বিশেষ প্রতিবেদন : | শুক্রবার, ১১ জুন ২০২১
নির্বাচন মানেই টাকার খেলা। সাদা কালো টাকার ছড়াছড়ি। গণতন্ত্রের ভিত দুর্বল এমন দেশগুলোতে টাকার খেলা জমে উঠে নির্বাচনকে ঘিরে। টাকার জোড়ে বদলে যায় ভোট গ্রহণের সময়সূচী। লেনদেন চলে নগদ অর্থের। ভোট কেন্দ্রের আশেপাশে ভোটারদের মুখে ফুঁস করে উঠে ফান্টার বোতল। বিনামূল্যে পরিবেশন করা হয় চা-পান সিগারেট। এসব দেশে টাকার জোড়ে জিতে যায় অযোগ্য প্রার্থীরা। আর এভাবেই রচিত হয় গণতন্ত্রের কবর। অপরদিকে নির্বাচনে টাকার খেলা চলে গণতন্ত্রের পাদপীঠ যুক্তরাষ্ট্রেও। এখানেও নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিযোগিতা চলে অর্থ ব্যয়ের। প্রার্থীরা মরিয়া হয়ে উঠেন ব্যক্তিগত তহবিল সংগ্রহে। তবে এসবকিছুই ঘটে আইনসিদ্ধভাবে এবং সুনির্দিষ্ট ছকে। এজন্য প্রার্থীদেরকে থাকতে হয় স্বচ্ছ। জবাবদিহি করতে হয় নির্বাচন কমিশনের নিকট। নির্বাচনী আয়-ব্যয়ের দিতে হয় চুলচেরা হিসেব।
সম্মুখীন হতে হয় অডিটের। তারপরও কোন কোন প্রার্থী যে টাকা-কড়ি নয়-ছয় করার চেষ্টা করেন না তা হলপ করে বলা যাবে না। নিউইয়র্ক সিটির নির্বাচনেও চলে আসছে টাকার খেলা। তবে এ টাকার খেলা ভিন্ন রকমের। বিশ্বের রাজধানী খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনবহুল সিটি নিউইয়র্কের সাধারণ নির্বাচন আগামী ২ নভেম্বর। এর আগে এ মাসের ২২ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে প্রাইমারী। প্রায় ৮৪ লাখ মানুষের এ নগরীর নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বহুজাতিক সংস্কৃতি সমৃদ্ধ নিউইয়র্ক সিটির বাসিন্দারা এ নির্বাচনে একজন মেয়র, একজন পাবলিক এডভোকেট, একজন কম্পট্রোলার, পাঁচজন বরো প্রেসিডেন্ট ও ৫১ জন কাউন্সিল মেম্বার নির্বাচিত করবেন। ভোটারগণ ১৯৯৩ সালে সিটির জনপ্রতিনিধিদের মেয়াদকাল নির্ধারণ করে দেয়ায় বর্তমান মেয়র সহ ৩৫ জন কাউন্সিল মেম্বার নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারছেন না এবার।
প্রাইমারীতে শুধুমাত্র দলীয় নিবন্ধিত ভোটাররাই ভোট দিতে পারবেন। গত ২৮ মে, ছিলো নিবন্ধনের শেষ তারিখ। আগাম ভোট গ্রহণ শুরু হবে ১২ জুন, শনিবার থেকে। অপরদিকে এ্যাবসেন্টি ব্যালটের জন্য আবেদনের শেষ তারিখ ১৫ জুন। এবারের নির্বাচন হবে সম্পূর্ণ নূতন র্যাঙ্ক চয়েজ পদ্ধতিতে। নূতন এই নিয়মে একজন ভোটার একসাথে ক্রমানুসারে পছন্দানুযায়ী পাঁচজন প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন। যে প্রার্থী ৫০ শতাংশ ভোট পাবেন তিনিই হবেন বিজয়ী। ২২ জুনের প্রাইমারীতে ডেমোক্র্যাট দলীয় বিজয়ীগণ ২ নভেম্বরের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন রিপাবলিকান প্রতিপক্ষের সাথে। তবে ব্লু সিটি নিউইয়র্কের প্রাইমারীতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের বিজয় বরাবরই সুনিশ্চিত করে সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল। প্রাইমারীতে ভোট প্রদানের হার উল্লেখ্যযোগ্য না হলেও এর গুরুত্ব অনেক। ডোমেনিকান রিপাবলিক বা শ্রীলংকার বাৎসরিক বাজেটের চেয়ে বড় বাজেটের নগরী নিউইয়র্ক। বিশ্বের সর্বাধিক বিলিওনিয়ারের বসবাসের এই সিটির নির্বাচনকে ঘিরে তাই স্বাভাবিকভাবেই বিরাজ করছে আমেজ ও উত্তেজনা। যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেননি সিটির এমন ৩২ লাখ বাসিন্দার মনেও লেগেছে নির্বাচনী হাওয়া। প্রার্থী হয়েছেন অনেক ইমিগ্র্যান্ট আমেরিকান। বাংলাদেশী-আমেরিকানরাও পিছিয়ে নেই এ দৌড়ে।
নিউইয়র্ক সিটির জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে চলছে ভিন্ন ধাঁচের টাকার খেলা। “দ্য ক্যাম্পেইন ফাইন্যান্স বোর্ড” সংক্ষেপে সিএফবি এ খেলার আয়োজক এবং রেফারির ভূমিকায় আছে। নিউইয়র্ক সিটির এ প্রতিষ্ঠানটি প্রার্থীদেরকে বড় ধরণের আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য। যা পাবলিক ম্যাচিং ফান্ড নামে পরিচিত। নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহার এবং বিত্তবান-মাফিয়াদের প্রভাব রোধ করতেই ১৯৮৮ সালে গৃহীত হয় এ সিদ্ধান্ত। সাধারণ ভোটারদের ক্ষুদ্র অনুদান গ্রহণকারী যোগ্য প্রার্থীরাই লাভ করে থাকেন এই আর্থিক সুবিধা। ফলে কোন প্রার্থীর কারো প্রতি থাকে না দায়বদ্ধতা। পাবলিক ম্যাচিং ফান্ড নেতিবাচক নয় বরং ইতিবাচক টাকার খেলা। এবারের নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্যাম্পেইন ফাইন্যান্স বোর্ড প্রার্থীদেরকে মোট ৭০ মিলিয়ন ডলার ম্যাচিং ফান্ড দিবে বলে জানা গেছে। ২০০১ সালে প্রদত্ত এ ম্যাচিং ফান্ডের পরিমাণ ছিলো ৩৬মিলিয়ন ডলার। এবারের সিটি নির্বাচন হবে সবচেয়ে বড় এবং প্রতিযোগিতামূলক। সবমিলিয়ে প্রার্থী সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ শতাধিক।
পাবলিক ম্যাচিং ফান্ড : নিউইয়র্ক সিটির নির্বাচনের বিশেষ আকর্ষণ পাবলিক ম্যাচিং ফান্ড। বিত্তবান ও সুবিধাভোগীদের আর্থিক আনুকূল্য না নিয়ে সাধারণ ভোটারদের ক্ষুদ্র অনুদানের অর্থে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর জন্য নিউইয়র্ক সিটির বিশেষ প্রকল্প হচ্ছে পাবলিক ম্যাচিং ফান্ড। সিটি নির্বাচনে প্রার্থীদের অর্থ সংস্থানের জন্য এটি শক্তিশালী একটি প্রকল্প। সিটির বাসিন্দারা মাত্র ১০ ডলার অনুদান দিয়ে তাদের পছন্দনীয় প্রার্থীকে সহযোগিতা করতে পারেন। ম্যাচিং ফান্ডের কারণে সমাজের বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ বিশেষ করে বিত্তহীনরাও হতে পারেন প্রার্থী। নিউইয়র্ক সিটির যেকোন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থী যোগ্য বিবেচিত হলে নিতে পারেন ম্যাচিং ফান্ডের সুবিধা। তবে কাউন্টি ডিস্ট্রিক্ট এটর্নী, স্টেট ও ফেডারেল নির্বাচনে প্রার্থীদের জন্য এই ফান্ড প্রযোজ্য নয়। এজন্য তাদেরকে নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক অনুদানকারী ও নির্ধারিত পরিমাণ অর্থের তহবিল প্রয়োজন হয় ফান্ডের জন্য। আবার কোন প্রার্থী ইচ্ছে করলে ম্যাচিং ফান্ডের অর্থ নাও নিতে পারেন। যেমনটি করতে যাচ্ছেন মেয়র প্রার্থী ওে ম্যাকগুয়ের। ফান্ড পেতে ব্যালটে নাম সংযুুক্তি সহ নিজ আয়-ব্যয়ের হিসেব জমা দিতে হয় প্রার্থীদেরকে। পাবলিক ম্যাচিং ফান্ড গ্রহীতাকে ক্যাম্পেইন ফাইন্যান্স বোর্ডের সকল নিয়ম ও শর্তাদি মেনে অবশ্যই নিয়মানুযায়ী অর্থ ব্যয় করতে হয়। নির্বাচন শেষে উদ্ধৃত্ত অর্থ ফেরত যোগ্য। ম্যাচিং ফান্ডের পুরো বিষয়টি দেখভাল করে নিউইয়র্ক সিটি ক্যাম্পেইন ফাইন্যান্স বোর্ড। পাবলিক ম্যাচিং ফান্ডের অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি প্রার্থীদের নিকট ‘গাঙ্গের পানি গাঙ্গে ঢালা’র মতো অনেকটা। এখানে নির্বাচন করে প্রার্থীদেরকে সহায় সম্বল হারানো বা নিঃস্ব হওয়ার ভয় নেই বাংলাদেশের মতো। প্রার্থীদের পুরো নির্বাচনী ব্যয়ভারই বহন করে স্থানীয় ভোটার ও ক্যাম্পেইন ফাইন্যান্স বোর্ড। আর্থিক ঝুঁকি না থাকার কারণে নির্বাচনে বেড়ে যায় প্রার্থীর সংখ্যা। পাবলিক ম্যাচিং ফান্ডের জন্য কোন গৌরিসেন নেই। এ ফান্ডের পুরো অর্থই জনগণের দেয়া ট্যাক্সের। নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য সংগৃহীত পুরো টাকাকেই সাধারণত: ‘সফট মানি’ বলা হয়ে থাকে।
পাবলিক ফান্ডের ম্যাচিং হার : নিউইয়র্ক সিটির নির্বাচনে মেয়র, পাবলিক এডভোকেট, কম্পট্রোলার, বরো প্রেসিডেন্ট, সিটি কাউন্সিল মেম্বার প্রার্থী সকলেই পাবলিক ম্যাচিং ফান্ড পেয়ে থাকেন। ফান্ডের ম্যাচিং হার সবার জন্য সমান নয়। প্রার্থীর পদবী অনুযায়ী একক অনুদানকারীর অর্থ প্রদানের পরিমাণও ভিন্ন। শুরুতে ম্যাচিং ফান্ডের হার ছিলো কেউ এক ডলার অনুদান সংগ্রহ করলে সিটি কর্তৃপক্ষ তাকে তহবিলে আরো ৬ ডলার যুক্ত করতো। অর্থাৎ প্রার্থীর মোট ফান্ডের পরিমাণ দাঁড়াত ৭ ডলারে। ১৯৮৮ সাল থেকে সর্বশেষ ২০১৭ সালের নির্বাচন পর্যন্ত এই রীতিই চালু ছিলো। এ বছর থেকে ম্যাচিং ফান্ডের হার ৬ থেকে বেড়ে ৮ ডলারে দাঁিড়য়েছে। গত ফেব্রুয়ারির স্পেশাল নির্বাচনে এটি কার্যকর হয়। ২০১৯ সালে সিটি কাউন্সিল এ বিষয়ে অনুমোদন দিলে তা পরিণত হয় আইনে। নূতন এই আইনে কোন প্রার্থী ১ ডলার ভোটারের নিকট থেকে সংগ্রহ করলে নিউইয়র্ক সিটি তার তহবিলে এর ৮ গুণ অর্থ সংযোজন করবে। ফলে তার তহবিল হবে ৯ ডলারের। নিউইয়র্ক সিটির বাসিন্দাদের নিকট থেকে সংগৃহীত অর্থ প্রার্থীদের নির্বাচনী তহবিল স্ফীত করলেও কমানো হয়েছে একক অনুদানের পরিমাণ। ম্যাচিং ফান্ডের অর্থ প্রাপ্তির বিষয়টিও করা হয়েছে সহজলভ্য। নির্বাচনের আগের বছরের ডিসেম্বর থেকেই যোগ্য প্রার্থীরা সুযোগ পেয়ে থাকেন ম্যাচিং ফান্ড ব্যবহারের। আগের নিয়মে সিটির সকল প্রার্থীর জন্য একক অনুদানের পরিমাণ সীমিত ছিল ১৭৫ ডলার। নতুন আইনে কাউন্সিল মেম্বার প্রার্থীগণ ১৭৫ ডলার এবং বাকি প্রার্থীদের জন্য প্রযোজ্য হবে ২৫০ ডলার।
পদমর্যাদা নির্বিশেষে একজন মেয়র প্রার্থী সর্বোচ্চ ৬৪লাখ ৭৬ হাজার ৪৪৪ ডলার ম্যাচিং ফান্ড পাচ্ছেন। পাবলিক এডভোকেট এবং কম্পট্রোলার পাবেন ৪০লাখ ৪৮ হাজার ৮৮৮ ডলার। প্রত্যেক বরো প্রেসিডেন্টের জন্য রয়েছে ১৪ লাখ ৫৭হাজার ৭৭৭ ডলার। প্রত্যেক সিটি কাউন্সিল মেম্বার সর্বোচ্চ ম্যাচিং ফান্ড পাচ্ছেন ১লাখ ৬৮ হাজার ৮৮৮ ডলার। জনগণের অনুদানেরও রয়েছে সীমাবদ্ধতা। কেউ ইচ্ছে করলে কোন প্রার্থীকে বেশী টাকা দিতে পারবেন না। এক্ষেত্রে মেয়র, পাবলিক এডভোকেট ও কম্পট্রোলার প্রার্থীর সর্বোচ্চ একক অনুদান গ্রহণের পরিমাণ ২ হাজার ডলার। বরো প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ১হাজার ৫শ’ ডলার এবং সিটি কাউন্সিল মেম্বারের জন্য ১হাজার ডলার সীমিত। গত বছরের ডিসেম্বর থেকেই নিবন্ধিত প্রার্থীরা ম্যাচিং ফান্ডের অর্থ উত্তোলন শুরু করেছেন। ডিসেম্বরে ব্যালটে নাম নিবন্ধিতত হয়েছে এমন ৬১জন প্রার্থীকে ১৭.৩ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে ক্যাম্পেইন ফাইন্যান্স বোর্ড। এর মধ্যে আছেন মেয়র প্রার্থী স্কট স্ট্রিংগার ও এ্যারিক অ্যাডামস।
নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের কয়েকটি ডিস্ট্রিক্টে এবার প্রার্থী হয়েছেন এক ডজন বাংলাদেশী-আমেরিকান। এক আসনে একাধিক প্রার্থীও দেখা যাচ্ছে। এসব প্রার্থীর সকলেই সিটির নিয়ম অনুযায়ী পেয়েছেন মোটা অংকের পাবলিক ম্যাচিং ফান্ড। নিয়মানুযায়ী প্রার্থীদের সিংহভাগ অর্থ ব্যয় হয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রোনিক মিডিয়ায় প্রচারণার কাজে। অন্যান্য প্রার্থীরা তাই করছেন। কিন্তু বাংলাদেশী-আমেরিকান প্রার্থীদের কয়েকজন ছাড়া বাকিরা এড়িয়ে চলছেন স্থানীয় বাংলা ভাষার মিডিয়া। যদিও তাদের একমাত্র টার্গেট ও ভরসা বাংলাদেশী আমেরিকান ভোটার। অথচ বাংলা-ভাষী ভোটারদের নিকট পৌছাতে স্বদেশী মিডিয়ায় কোন বিকল্প নেই। ফলে তাদের টাকার খেলা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে কমিউনিটিতে। অনেক প্রার্থী নিজেদের মধ্য থেকে কর্মী নিয়োগ দিয়ে সেক্ষেত্রেই অর্থ ব্যয়ে মনোযোগী হয়েছেন বলে জানা গেছে। সিটি কাউন্সিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী এক ডজন প্রার্থী ম্যাচিং ফান্ড থেকে প্রায় ২মিলিয়ন ডলার পেয়েছেন নির্বাচনী প্রচারণার জন্য। তারপরও অন্য জাতিগোষ্ঠীর প্রার্থীদের প্রচারণার তুলনায় এসব প্রার্থী অনেক পিছিয়ে আছে।
Posted ৪:৪২ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ১১ জুন ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh