বিশেষ করে করোনা মহামারির পর যুক্তরাষ্ট্রে চলমান মূল্যস্ফীতি যা গত চার দশকের মধ্যে নজিরবিহীন এবং অর্থনীতিতে অস্থিরাবস্থা রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় বড় ধরনের আশঙ্কা করছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির হার এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। ফলে গ্যাস ও অন্যান্য বিলে বাড়তি অর্থ প্রদান করতে হচ্ছে ভোক্তাদের। তাতেই অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে পড়ে গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ ও স্বল্প আয়ের নাগরিকরা। এ অবস্থায় দেশটির জেনারেশন জেড ভোক্তা এবং যাদের ক্রেডিট স্কোর কম রয়েছে তারা ক্রেডিট কার্ড ও অটো লোন বিলের ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে পড়ছেন। সেই সঙ্গে তারা যে গতিতে ক্রেডিট কার্ডের ঋণ জমা করছেন, তা মহামারীর আগে কখনো দেখা যায়নি। ২৫ বছর বা তার কম বয়সীদের ক্রেডিট কার্ডের ব্যালান্স আগের বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের তুলনায় বেড়েছে ৩০ শতাংশ।
যেটা বৃহত্তর জনসংখ্যার ক্ষেত্রে বেড়েছে মাত্র ১১ শতাংশ। ক্রেডিট স্কোর কোম্পানি ভিনটেজস্কোরের করা যুক্তরাষ্ট্রের ১ কোটি ২৫ লাখ নমুনার র্যানডম স্যাম্পলিংয়ে এ তথ্য উঠে এসেছে। নন-প্রাইম ঋণগ্রহীতাদের জন্য ব্যালান্স অথবা যেসব ব্যক্তির ক্রেডিট স্কোর ৬৬০-এর নিচে তাদেরও এ সময়ে বেড়েছে ২৫ শতাংশ। ক্রেডিট কার্ডের ঋণ পরিশোধ ধীর হয়ে গিয়েছে। এটা মহামারীর প্রথম বছরে ভোক্তাদের ঋণ পরিশোধ এবং আরো বেশি মিতব্যয়ী হওয়ার প্রচেষ্টার সঙ্গে বেশ বিপরীত বলেই মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা গত দুই বছরের মধ্যে একটু ধীরগতিতে ব্যয় বৃদ্ধি করছে। কেননা অর্থনীতি দ্বিতীয় প্রান্তিকে কিছুটা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। কিছু কিছু পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তাদের বিবেচনামূলক খরচ কমাতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে ওয়ালমার্ট ইনক এবং প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল কোম্পানির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। মূল্যস্ফীতি এমনই থাকলে ক্রেডিট কার্ডের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার হার বেড়ে ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে দাঁড়াতে পারে ৮ দশমিক ৪ শতাংশে। যেটা চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে থাকা ৮ শতাংশের থেকে বেশি। সবকিছু মিলিয়ে এ বছরের শেষ এবং আগামী বছরের শুরুতে এই মন্দাবস্থা ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।
Posted ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh