ইকবাল কবীর মোহন | রবিবার, ৩০ আগস্ট ২০২০
ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। ইসলামী পরিভাষায় আরবি বর্ষপঞ্জি হিজরি সনের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলে। আশুরা শব্দটি আরবি ‘আশারা’ থেকে এসেছে। এর অর্থ দশ। আর আশুরা মানে দশম। অন্য কথায় বলতে গেলে- এ মাসের ১০ তারিখ ১০টি বড় বড় ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কারণেও এ তারিখকে আশুরা বলা হয়। সৃষ্টির পর থেকে আশুরার দিনে অনেক তাৎপর্যমণ্ডিত ঘটনা ঘটেছে বিধায় এই দিনের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য অনেক বেশি। এ কারণে মহররম মাসও গুরুত্বপূর্ণ।
হাদিস শরিফে চন্দ্রবর্ষের ১২ মাসের মধ্যে মহররমকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা আল্লাহর মাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কালামে পাকেও মহররম মাসকে অতি সম্মানিত মাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা তাওবার ৩৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে মাস গণনায় মাস ১২টি, তন্মধ্যে চারটি মাস নিষিদ্ধ মাস, এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান।’ এই আয়াতে ‘আরবায়াতুন হুরুম’ মানে অতি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ চার মাস বোঝানো হয়েছে। এই মাসগুলো হলো- জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। এই চার মাসের মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের কারণে তখন যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ করা হয়। শত্রু-মিত্র-নির্বিশেষে সবাই এই চার মাসের মর্যাদা রক্ষা করে যুদ্ধ-কলহ থেকে দূরে থাকত।
আশুরার দিন বা মহররমের ১০ তারিখ যেসব তাৎপর্যময় ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল, সংক্ষেপে সেগুলো হলো :
১. এ দিনে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবী সৃষ্টি করেন। আর এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে।
২. এ দিনে হজরত আদম (আ.) বেহেশত থেকে দুনিয়ায় নেমে আসেন। মহররমের ১০ তারিখে আল্লাহ পাক আদম (আ.)-এর দোয়া কবুল করেন এবং এ দিনে তিনি স্ত্রী হাওয়া (আ.)-এর সঙ্গে আরাফার ময়দানে সাক্ষাৎ করেন।
৩. হজরত নুহ (আ.)-এর জাতির লোকেরা আল্লাহর গজব মহাপ্লাবনে নিপতিত হওয়ার পর ১০ মহররম তিনি নৌকা থেকে ঈমানদারদের নিয়ে দুনিয়ায় অবতরণ করেন।
৪. হজরত ইবরাহিম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ৪০ দিন পর ১০ মহররম সেখান থেকে মুক্তি লাভ করেন।
৫. হজরত আইয়ুব (আ.) ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগ করার পর মহররমের এ দিনে আল্লাহর রহমতে সুস্থতা লাভ করেন।
৬. হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.) তাঁর ১১ ভাইয়ের ষড়যন্ত্রে কূপে পতিত হন এবং এক বণিক দলের সহায়তায় মিসরে গিয়ে হাজির হন। তারপর আল্লাহর বিশেষ কুদরতে তিনি মিসরের প্রধানমন্ত্রী হন। ৪০ বছর পর ১০ মহররম পিতার সঙ্গে মিলিত হন।
৭. হজরত ইউনুস (আ.) জাতির লোকদের প্রতি হতাশ হয়ে নদী অতিক্রম করে দেশান্তরিত হওয়ার সময় নদীর পানিতে পতিত হন এবং মাছ তাঁকে গিলে ফেলে। মাছের পেট থেকে তিনি আল্লাহর রহমতে ৪০ দিন পর মুক্তি পান ১০ মহররম তারিখে।
৮. হজরত মুসা (আ.) ফেরাউনের অত্যাচারের কারণে তাঁর দলবলসহ অন্যত্র চলে যান। পথিমধ্যে নীল নদ পার হয়ে তিনি ফেরাউনের হাত থেকে আশুরার দিন মুক্তি পান। আর ফেরাউন তার দলবলসহ নীল নদের পানিতে ডুবে মারা যায়।
৯. হজরত ঈসা (আ.)-এর জাতির লোকেরা তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করলে মহররমের ১০ তারিখ আল্লাহ পাক তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নিয়ে মুক্তি দান করেন।
১০. মহররম মাসের ১০ তারিখ কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার অবতারণা হয়। এদিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ইমাম হোসাইন কারবালা প্রান্তরে শাহাদাতবরণ করেন।
ইসলামের ইতিহাসে ওপরে উল্লিখিত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাগুলো মহররম মাসে সংঘটিত হওয়ার কারণে এ মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ মাস অতি সম্মানিত, বরকতময় ও তাৎপর্যপূর্ণ। আশুরার এ দিনে অনেক আম্বিয়ায়ে কেরাম আল্লাহ পাকের সাহায্য লাভ করেন এবং কঠিন বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি লাভ করেন। এই সাহায্যের শোকরিয়া হিসেবে নবী-রাসুলগণ ও তাঁদের উম্মতরা এ দিনে রোজা পালন করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) মদিনায় এসে দেখেন, ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা পালন করছে। তিনি জানতে পারলেন, এ দিনে মুসা (আ.) তাওরাত কিতাব লাভ করেন। এ দিনে তিনি ও তাঁর জাতির লোকেরা নীলনদ পার হয়ে ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্তি লাভ করেন। তাই এর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য মুসা (আ.)-এর অনুসারী ইহুদিরা এ দিন রোজা রাখে। তখন মহানবী (সা.) ইহুদিদের লক্ষ্য করে বলেন, তোমাদের চেয়ে মুসা (আ.)-এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অধিকতর বেশি। সে হিসেবে এ ব্যাপারে আমরাই এর বেশি হকদার।’ তখন থেকে মহানবী (সা.) নিজেও আশুরার রোজা পালন করতেন এবং উম্মতকেও তা পালনের নির্দেশ দিলেন।’ (মিশকাত শরিফ)
তবে মহানবী (সা.) ১০ মহররমের সঙ্গে ৯ বা ১১ মহররম মিলিয়ে দুটি রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিস শরিফে আছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘আশুরার রোজা রাখতে হলে, তার আগে বা পরেও একটি রোজা রাখবে। কারণ এটি যেন ইহুদিদের অনুকরণে না হয়।’ (মুসলিম শরিফ)
অন্য আরো হাদিস থেকে উম্মতকে আশুরার রোজা পালনে মহানবী (সা.)-কে উৎসাহিত করতে দেখা যায়। একবার কয়েকজন সাহাবি মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, ইহুদি ও খ্রিস্টানরা আশুরাকে বড় মনে করে। আমরা কেন এটিকে বড় মনে করব। উত্তরে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘আগামী বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকলে আমি মহররমের ৯ তারিখেও রোজা পালন করব।’
হাদিস শরিফে আরো আছে, ‘আশুরার দিন যে ব্যক্তি নিজের পরিবারবর্গকে পরিতৃপ্ত করে খেতে ও পরতে দেবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে সারা বছর পরিতৃপ্তিসহকারে খেতে ও পরতে দেবেন।’ (বায়হাকি)
বুখারি শরিফের বর্ণনা মতে, মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন রোজা পালন করা পূর্ববর্তী উম্মতদের ওপর ফরজ ছিল। বিশেষত আশুরার দিন পূর্ববর্তী উম্মতরা রোজা পালন করতেন। কিন্তু রমজানুল মোবারকের রোজা ফরজ হওয়ার পর এর ফরজিয়াত রহিত হয়ে যায়। ফলে এরপর থেকে মহানবী (সা.) আশুরার রোজা পালনের জন্য সাহাবিদের আদেশ করতেন না, নিষেধও করতেন না। তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আশুরার রোজা রাখতেন। মহানবী (সা.) আশুরার ফজিলত সম্পর্কে বলেন, ‘রমজানের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা হলো মহররমের রোজা।’ (মিশকাত শরিফ)
আশুরার রোজার গুরুত্ব সম্পর্কে অন্য এক হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী, আল্লাহ তায়ালা এর অসিলায় অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (তিরমিজি শরিফ)
আল্লাহর রাসুল (সা.) আশুরার রোজাকে অনেক গুরুত্ব দিতেন। এ প্রসঙ্গে হজরত হাফসা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) চারটি কাজ কখনো ত্যাগ করেননি। এই চারটি কাজ হলো : ১. আশুরার রোজা, ২. জিলহজের প্রথম ৯ দিনের রোজা, ৩. আইয়ামে বিজের রোজা- অর্থাৎ প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা এবং ৪. ফজর ওয়াক্তে ফরজের আগে দুই রাকাত সুন্নাত নামাজ।
ওপরের আলোচনা থেকে আমরা আশুরার দিনে সংঘটিত কতগুলো ঐতিহাসিক ঘটনার কারণে আশুরার গুরুত্ব ও ফজিলত জানতে পারলাম। তবে এসব ঘটনার কোনো-কোনোটির বর্ণনা সূত্রের নির্ভরযোগ্যতা বিষয়ে কারো কারো দ্বিমত আছে। কিন্তু এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই যে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে এই দিনটি মহিমান্বিত ও তাৎপর্যময়। এ দিনটিকে মুসলমানরা পবিত্র ও বরকতময় হিসেবে পালন করছেন। কিন্তু অতীতের সব ঘটনা ছাপিয়ে ৬১ হিজরি সনের ১০ মহররম এমন একটি দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার অবতারণা হয়, যার কাছে সব ঘটনা ম্লান হয়ে যায়। ফলে এ দিনটি অনন্য ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের রূপ নেয়। ১০ মহররম মহানবী (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, খাতুনে জান্নাত হজরত ফাতেমা (রা.)-এর কলিজার টুকরা হজরত হোসাইন (রা.) কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে অত্যন্ত নির্মম ও নৃশংসভাবে শাহাদাতবরণ করেন। ঐতিহাসিক ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত কারবালার ঘটনা ইসলামের ইতিহাসের সব ঘটনাকে অতিক্রম করে একটি শোকাবহ স্মৃতি নিয়ে আজও মুসলমানদের বুক বিদীর্ণ করছে।
স্মরণকালের ইতিহাসে কারবালার দুঃখজনক ঘটনার সঙ্গে আশুরার সম্পর্ক যেন একাকার হয়ে গেছে। এদিন থেকে আশুরা নতুন এক আঙ্গিক লাভ করেছে। মহররম ও আশুরা এখন অন্য রকম এক চেতনা নিয়ে পালিত হচ্ছে। মহররম মাস ও আশুরার দিন এখন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ত্যাগ, শক্তি ও প্রতিবাদের কথা। কারবালার মর্মান্তিক স্মৃতি থেকে মুসলমানরা শুধু শোকের আবহই লাভ করছেন না, তাঁরা জুলুম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ারও চেতনা খুঁজে পাচ্ছেন। মহররম ও আশুরা আমাদের ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হতে শেখায়। সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অসত্য ও অন্যায়কে প্রতিরোধ করার সাহস জোগায়। আশুরা আমাদের আল্লাহর ওপর ভরসা করে জুলুমের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে।
আসুন, পবিত্র মহররম মাস ও আশুরার দিনে (১০ মহররমের আগে বা পরে এক দিনসহ) আমরা রোজা রেখে আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণ লাভ করার সুযোগ গ্রহণ করি। বেশি বেশি তাওবা-ইস্তেগফার ও দান-খয়রাত করে এবং পরিবার-পরিজনের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করে গুনাহ থেকে মাফ পাওয়ার চেষ্টা করি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মহররম ও আশুরা থেকে আমাদের অফুরন্ত ফজিলত দান করুন। আমিন!
লেখক : শিশুসাহিত্যিক, কবি, প্রবন্ধকার ও ঊর্ধ্বতন ইসলামী ব্যাংকার।
Posted ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ৩০ আগস্ট ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh