জাফর আহমাদ | বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১
পৃথিবী এখন মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। বিশেষত পৃথিবীর মুসলিম বা দূর্বল দেশগুলোর কাছে মানবাধিকার সোনার হরিণ হিসাবে দেখা দিয়েছে। মানবাধিকার পৃথিবীর দুষ্ট রাজনৈতিক দূরাবৃত্তের চক্রাবর্তে পড়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আধুনিক ইউরোপ বা পাশ্চাত্য জগত মানবাধিকার সম্পর্কে অধিক সচেতন। এই সচেতনতার অংশ হিসাবে তারা ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের মাধ্যমে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে এবং তার ভিত্তিতে এখনো পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছে।
কিন্তু সবচেয়ে দু:খের বিষয় হলো, হয় মানবাধিকার সম্পর্কে তাদের ধারণা স্পষ্ট নয় অথবা চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে মানবাধিকারের নামে তারা মানুষকে নতুন অধীনতার অক্টোপাশে আবদ্ধ করছে। অর্থাৎ মানবাধিকার এখন সুবিধাবাদীদের কাছে মোক্ষম একটি হাতিয়ার। মানবাধিকারের নাম করে মানুষকে শোষণ করা খুবই সহজ। বর্তমান পৃথিবীতে মানবাধিকার লংঘনের যেই হার, তা যে কোন যুগ ও কালের চেয়ে অধিক। দূর্বল মানুষ সবলের হাতে, দূর্বল গোষ্ঠী সবল গোষ্ঠীর হাতে, দূর্বল জাতি শক্তিধর জাতির দ্বারা আজ নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। পৃথিবীর সর্বত্র আজ শিশু, নারী, দরিদ্র, মেহনতি মানুষ, কৃষ্ণাগাত্র ও নিম্নবর্ণীয় লোকেরা অধিকার বঞ্চিত, নিগৃহিত ও মানবিক মৌলিক সুযোগ সুবিধা ও বেঁচে থাকার নূত্যতম অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। সবচেয়ে মারাত্মক যেই বিষয়টি মানবতাকে অধিক হারে লাঞ্ছিত করছে, তা হলো স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে বাঁকা পথে ক্ষমতায় আরোহন করে দেশের জনগণের সকল প্রকার অধিকার হরণ করে চলেছে। ‘আভ্যন্তরীন হস্তক্ষেপ’-এর অযুহাতে বিশ মানবাধিকার সংগঠণগুলো তাদের ব্যাপারে তেমন একটা হস্ত প্রসারিত করতে পারে না।
শুধু মানবাধিকার নয়, ঝড়-ঝঞ্জা, সমস্যা-সংক্ষুব্ধ ও বিপর্যস্ত পৃথিবীকে মানুষের বাস উপযোগী ও মৌলিক মানবিক অধিকারসহ বেঁচে থাকার গ্যারান্টি দিতে পারে একমাত্র আল্লাহর বিধান ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাদর্শ। কারণ আল্লাহর বিধানে কোন পক্ষপাতিত্ব নেই। তাঁর বিশাল সৃষ্টি কারখানাটি যেমন ভারসাম্যপূর্ণ, তেমনি বৈষম্যহীন। তাঁর সর্বশেষ প্রেরিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট রাসুল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মহানায়ক। তিনি যেই জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা ছিল ভারসাম্যপূর্ণ ও সর্বশ্রেনীর মানুষের জন্য কল্যাণকর। তিনি ছিলেন নিপীড়িত মানবতার মহান বন্ধু। মানবাধিকার বলতে যতগুলো বিষয়কে গণ্য করা হয়, ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় এর প্রতিটির ব্যাপারেই অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।
মানবাধিকারের প্রধান বিষয়গুলো হলো, ‘জীবন ধারণের অধিকার, সম্পদের অধিকার, মান-মর্যাদা ও ইজ্জত আব্রু রক্ষার অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার, বিবেক ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা, আর্থিক নিরাপত্তা লাভের অধিকার, বসবাস, যাতায়াত ও স্থানান্তরের অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, পারিশ্রমিক লাভের অধিকার, নারীর অধিকার, সংখ্যলঘুদের অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সমতা ও শ্রমিকের অধিকার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উল্লেখিত প্রতিটি বিষয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মর্মস্পর্শী ভাষায় শুধু গুরুত্বারূপই করেন নাই বরং ২৩টি বৎসর সংগ্রাম করে মদীনা নামক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তা দেখিয়ে গেছেন। তিনি মানুষের প্রতিটি অধিকারের ব্যাপারে শরয়ী সীমারেখা বা আইনগত বাধ্যবাধকতা এঁকে দিয়ে গেছেন। যাতে কেউ কারো সীমারেখা অতিক্রম না করে বা কেউ কারো সীমারেখায় অতিক্রম করে কারো অধিকারকে ক্ষুন্ন না করে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণটি ছিল মানবাধিকারের একটি উজ্জল সনদ।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তার অধিকার দিয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“অমুসলিমদের জীবন আমাদের জীবনের এবং তাদের সম্পদ আমাদের সম্পদের মতোই।” তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, জীবনের নিরাপত্তা, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইত্যাদি অধিকার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিশ্চিত করেছেন। মদীনা সনদ অমুসলিমদের মদীনায় বসবাসের অধিকার দিয়েছিল।
এমনকি তাদের একটি অংশ বিশ্বাসঘাতকতা করা সত্ত্বেও বাকী অংশের প্রতি কোনরূপ অন্যায় আচরণ করা হয়নি। তিনি একজন অমুসলিম শ্রমিককে একজন মুসলিম শ্রমিকের মতোই সুযোগ সুবিধা দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সতর্ক থাকো সে ব্যক্তি সম্পর্কে যে ব্যক্তি অমুসলিমদের ওপর জুলুম করে অথবা তাদের হক নষ্ট করে অথবা তাদের সামর্থের চাইতে বেশী কাজের বোঝা চাপাতে চেষ্টা করে অথবা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের থেকে কিছু জোরপূর্বক নেয়, আমি কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়ব।”(আবু দাউদ) এই আলোচনার প্রেক্ষিতে বর্তমান বিশ্বের দেশে দেশে সংখ্যালঘুদের দিকে একটু দৃষ্টি নিক্ষেপ করুন। সংখ্যালঘুদের করুণ অবস্থার দিকে তাকালে মনে হয় যেন তারা সে দেশে জন্ম গ্রহণ করে আজন্মের পাপ করেছে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বৈচিত্রময় কার্যাবলীর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হলো, ঘৃণ্য দাসপ্রথার বিলুপ্তিকরণ। দাসদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি বিপ্লবাত্মক ভূমিকা রেখেছেন। তিনি দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করে ঘোষনা দিয়েছিলেন, “তিন ধরণের লোক আছে তাদের বিরুদ্ধে আমি শেষ বিচারের দিন অভিযোগ উত্থাপন করব।
একজন সে ব্যক্তি যে মুক্ত মানুষকে দাসে পরিণত করে, আরেকজন সে ব্যক্তি, যে তাকে বিক্রয় করে, অন্যজন সে ব্যক্তি, যে দাস বিক্রির অর্থ খায়।” দাস প্রথার বিলোপ সাধনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের উৎসাহিত করেছেন। কিছু পাপের প্রায়শ্চিত্যের উপায় হিসাবে দাস মুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন। রাসুল স্বয়ং ৬৩ জন দাসকে মুক্তি দিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা রা: ৬৭ জন, হযরত ওমর রা: ১০০০ দাস ক্রয় করে মুক্ত করেন, এমনিভাবে বিত্তবান সাহাবী হযরত আবদুর রহমান রা: ত্রিশ হাজার দাস ক্রয় করে মুক্ত করেন। এভাবে ৩০/৪০ বৎসরের মধ্যে আরবের দাস সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। দাসদের মর্যাদা প্রদানের উদাহরণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন থেকেই আমাদের শিখতে হবে। তিনি আবিসিনিয়ার ক্রীতদাস হযরত বেলালকে মসজিদে নববীর মোয়াজ্জিন হিসাবে নিযুক্তি দিয়েছেন, আপন ফুফাত বোনকে ক্রীতদাস জায়েদের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমান বিশ্বে হুবহু সেই আকারে দাসপ্রথা না থাকলেও ভিন্ন আকারে দাস প্রথা রয়েছে এবং তাদের উপর বিভিন্নভাবে দলন-পীড়ন করা হয়।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আরেকটি যুগান্তকারী অবদান হলো, শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা। তিনি উৎপাদিত পণ্যে শ্রমিকের অংশীদারিত্বের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন,“কর্মচারীদেরকে তাদের কাজের লভ্যাংশ দাও।”(মুসনাদে আহমাদ) আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমিকের সামান্য পারিশ্রমিকটুকু সময়মত পরিশোধ করা হয় না। সে ব্যাপারে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “শ্রমিকের মুজুরী তার গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই দিয়ে দাও।” (ইবনে মাযাহ) তিনি আরো বলেছেন,“তোমরা তাদের ওপর বাড়তি দায়িত্ব চাপালে সে হিসাবে তাদেরকে বাড়তি মজুরী দিয়ে দাও।” শ্রমিক-মালিক সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেই মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা অনুসরণ করলে উৎপাদন খাতে কাংখিত শান্তি ও কল্যাণ লাভ করা সম্ভব হতো। আমাদের শ্রম আইনে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক হচ্ছে প্রভু-ভৃত্যের সমত’ল্য। কিন্তু মহানবী প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক গুড়িয়ে দিয়ে ভ্রাতুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,“তোমাদের অধীন ব্যক্তিরা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ যেই ভাইকে যেই ভাইয়ের অধীন করে দিয়েছেন, তাকে তাই খ্ওায়াতে হবে-যা সে নিজে খায় এবং তাকে তাই পরতে দিতে হবে যা সে নিজে পরিধান করে।(বুখারী-মুসলিম)
নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে অধিক কৃতিত্ব পৃথিবীর কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দাবী করতে পারবে না। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনপূর্ব নারীর সম্মান ও মর্যাদা ছিল ধূলামলীন।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদেরকে মহাসম্মানের আসনে বসিয়েছেন। তিনি ঘোষনা করেছেনঃ“নারীরা মায়ের জাত। মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত।” যে কন্যা সন্তানকে কুলুক্ষণে বা মর্যাদাহানীকর মনে করা হত এবং মেয়েদের জীবিত কবর দেয়া হতো। সে মেয়েদের লালন-পালনকে আল্লাহর রাসুল জান্নাত পাওয়ার কারণ বানিয়ে দিলেন। সুতরাং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই শুধুমাত্র কৃতিত্বের একক হকদার।
তাই বাংলা সাহিত্যের একজন কবি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই অবদানকে কবিতাকারে প্রকাশ করেছের:
তিনি বলেছেন:-‘নারী যেথা ছিল দাসী, তুমি তারে করে দিলে রাণী, বসাইলে একাসনে পুরুষের পাশাপাশি আনি।’
দুনিয়া জোড়া মানবতার ফেরীওয়ালা বা প্রগতির নামে যারা ফাঁকা বুলি মন্থর করে ফিরে, তারা কি নারীদের এ ধরনের মর্যাদা দিতে পেরেছে? কখনো না, বরং বর্তমান পাশ্চাত্য নারীকে পণ্যের মত ভোগের সামগ্রী মনে করে। তারা নারী স্বাধীনতার নাম করে নারীর মর্যাদাকে সর্বাঙ্গে ভুলন্ঠিতই করেছে।
জীবন সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন,‘তোমাদের জীবন ও সম্পত্তি তোমাদের পরস্পরের নিকট পবিত্র।’ সম্পদের অধিকার রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,“যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয় সে শহীদ।”(বুখারী) তিনি কোন মানুষের মর্যাদাহানিকে ঘৃণ্যতম জুলুম বলে উল্লেখ করেছেন। এমনিভাবে পাারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক সকল বিষয়ে অধিকার সম্পর্কীত পারস্পরিক দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদত্ত মূলনীতি শাশ্বত। এই মূলনীতি অনুসরণের মাধ্যমেই অধিকার বঞ্চিত ও মানবাধিকার লংঘিত বর্তমানের এ অশান্ত পৃথিবীটি শান্তি ও কল্যাণের পথে প্রবেশ করতে পারে।
লেখক : “সবুজ গম্বুজের আলো” ও ম্যানেজার, আইবিবিএল, জিন্দাবাজার, সিলেট।
০১৫৫২ ৩৪২ ২৭৪, [email protected]
Posted ৮:৩৯ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh