জাফর আহমাদ : | বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫
আল্লাহর কিতাবের প্রকৃত উত্তরাধিকারী হলো. মুসলিম উম্মাহ। কিন্তু এই মুসলিমগণ পরবর্তিতে কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। নিম্নের আয়াতে তিন শ্রেনীর লোকের বর্ণনা স্পষ্টতই পাওয়া যায়। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“তারপর আমি এমন লোকদেরকে এ কিতাবের উত্তরাধিকারী করেছি যাদেরকে আমি নিজের বান্দাদের মধ্য থেকে বাছাই করে নিয়েছি। এখন তাদের মধ্য থেকে কেউ নিজের প্রতি জুলুমকারী, কেউ মধ্যপন্থী এবং কেউ আল্লাহর হুকুমে সৎকাজে অগ্রবর্তী, এটিই অনেক বড় অনুগ্রহ।”(সুরা ফাতির:৩২)
১. জুলুমকারী: এরা নিজেদের প্রতি জুলুমকারী। এরা হচ্ছে এমনসব লোক যারা আন্তরিকতা সহকারে কুরআনকে আল্লাহর কিতাব এবং মুহাম্মদ সা: কে আল্লাহর রাসুল বলে মানে কিন্তু কার্যত আল্লাহর কিতাব ও রাসুলের সুন্নাতের অনুসরণের হক আদায় করে না। এরা মু’মিন কিন্তু গুনাহগার। অপরাধী কিন্তু বিদ্রোহী নয়। তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, সালাত, সাওম, যাকাত ও হজ্জ পালন করে কিন্তু আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী দেশ-রাষ্ট্র পরিচালনা হোক তা তারা চায় না বা এ ব্যাপারে কোন চেষ্টা-সাধনা করে না। অধিকন্ত যারা এই কাজ করতে চায় সে তাদেরও বিরোধীতা করে। এরা দুর্বল ঈমানদার, তবে মুনাফিক ও অন্তর ও মননের দিক দিয়ে কাফের নয়। তাই এরা আত্মনিপীড়ক হওয়া সত্তেও কিতাবের ওয়ারিশদের অর্ন্তভুক্ত এবং আল্লাহর নির্বাচিত বান্দাদের মধ্যে শামিল করা হয়েছে। নয়তো একথা সুস্পষ্ট বিদ্রোহী, মুনাফিক এবং চিন্তা ও মননের দিক দিয়ে কাফেরদের প্রতি এ গুণাবলী আরোপিত হতে পারে না। অর্থাৎ এ গুলো কাফেরদের গুণাবলী। এ শ্রেনীর ঈমানদারদের কথা সবার আগে বলার কারণ এই যে, উম্মতের মধ্যে এদের সংখ্যাই বেশী।
এরা আল্লাহর কিতাবকে উত্তরাধিকার হওয়ার পর কিতাবকে টুকরো টুকরো করেছে। আল্লাহ কিতাব অনুযায়ী কিছু হুকুমকে তারা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করে কিন্তু জীবনের অনেক বিষয় তারা মানব রচিত মতানুযায়ী পালন করে। এ জন্য আল্লাহ তা’আল্লা বলেন, ”তবে তোমরা কি কিতাবের একটি অংশ বিশ্বাস কর এবং অন্য অংশ অবিশ্বাস কর ? জেনে রাখ, তোমাদের মধ্যে যাদেরই এ রূপ আচরণ হবে, তাদের এতদ্ব্যতীত আর কি শাস্তি হতে পারে যে, তারা পার্থিব জীবনে অপমানিত এবং লাঞ্ছিত হতে থাকবে এবং পরকালে তাদেরকে কঠোরতম শাস্তির দিকে নিক্ষেপ করা হবে। তোমরা যা কিছু করছ,তা আল্লাহ মোটেই অজ্ঞাত নন।”(সুরা আল-বাকারা-৮৫)
বর্তমান বিশ্বের মুসলমানদের অবস্থা এ আয়াতের বর্র্ণনার সাথে হুবহু মিলে যায়।
প্রকৃতপক্ষেই আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আল কুরআনের সহজ ও সরল হুকুম গুলো ঘটা করে পালন করে যাচ্ছি, কিন্তু জীবনের অধিকাংশ সমস্যার সমাধানের জন্য ধারস্থ হচ্ছি মানব রচিত মতবাদের কাছে। যার ফলে পার্থিব জীবনে আমরা বিশ্বময় অপমানিত ও লাঞ্জিত হচ্ছি। কুরআনের সাথে কি ধরনের আচরণ করা হচ্ছে সে সম্পর্কে অবশ্যই আল্লাহ তা’আলা জিজ্ঞাস করবেন, ”যারা কুরআনকে টুকরো টুকরো করেছে। সুতরাং তোমার মালিকের শফথ, ওদের সবার কাছে আমি অবশ্যই প্রশ্ন করবো। সে সব বিষয়ে, যা কিছু আচরণ তারা (কুরআনের সাথে) করতো। (সুরা হিজর-৯১-৯৩)
কুরআনকে গোপণ করার অপরাধেও তারা অভিযুক্ত হবে। আল্লাহর রাসুল সা: কিয়ামতের দিন আল্লাহর আদালতে অভিযোগ দায়ের করবেন :-”হে আমার আল্লাহ, আমার জাতির লোকেরা এই কুরআনকে উপহাসের বস্তুু বানিয়ে নিয়েছিল।” (সুরা ফুরকান-৩০) তদ্রুপ যারা কুরআনের সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের দাওযাত দেয়না বরং এর আদেশ-নিষেধকে গোপন করে তাদের শাস্তি সম্পর্কে আল কুরআনের ঘোষনা হচ্ছে:-”যারা আমার নাযিল করা উজ্জল আদর্শ ও জীবন ব্যবস্থা গোপন করে রাখবে অথচ আমরা তা সমগ্র মানুষের পথ-প্রদর্শনের জন্য নিজ কিতাবে সুস্পষ্টভাবে বর্নণা করেছি। নিশ্চিত জেনো, আল্লাহ তাদের উপড় লানত করছেন, আর অন্যান্য সকল লানতকারীও তাদের উপড় অভিশাপ নিক্ষেপ করছে।”(আল-বাকারা-১৫৯) আল কুরআনে আরো বলা হয়েছে,”বস্তুত যারা আল্লাহর দেয়া কিতাবের আদেশ-নিষেধ গোপন করে এবং সামান্য বৈষয়িক স্বার্থের জন্য তাকে বিসর্জন দেয়, তারা মূলতঃ নিজেদের পেট আগুনের দ্বারা ভর্তি করে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ কখনই তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদেরকে পবিত্র বলেও ঘোষনা করবেন না। তাদের জন্য কঠিন পীড়াদায়ক শাস্তি নির্দিষ্ট রয়েছে। (আল-বাকারা-১৭৪)
উপড়ে উল্লেখিত জুলুমাত থেকে উত্তরণের জন্য এবং কঠিন শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য আজই আল কুরআনের সংগ্রামে, আল্লাহ জমীনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করতে হবে। দীন প্রতিষ্ঠা করা সালাত,সাওম, যাকাত ও হজে¦র মতোই ফরয বিধান। এটি শুধু মুহাম্মদ সা: এর সুন্নাহ নহে বরং সমস্ত আম্বিয়া কেরামদের সুন্নাহ। যেনতেনভাবে সালাত যেমন মুনাফিকের লক্ষণ তেমনি দীন প্রতিষ্ঠা থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখা মানে নিজেদেরকে মুনাফিক হিসাবে চিহ্নিত করার নামান্তর। তাছাড়া উপড়ে উল্লেখিত সুরা ফুরকানের ৩০ নং আয়াতে রাসুলুল্লাহ সা: এর মামলার আসামী থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করার জন্য দীন প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
২. মাঝামাঝি অবস্থানকারী: মাঝামাঝি অবস্থানকারী হচ্ছে এমন লোক যারা এ উত্তরাধিকারের হক কমবেশী আদায় করে কিন্তু পুরোপুরি করে না। হুকুম পালন করে এবং অমান্যও করে। নিজেদের প্রবৃত্তিকে পুরোপুরি লাগাহীন করে ছেড়ে দেয়নি বরং তাকে আল্লাহর অনুগত করার জন্য নিজেদের যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালায় কিন্তু কখনো তার বাগডোর ঢিলে করে দেয় এবং গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এভাবে এদের জীবনে ভালো ও মন্দ উভয় ধরনের কাজের সমাবেশ ঘটে। এরা সংখ্যায় প্রথম দলের চাইতে কম তবে তৃতীয় দলের চেয়ে বেশী হয়। তাই এদেরকে দুই নম্বরে রাখা হয়েছে। তারা আত্মভুলা লোকদের মতো মাঝে মধ্যে হালাল-হারামকে গুলিয়ে ফেলে। হারামকে ঘৃণা করে বটে কিন্তু হারামকে চিহ্নিত করতে ভুল করে। হালাল-হারামকে জানার আগ্রহও তাদের কম থাকে। ইসলামী হুকুম আহকামের গুরুত্বের প্রতি অনেকটা ঢিলাঢালা স্বভাবের। কিন্তু আল্লাহর আইনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে কিন্তু শুরু করি তো শুরু করা হয় না। অনেকটা অলস টাইপের। কোন হুকুমের ওপর দৃঢ়ভাবে টিকে থাকতে পারে না। এই ভালো তো এই খারাপ।
৩. ভালো কাজে যারা অগ্রবর্তী। এরা কিতাবের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে প্রথম সারির লোক। এরাই প্রকৃত এ উত্তরাধিকারের হক আদায়কারী। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“ এবং কেউ আল্লাহর হুকুমে সৎকাজে অগ্রবর্তী, এটিই অনেক বড় অনুগ্রহ।” কুরআন ও সুন্নাতের অনুসরনের ক্ষেত্রেও এরা অগ্রগামী। আল্লাহর পয়গাম তাঁর বান্দাদের কাছে যথাসাধ্য পৌঁছিয়ে দেবার ক্ষেত্রেও এরা এগিয়ে থাকে। সত্য দীনের জন্য ত্যাগ স্বীকারেও এরাই এগিয়ে যায়। তাছাড়া সত্য,ন্যায়, সুকৃতি ও কল্যাণের যে কোন কাজেও এরাই হয় অগ্রবর্তী। তারা দীনকে খুলুছিয়াতের সহিত আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়। ভালো কাজের বিস্তৃতি ও খারাপ কাজের সংকোচিত করার কাজে এরা সদা তৎপর থাকে।
এরাই আল্লাহর ঘোষিত সফলকাম দলের হক আদায় করে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক অবশ্যি থাকতে হবে, যারা নেকী ও সৎকর্মশীলতার দিকে আহবান জানাবে, ভালো কাজের নির্দেশ দেবে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে। যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তারাই সফলকাম হবে।”(সুরা আলে ইমরান:১০৪) এরা জেনে বুঝে জেনে বুঝে গোনাহ করে না। হালাল-হারামের ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখে। আর অজান্তে কোন গোনাহের কাজ অনুষ্ঠিত হলেও সে সম্পর্কে জানার সাথে সাথেই এদের মাথা লজ্জায় নত হয়ে যায় এবং বেশী বেশী ইস্তেগফার ও তাওবা করতে থাকে। আল কুরআনের পরিখাষায়“আর অগ্রগামীরা তো অগ্রগামী তারাই তো নৈকট্য লাভকারী।”(সুরা ওয়াকিয়া:১০-১১)
এদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটি আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে অনেক বড় অনুগ্রহ। ভালো কাজে অগ্রগামী হওয়াই হচ্ছে বড় অনুগ্রহ এবং যারা এমনটি করে মুসলিম উম্মাতের মধ্যে তারাই সবার সেরা। আল্লাহ কিতাবের জন্য উত্তরাধিকারের জন্য নির্বাচিত হওয়াই বড় অনুগ্রহ এবং আল্লাহর সকল বান্দাদের মধ্যে সেই বান্দাই সর্বশ্রেষ্ট যে কুরআন ও মুহাম্মদ সা: এর প্রতি ঈমান এনে নির্বাচনে সফলকাম হয়েছে। এরা রাসুলুল্লাহ সা: এর সুন্নাহর যোগ্য ও প্রকৃত অনুসারী। এরা শুধু পোষাক বা চেহেরা সুরতে নয় ববং আন্তরিক ও কার্যত সুন্নাহর অনুসারী।
Posted ১১:৩১ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh