মোহাম্মদ আজাদ : | বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর ২০২০
নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে তার কেবিনেট গঠন করছেন এবং বেশ চরম সৃষ্টি করছেন। কেবিনেটে থাকতে পারেন এমন যেসব নাম প্রথম দিকে শোনা গিয়েছিল তারা সকলেই বাদ পড়েছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ সেক্রেটারী অফ ষ্টেট হিসেবে নাম এসেছিল ডেলাওয়ারের সিনেটর ক্রিস কুনের। এরপর শোনা যায় কানেকটিকাটের সিনেটর ক্রিস মার্কিও নাম। অতপর আরো জোরালোভাবে আলোচনায় আসে ওবামা প্রশাসনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজার সুজান রাইসের নাম। কিন্তু এ তিনজনকে বাদ দিয়ে জো বাইডেন গত রোববার সেক্রেটারী অফ ষ্টেট পদে এন্টনি ব্লিংকেনের নাম ঘোষণা করে রীতিমত চমক সৃষ্টি করেছেন। ইহুদি ধর্মাবলম্বী এন্টনি ব্লিংকেন পড়াশোনা করেছেন হার্ভার্ড ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্লিনটন প্রশাসনে তিনি সর্বূপ্রথম ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের চাকুরিতে যোগ দেন।
এরপর তিনি সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটিতে জো বাইডেনের উপদেষ্টা ছিলেন। এরপর তিনি দায়িত্ব পালন করেন জো বাইডেনের প্রেসিডেন্সিয়াল ষ্টাফ হিসেবে, যেখানে তার কাজ ছিল বাইডেনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজারের কাজ করঅ। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রিন্সিপাল ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজার ছিলেন। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি ডেপুটি সেক্রেটারী অফ ষ্টেট পদে নিযুক্ত ছিলেন। এন্টনি ব্লিংকেন জো বাইডেনের ঘনিষ্ট সহযোগী হওয়া ছাড়াও একজন আইনবিদ। সিনেট শুনানিতে এন্টনি ব্লিংকেনর নাম চূড়ান্ত করা হলে তিনি হবেন হেনরি কিসিঞ্জার ও মেডেলিন অলব্রাইটের পর তৃতীয় ইহুদি সেক্রেটারী অফ ষ্টেট।
গত সোমবার নিউইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে সেক্রেটারী অফ ষ্টেট পদে সুজান রাইস এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু সিনেটে যখন ভোট হবে তখন সুজানের সংকটে পড়ার আশংকা রয়েছে বলে বাইডেন এন্টনি ব্লিংকেনের নাম ঘোষণা করেন। সিনেটে ব্লিংকেন সহজে পার পেয়ে যাবেন বলে বাইডেন আশা করছেন।ডিপার্টমেন্ট অফ হোমল্যাণ্ড সিকিউরিটি পদে ঘোষণা করেছেন আলেজান্দ্রো মায়োরকাসের নাম, যা আরও একটি চমক। কারণ আলোজান্দ্রো মায়োরকাস কিউবায় জন্মগ্রহণ করেছেন ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি হোমল্যাণ্ড সিকিউরিটির ডেপুটি সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সিনেট তার মনোনয়ন চূড়ান্ত করলে তিনিই হবেন এই স্পর্শকাতর বিভাগের প্রথম কোন ল্যাটিনো সেক্রেটারী অফ ষ্টেট। এছাড়া জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে নাম ঘোষণা করা হয়েছে পেশাদার কূটনীতিক লিন্ডা থমাস গ্রিনফিল্ডের। তিনি দীর্ঘ ৩৫ বছর যাবত ষ্টেট ডিপার্টমেন্টে কাজ করছেন। সাবেক সেক্রেটারী অফ ষ্টেট জন কেরির নাম ঘোষণা করা হয়েছে জো বাইডেনের জলবায়ু বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে। ওবামা প্রশাসনে তিনি সেক্রেটারী অফ ষ্টেট ছিলেন । দীর্ঘদিন তিনি সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০০৪ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন। তার নিয়োগে সিনেটের অনুমোদন লাগবে না।
অর্থনীতিবিদ ও ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের সাবেক চেয়ারপার্সন জ্যানেট ইয়েলেনকে জো বাইডেন ট্রেজারি সেক্রেটারী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তার মনোনয়ন সিনেটে চূড়ান্ত হলে তিনিই হবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কোন মহিলা ট্রেজারি সেক্রেটারী। এভ্রিল হাইন্সের নাম ঘোষণা করা হয়েছে ডাইরেক্টর অফ ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স হিসেবেএর আগে এভ্রিল হাইন্স ওবামা প্রশাসনে ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজার ছিলেন। তিনি জো বাইডেনের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেন। সিনেট অনুমোদন করলে তিনি হবেন ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের প্রথ মহিলা ডাইরেক্টর। জ্যাক সুলিভানের নাম প্রকাশ করা হয়েছে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজার হিসেবে। এই পদে নিয়োগের জন্য সিনেটের অনুমোদন প্রয়োজন পড়ে না। এছাড়া তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ হচ্ছে এটর্নি জেনারেল বা আইনমন্ত্রীর পদ। এই পদে জো বাইডেন এখ নপর্যন্ত কারো নাম ঘোষণা করেননি। এছাড়া বাইডেনের ক্যাবিনেটে সিনেটর বার্নি স্যাণ্ডার্স, সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন ও নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র মাইকেল এখন ব্লুমবার্গের নামও শোনা গিয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের কারো নাম কেবিনেট সদস্য হিসেবে ঘোষণ করা হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র আবার বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে, বাইডেন : বয়স তার ৭৮ বছর। এ বয়সের ভারে মানুষকে ন্যুয়ে পড়ার কথা। কিন্তু জো বাইডেন এই ন্যুয়ে পড়াদের দলের নন। বলিষ্ঠ যুবকের মতো কথা বলেন। কোন রাখঢাক রাখেন না। দৃপ্ত কণ্ঠ তার। সেই কণ্ঠে জোর দিয়ে বললেন, যুক্তরাষ্ট্র তার আগের জায়গায় ফিরবে। যুক্তরাষ্ট্র আবার বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে। সেখান থেকে কোনোভাবেই পিছপা হবে না। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি। নিজের রাজ্য দেলাওয়ারের উইলমিংটনে বক্তব্যে তিনি আবারো মিত্রদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার প্রত্যায় ঘোষণা করলেন। ঘোষণা করলেন তার প্রশাসনিক টিমের অতি গুরুত্বপূর্ণ ৬টি পদে মনোনীতদের নাম। তারা হলেন তার সরকার পরিচালনার অতি গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। এই ব্লিঙ্কেন এই মধ্যে বলেছেন, অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের যে অবনমন সৃষ্টি হয়েছে তা পুনঃস্থাপন করবেন এবং আস্থা ফিরিয়ে আনবেন খুব শিগগিরই।
জলবায়ু পরির্বতন বিষয়ক দূত হিসেবে বাইডেন মনোনয়ন দিয়েছেন আরেক ঝানু রাজনীতিক জন কেরিকে। জন কেরি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় পরিচিত মুখ। তিনি একবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু হেরে গেছেন রিপাবলিকান প্রার্থী জর্জ ডব্লিউ বুশের কাছে। প্যারিস জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক যে চুক্তি আছে, তার শীর্ষ স্থানীয় রূপকারদের মধ্যে তিনি অন্যতম। এই চুক্তি থেকে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। জন কেরি বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের যে সঙ্কট বিরাজমান তার শেষ হওয়া উচিত এবং এ জন্য বিশ্বকে অবশ্যই একত্রিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত জো বাইডেন ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক হিসেবে এভরিল হেইন্সকে মনোনয়ন দিয়েছেন।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সেক্রেটারি হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন আলেজান্দ্রো মায়োরকাসকে। তিনি বলেছেন, তার মন্ত্রণালয় আদর্শ মিশন পরিচালনা করবে। যুক্তরাষ্ট্রকে নিরাপদ রাখতে সহায়তা করবে। যুক্তরাষ্ট্রের গর্বিত ইতিহাসকে সামনে এগিয়ে নেবে। হোয়াইট হাউজের ন্যাশনাল সিকিউরিটি উপদেষ্টা হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন জ্যাক সুলিভান। তিনি তার বস জো বাইডেনের প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, রাষ্ট্র পরিচালনার অনেক কিছু তিনি তার কাছ থেকে শিখেছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মানুষের প্রকৃতি। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের দূত হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ডকে। তবে নানা জল্পনা থাকা সত্ত্বেও তিনি কিন্তু ফেডারেল রিজার্ভের সাবেক প্রধান জ্যানেট ইয়েলেনের নাম ঘোষণা করেননি। আলোচনা ছিল তাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হতে পারে। তেমনটা হলে জ্যানেট ইয়েলেন হবেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম কোনো নারী অর্থমন্ত্রী। তবে সময় এখনও শেষ হয়ে যায় নি।
উল্লেখ্য, নিজে সবচেয়ে বেশি বয়সী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে জো বাইডেন যেমন ইতিহাস রচনা করেছেন, তেমনি তিনি তার মন্ত্রীপরিষদে মনোনয়নের মাধ্যমেই ইতিহাস রচনা করেছেন। ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে তিনি মনোনয়ন দিয়েছেন এভরিল হেইন্সকে। একই সঙ্গে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির প্রধান হিসেবে প্রথম ল্যাতিনো আলেজান্দ্রো মায়োরকাসকে মনোনয়ন দিয়েছেন।
ওদিকে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হওয়া উচিত বলে সম্মতি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু তিনি নিজে এখনও পরাজয় স্বীকার করে নেননি। জো বাইডেনকে বিজয়ী বলে স্বীকৃতি দেননি। আবার তিনি ভোটের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। ফলে তিনি কখন কি বলছেন, কি করছেন তা বোঝা খুব কঠিন। অনেকে বলাবলি করছেন, এখনও তার ক্ষমতার মেয়াদ দু’মাসের মতো আছে। এ সময়ে তিনি কোনো স্যাবোটাজ করে না বসেন! যদি এমনটা করেন, তাহলে তা জো বাইডেনের জন্য বিব্রতকর হতে পারে। তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় সম্মতি দেয়ার পর এখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত জো বাইডেনকে দেশের শীর্ষ গোপন গোয়েন্দা তথ্যের বিষয়ে নিয়মিত ব্রিফ করার কথা। তার অন্তর্র্বতী প্রশাসন চালানোর জন্য জিএসএ থেকে ৬৩ লাখ ডলার দেয়ার কথা বলেছেন এর প্রধান এমিলি।
পররাষ্ট্র নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের ইঙ্গিত বাইডেনের : ক্ষমতায় এসে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে পারেন বাইডেন। গত ২৪ নভেম্বর তার প্রশাসনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম ঘোষণা করেছেন তিনি। যে নামগুলো সামনে এসেছে, তার মধ্যে বেশ কিছু চমক আছে। পাশাপাশি বাইডেন জানিয়েছেন, প্রশান্ত মহাসাগর থেকে আটলান্টিক মহাসাগর- পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনবে তার প্রশাসন। আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ প্রধানরা বরাবরই বিশ্বের নেতা হয়ে উঠেছেন। বাইডেনও সে পথেই হাঁটতে চান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন করে তৈরির প্রসঙ্গেও আলোচনা করেছেন বাইডেন। এবং সে কাজে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ব্লিনকেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেন বলেই মনে করা হচ্ছে। বস্তুত, গত ২৩ নভেম্বরই জার্মানিতে বৈঠকে বসেছিলেন যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। বাইডেনের আমলে আমেরিকার ইরান নীতি কী হবে এবং কীভাবে পরমাণু ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হবে, তা নিয়ে আলোচনা করেছেন তারা। বোঝাই যাচ্ছে, ক্ষমতায় এসে এই বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেবেন বাইডেন।
তবে গত ২৪ নভেম্বর এক সাক্ষাৎকারে বাইডেন জানিয়েছেন, আপাতত তার প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য করোনা সংকট থেকে দেশকে উদ্ধার করা। সেজন্য প্রথমেই টাস্ক ফোর্স তৈরি করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। এদিকে জিএসএ সম্মতি দেওয়ার পর গত ২৪ নভেম্বর থেকেই নিরাপত্তা সংক্রান্ত গোপন তথ্য তার কাছে আসতে শুরু করেছে। আর্থিক বিষয়েও রিপোর্ট পেতে তিনি শুরু করেছেন। বাইডেনের অফিসের সূত্র জানাচ্ছে, সব ঠিক থাকলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেতে পারেন জানেট ইয়েলেন। যদিও এখনো তার যোগদানের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি।
Posted ৯:৫৪ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh