বাংলাদেশ ডেস্ক | বুধবার, ১৩ মার্চ ২০২৪
ভারত মহাসাগর অতিক্রম করার সময় সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়েছে ২৩ জন বাংলাদেশি নাবিকসহ বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ। জাহাজটি চট্টগ্রামের শিল্প গ্রুপ কবির স্টিল অ্যান্ড রি-রোলিং মিলসের (কেএসআরএম) মালিকানাধীন। জিম্মি এক নাবিকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে ওই সময় সাগরে চলাচলকারী আরেকটি জাহাজে কর্মরত এক বাংলাদেশি নাবিক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানিয়েছেন, অন্তত ৫০ জন জলদস্যু এই ডাকাতিতে অংশ নিয়েছে।
সাগরপথে আন্তর্জাতিক রুটে জাহাজ পরিচালনার ব্যবসায় দীর্ঘদিন ধরে জড়িত চট্টগ্রামের এই শিল্প গ্রুপটি। তাদের বহরে ২৩টি জাহাজ রয়েছে। গত বছর এমভি আব্দুল্লাহ কেএসআরএম গ্রুপের মালিকানায় স্থানান্তরিত হয়। এর আগে জাহাজটি ‘গোল্ডেন হক’ নামে পরিচিত ছিল। ২০১৬ সালে তৈরি হওয়া এ জাহাজ ১৯০ মিটার লম্বা।
এর আগে ১৪ বছর আগে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর এই গ্রুপটির মালিকানাধীন আরেকটি জাহাজ ‘জাহান মনি’ও সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল। তখন জিম্মি হওয়ার ১০০ দিন পর মুক্তিপণ দিয়ে ২৬ নাবিকসহ জাহাজটি ফিরে পেতে সক্ষম হয় কেএসআরএম। এখন ফের এ শিল্প গ্রুপটিকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে ১৪ বছরের পুরোনো সেই ভয়ানক স্মৃতির। এবার জিম্মি হওয়া ২৩ নাবিককে উদ্ধার করতে কত দিন লাগতে পারে, সে ব্যাপারে এখনও কোনো ধারণা করতে পারছে না শিল্প গ্রুপটি।
নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল আমেরিকান নৌবাহিনী
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারত মহাসাগরের যে অবস্থান থেকে জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়েছে সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে থাকে আমেরিকান নৌবাহিনীর জাহাজ। সোমালিয়ান জলদস্যুদের উৎপাত বন্ধ করতে আমেরিকান নৌবাহিনী ওই সাগরে নিরাপত্তা দেয়। কিন্তু এখন গাজা যুদ্ধের কারণে হুতিরা সাগরপথে জাহাজ চলাচলে বাধা দিচ্ছে। এ কারণে আমেরিকান নৌবাহিনী সক্রিয় রয়েছে হুতিদের দমনে। এই সুযোগে ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদুস্যরা ফের তৎপর হয়ে উঠেছে। এমন প্রেক্ষাপটে সোমালিয়ান জলদস্যুদের থাবায় জিম্মি হলো বাংলাদেশি জাহাজ ও নাবিকরা।
এমভি আব্দুল্লাহ জলদস্যুর কবলে পড়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন কেএসআরএম-এর মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘জাহাজটি আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে যাচ্ছিল। পথে ভারত মহাসাগরে সেটি জলদস্যুদের কবলে পড়ে। জাহাজটি এখন জলদস্যুদের হাতে রয়েছে। জাহাজে রয়েছেন আমাদের ২৩ জন ক্রু। আমরা যতদূর জেনেছি, এখনও ক্রুদের কেবিনে জিম্মি করে রাখা হয়েছে। মালিকপক্ষ জাহাজটি উদ্ধারের চেষ্টা শুরু করেছে।’
স্বজনের কাছে নাবিকের বার্তা
গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১টা ৪০ মিনিটে জাহাজটির ডেক ক্যাডেট তার একজন স্বজনকে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জারে লেখেন, ‘সোমালিয়ায় আমাদের জাহাজ জলদস্যু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। তারা আমাদের জিম্মি করেছে। জলদস্যুদের কাছে অস্ত্র আছে। প্লিজ, আমাদের সহযোগিতা করুন। মিডিয়া স্যারকে দ্রুত ফোন দেন।’ এর আগেই অবশ্য জাহাজটির ক্যাপ্টেন ই-মেইল বার্তায় জাহাজ মালিককে জলদুস্য কবলে পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। জাহাজে অবস্থানরত নাবিক আতিকুল্লাহ খান বিকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিবার ও বন্ধুদের উদ্দেশে লেখেন, ‘আলহামদুল্লিাহ, আমরা ভালো আছি। ভয়ের কিছু নেই। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’
জাহাজের নাবিকদের একজন মোবাইল ফোনে জলদস্যুদের জাহাজে ওঠার দৃশ্যধারণ করেছেন। ছোট্ট ভিডিওতে দেখা যায়, কালো কাপড় পরা মুখোশধারী ব্যক্তি জাহাজে উঠছেন। তার কাঁধে লম্বা বন্দুক রয়েছে। এ ছাড়াও কয়েকটি স্থিরচিত্রে দেখা গেছে, জাহাজে কালো পোশাক পরা ব্যক্তিরা অবস্থান করছেন।
যেভাবে আক্রান্ত হয় এমভি আব্দুল্লাহ
এমভি আব্দুল্লাহর কাছাকাছি জল এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় অন্য একটি জাহাজের এক বাংলাদেশি নাবিক জানতে পারেন, এমভি আব্দুল্লাহ জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এই নাবিক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার এক বন্ধু এমভি আব্দুল্লাহতে কর্মরত আছেন। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, তাদের জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়েছে। বন্ধুর সঙ্গে আমার আলাপ হয় দুপুরের পর। ওই সময় জলদস্যুরা জাহাজটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সোমালিয়ার দিকে যাচ্ছিল। জাহাজের ক্রুদের কেবিনে আটকে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আমার সেই বন্ধু।’ তিনি বলেন, ‘শুরুতে ওরা ছোট একটা স্পিডবোট নিয়ে শিপে আক্রমণ করে। শিপ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার বড় ভেসেল নিয়ে আসে আরও একদল জলদস্যু। একটি কাঠের তৈরি বড় নৌকাও দেখা গেছে এমভি আব্দুল্লাহর পাশে। একাধিক দফায় জাহাজে অন্তত ৫০ জন জলদস্যু যৌথভাবে আক্রমণ করে। সর্বশেষ যখন আমার সঙ্গে বন্ধুর কথা হয়, তখনও জলদস্যুরা কাউকে মারধর করেনি। তবে শিপে ওঠার পরপরই তারা সব নাবিককে যার যার কেবিনে আটকে ফেলেছে। শুধু ক্যাপ্টেনকে ব্রিজে রাখে। শুরুতে তারা কারও মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়নি। পরে সম্ভবত নিয়েছে। কেননা বিকালের দিক থেকে তাদের মোবাইল ফোনে আর সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। কথা হওয়ার সময় শিপটিকে জলদস্যুরা সোমালিয়ান উপকূলের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।’
জাহাজটি এখন কোথায়
জাহাজটি কোথায় থেকে জিম্মি হয়েছে আর এ মুহূর্তে এটির অবস্থানই-বা কোথায়Ñএমন প্রশ্নের জবাবে ওই নাবিক বলেন, ‘তিন দিন ধরে এমভি আব্দুল্লাহর আইওএস সার্ভার বন্ধ রয়েছে। অবশ্য ওই এলাকা দিয়ে যেতে নিরাপত্তার স্বার্থে এটা সব জাহাজই করে থাকে। এ কারণে নিশ্চিত করে বলা মুশকিল, জাহাজটি কোথায় আছে। তবে হিসাব অনুযায়ী, এটি সোমালিয়া উপকূলের ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে আছে।’
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
এমভি আব্দুল্লাহর জলদস্যুদের কবলে পড়ার বিষয়ে মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘নাবিকরা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জারে জিম্মিদশার কথা জানিয়েছেন। আমাদের সহযোগিতা চেয়েছেন। আমরা বিষয়টি জাহাজের মালিকপক্ষ এবং সরকারকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘বিকালের পর থেকে তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তাই সর্বশেষ অবস্থা জানাতে পারছি না। আশা করছি, নাবিকদের সঙ্গে খারাপ কিছু হবে না।’
কেএসআরএম শিল্প গ্রুপের মালিকপক্ষের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গতকাল মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত জিম্মিকারীরা ফোনে যোগাযোগ করেনি। তবে মালিকপক্ষ জাহাজটির নাবিকদের উদ্ধারে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা শুরু করেছে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, জাহাজটি নিয়ে পুরোপুরি নিজেদের এলাকায় যাওয়ার পরই জলদস্যুরা যোগাযোগ করবে। এখন জাহাজটির অবস্থান জানতে মালিকপক্ষ ব্যস্ত সময় পার করছে।’
যা ঘটেছিল জাহান মনির ভাগ্যে
একই শিল্প গ্রুপের মালিকানাধীন জাহান মনি জাহাজটি সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া জাগানো এ ঘটনার ১০০ দিন পর ২০১১ সালের ১৪ মার্চ ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীসহ ২৬ জনকে মালিকপক্ষ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এ ঘটনায় মুক্তিপণ হিসেবে কত অর্থ দিতে হয়েছিল, সেই হিসাব প্রকাশ করেনি শিল্প গ্রুপটি। জাহান মনিকে তখন সোমালিয়ার উপকূলীয় গ্রাম গারাকাডের কাছাকাছি নিয়ে নোঙর করে রাখা হয়েছিল। অপহৃত নাবিকদের তখন ওমান হয়ে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়েছিল।
ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সোমালিয়ান জলদস্যুরা ২০১০ সালে বিভিন্ন দেশের মোট ৫৩টি জাহাজ ছিনতাই এবং ১ হাজার ১৮১ জন নাবিককে জিম্মি করে। মুক্তিপণের দাবিতে এ সময়ে অন্তত আটজনকে হত্যা করে জলদস্যুরা। ২০০৯ সালে জলদুস্যুদের হাতে ছিনতাই হওয়া জাহাজ ছাড়িয়ে আনতে গড়ে ৯০ দিন সময় লাগত। ২০১০ সালে সেই সময় ১৪৩ দিনে উন্নীত হয়। আগে ঘনঘন জাহাজ জিম্মি হলেও সম্প্রতি এই হার উল্লেখযোগ্যহারে কমেছিল। তবে হুতিরা মহাসাগরে সক্রিয় হয়ে ওঠায় এবং মার্কিন নৌবাহিনী সেদিকে নজর বাড়ানোয় আবারও বাড়ছে জাহাজে হামলার ঘটনা।
Posted ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১৩ মার্চ ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh