ঢাকা | শুক্রবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
ছবি: সংগৃহীত
দেশ থেকে যত অর্থ পাচার হয়েছে তার ৮০ শতাংশই হয়েছে ব্যাংকের মাধ্যমে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৪ হাজার ১০৬টি সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব লেনদেনে অর্থের পরিমাণ ছিল ২২ লাখ ৮৫ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি। একই অর্থবছরে অর্থ পাচারের ৫৯টি মামলা হয়েছে। এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ)’র বার্ষিক প্রতিবেদনে।
গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিএফআইইউর প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাস। উপস্থিত ছিলেন উপপ্রধান মো. রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র মো. সরোয়ার হোসেনসহ বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউর সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা। সংবাদ সম্মেলনে বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, মানি লন্ডারিংয়ের ৮০% হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংক যদি এটি বন্ধে সহযোগিতা না করে তাহলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কারণ একবার মানি লন্ডারিং হয়ে গেলে তা ফেরত আনা যায় না। এসময় তিনি জানান, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা ও সহযোগিতার জন্য ১০ দেশের সঙ্গে এমওইউর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকগুলো মোট ৩ কোটি ৮৬ লাখ নগদ লেনদেনের তথ্য জমা দিয়েছে। এসব লেনদেনে অর্থের পরিমাণ ছিল ২২ লাখ ৮৫ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ২১০ কোটি টাকা লেনদেনের ১ হাজার ২৩৮টি নগদ লেনদেনের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
প্রকাশিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বছরের ব্যবধানে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৬৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ ৫ হাজার ৫৩৫টি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ ধরনের লেনদেনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ১০৬টিতে। এসব সন্দেহজনক লেনদেনের মধ্যে ১২ হাজার ৮০৯টি হয়েছে ব্যাংকের মাধ্যমে, ৯০১টি মানি রেমিটারে এবং ১২১টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এনবিএফআই) হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৮ হাজার ৫৭১টি। বিএফআইইউর প্রধান বলেন, সব সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) অপরাধ নয়। লেনদেন সন্দেহজনক হলে তদন্ত করি। যদি কোনো অপরাধের তথ্য-প্রমাণ?মিলে তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই। এ সময় তিনি জানান, বিএফআইইউর তথ্যের ভিত্তিতে অর্থ পাচারের মামলা হয়েছে ৫৯টি। এর মধ্যে দুদক মামলা করেছে ৪৭টি, সিআইডি ১০টি এবং এনবিআরের বিশেষ সেল ২টি। এগুলো এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিএফআইইউয়ের কাছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের বিভিন্ন দফতর, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ১ হাজার ৭৫ বার আর্থিক তথ্য পাওয়ার আবেদন করেছে। মুদ্রা পাচারের মতো সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য দেওয়ার হারও বেড়েছে। গত অর্থবছরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কাছে ৯০ বার তথ্য চেয়েছে বিএফআইইউ।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার এবং তা বিদেশ থেকে ফেরত আনা প্রসঙ্গে গত মাসে (জানুয়ারি ২০২৪) ডয়েচে ভেলের সঙ্গে কথা বলার সময় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সরকার আন্তরিক হলে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব, তার উদাহরণ তো আমাদের আছে। কিন্তু সরকার আন্তরিক কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন। আমাদের সংসদে এখন ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য। ফলে তাদের বিরুদ্ধে কিভাবে ব্যবস্থা হবে? উদ্যোগটা নেবেই বা কে?” স্বাধীনতার পরের অর্থবছর থেকে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৪ লাখ কোটি টাকা পাচার হওয়ার এক হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। গত বছরের মে মাসে বিকল্প বাজেট উপস্থাপনকালে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাত এত বিপুল অর্থ পাচার হয়েছে বলে দাবি করেন। সমিতির হিসাবে ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত পাচার হওয়া অর্থের ৫ শতাংশ উদ্ধার করা গেলেও সরকার ৫৯ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা পাবে। দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ উদ্ধারের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান উৎস হতে পারে কালো টাকা ও অর্থপাচারের ওই খাত- এমন মন্তব্যও করেন এই অর্থনীতিবিদ।
ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, পাচার করা অর্থের পরিমাণ আরও বেশি হবে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্ক (টিজেএন) বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বছরে কর ফাঁকি দিয়ে যে পরিমাণ অর্থ করস্বর্গখ্যাত দেশগুলোতে পাচার হয়, তার পরিমাণ ৪২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার।
ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যান্ড কমব্যাটিং ফিনান্স অব টেরোরিজম নামের প্রথম কৌশলপত্রটি ছিল ২০১৫-২০১৯ সময়ের জন্য। আর পরেরটি ২০১৯-২১ সময়ের। সর্বশেষ কৌশলপত্রেই বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে এ রকম ১০টি দেশ বা অঞ্চলের নাম দেওয়া হয়েছে। নতুন কৌশলপত্র এখনো তৈরি করা হয়নি। কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, বিভিন্ন গবেষণা ও অবৈধ অর্থ প্রবাহের ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে, ১০টি দেশ বা অঞ্চলেই বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়। এই ১০ দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ক্যানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেম্যান আইল্যান্ড ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস।
রপ্তানির আড়ালে ৮২১ কোটি টাকা পাচার?: তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে ৩৩টি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের ৮২১ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। দেশের সবচেয়ে বড় অর্থপাচার কেলেঙ্কারির অন্যতম এই ঘটনা কিছুদিন আগে উদ্ঘাটন হলেও এসব পণ্য রপ্তানি হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর জানিয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান ১৩ হাজার ৮১৭টি চালানে ৯৩৩ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে এনেছে মাত্র ১১১ কোটি টাকা। বাকি ৮২১ কোটি টাকা সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, ক্যানাডাসহ ২৫টি দেশে পাচার করতে ভুয়া রপ্তানি নথি ব্যবহার করেছে প্রতারকচক্র। এসব পণ্য রপ্তানি করতে পণ্যের প্রকৃত দামের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ কম মূল্য দেখানোর পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যকে ‘নমুনা’ পণ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। নমুনা পণ্য হিসেবে দেখানোর কারণে এসব পণ্যের বিপরীতে দেশে কোনো টাকা আসেনি।
হুন্ডির মাধ্যমে বছরে পাচার ৭৫ হাজার কোটি: মোবাইলে ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ব্যবহার করে এক বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়। ২০২২ সালে এই তথ্য তুলে ধরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেছেন, গত কয়েক বছরে ব্যাংকিং চ্যানেল বহির্ভূত অবৈধভাবে মোবাইল ব্যাংকিং হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায়, দেশের প্রবাসী আয়ের তুলনামূলক কিছুটা হলেও ভাটা পড়ে। হুন্ডি বন্ধে সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে বন্ধ করা যাচ্ছে না। উল্টো দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। এমন অবস্থায় দেশে ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণ তদন্ত করতে গিয়ে এই পাচারকারী চক্রের সন্ধান পায় সিআইডি
Posted ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh