বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর ২০২০
বেবী নাজনীন, রিজিয়া পারভীন, শশী
নিউইয়র্ক সিটিতে করোনাকালে নবান্ন উৎসব আয়োজন করে ফেঁসে গেছেন সংশ্লিষ্ট সবাই। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন আয়োজক, শিল্পী ও কলাকুশলীরা। গত সপ্তাহে সিটির কুইন্স প্যালেস পার্টি হলে চলে আনন্দ উৎসব। জানা গেছে নবান্ন অনুষ্ঠানের আগেই রিহার্সেল চলাকালে সেখানে উপস্থিত অধিকাংশ শিল্পীর দেহে সংক্রমন ঘটে করোনাভাইরাসের। আক্রান্তের পর অসুস্থ হয়ে পড়লে কেউ কেউ হাসপাতালে ভর্তি হন। অনেকে আবার বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর যাদের দেহে কোন ধরণের উপসর্গ নেই তারা নিজ বাসায় আছেন কোয়ারেনটাইনে। সিটি হেলথ ডিপার্টমেন্টের নির্দেশমতো তাদেরকে রিহার্সেলের তারিখ থেকে টানা ১৪ দিন বাসায় থাকতে হবে। এসময়ে বাইরে যাওয়া এবং কারো সংস্পর্শে আসা যাবে না। নবান্নের রিহার্সেলে অংশগ্রহণকারী একজন ভুক্তভোগী সাপ্তাহিক বাংলাদেশকে বলেন, নবান্নের আনন্দ তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। তাদের মতে এখন সব ধরণের অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। নিউইয়র্কের কুইন্সে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা জ্যাকসন হাইটসের আশপাশে আবারও বেড়েছে করোনার প্রকোপ বেড়েছে। ইত:মধ্যে কয়েক শ বাংলাদেশি করোনায় সংক্রমিত হয়েছে। শিল্পী বেবী নাজনীন নিউজার্সির একটি মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসাধীন আছেন। তবে ভালো আছেন তিনি । এদিকে বাংলাদেশী কমিউনিটির বেশ কয়েকজন করোনার দ্বিতীয় দফা আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন। অনেকেই আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আবার অনেকে বাসায়ই চিকিৎসা নিচ্ছেন ডাক্তারের পরামর্শে। তারপরও কমিউনিটির একশ্রেনীর মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। তারা আয়োজন করছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি। বাংলাদেশে যেসব অনুষ্ঠান হচ্ছে না নিউইয়র্কে এমন নবান্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বেশ কয়েকজন এখন ভুগছেন করোনায়। অনেক দোকান পাট রেস্টুরেন্টে ঢুকেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে চান না কেউ কেউ। ধর্মীয় উপাসনালয়েও অনেকের মাঝে এমন প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মাস্ক পরিধান না করার মধ্যে এক ধরণের বীরত্ব দেখছেন অনেকে।
কমিউনিটিতে স্বাস্থ্য বিধি না মানার বাতিক : করোনা ভাইরাস মহামারির প্রথম ধাপে বিপুল সংখ্যা মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ধাপ। এবারো সংক্রমন বাড়ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। তারপরও অনেকের মাঝে দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি না মানার বাতিক। নিউইয়র্কের বাংলাদেশী কমিউনিটিতেও এই বাতিক বিদ্যমান। নানাভাবে তারা অমান্য করছে করোনা প্রতিরোধের স্বাস্থ্য বিধি। নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫ রাজ্যে ভয়াবহ আকার ধারন করেছে করোনা ভাইরাস সংক্রমন। এ তালিকায় রয়েছে নিউইয়র্ক রাজ্যও। এখানেও প্রতিদিন বাড়ছে কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা। শীতের শুরুতেই ঝাকিয়ে বসা করোনাভাইরাসের সংক্রমন মাত্রা অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এখন গড়ে প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে ২ লক্ষাধিক মানুষ। আর মৃত্যুর হারও দিনে প্রায় ২হাজার। ইতোমধ্যেই করোনা আক্রান্ত শীর্ষ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। এপর্যন্ত দেশটিতে মোট করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সোয়া কোটিতে পৌছেছে। মোট প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২লাখ ৬০ হাজারে। প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশী বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ মহল।
নিউইয়র্ক রাজ্যে করোনার প্রথম দফা আক্রমনে মারা গেছে ৩৫ হাজার মানুষ। তখন নিউইয়র্ক ছিলো করোনা আক্রান্ত রাজ্য হিসেবে শীর্ষে। এসময় এ রাজ্যে ৬ লক্ষাধিক মানুষ করোনায় সংক্রমিত হয়। নিউইয়র্ক সিটিতেই সেসময় করোনা আক্রান্ত হয় ৩ লক্ষাধিক মানুষ। আর প্রাণহানি ঘটে ২৫ সহস্রাধিক। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জনজীবন। লক ডাউন চলে সাড়ে ৩ মাস সময় জুড়ে। সিটির সরকারী বেসরকারী কোন হাসপাতালেই ঠাঁই ছিলো না। সয়লাব হয়ে গিয়েছিলো করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীতে। এমন সময় গিয়েছে তখন হজম করতে হয়েছে দিনে ৮০০ মানুষের মৃত্যুর খবর। সিটির বাংলাদেশী কমিউনিটির প্রায় আড়াই শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে করোনায়। মৃত্যুর এ মিছিলে ছিলো কমিউনিটির অনেক জনপ্রিয় নেতা, চিকিৎসক, পুলিশ অফিসার সহ বিভিন্ন বয়সী ও শ্রেনী পেশার আপনজন। হাসপাতালের মর্গে জায়গা ছিলো না লাশ রাখার। এখনো প্রায় ৬ শতাধিক মরদেহ লাশবাহী ট্রাকে রয়েছে সৎকার করার অপেক্ষায়। এমনই ভয়াবহ দিন ছিলো যে লাশ দাফনের তেমন সুযোগ ছিলো না। পরিবারের আপনজন শেষ দেখা দেখতে পারেনি তাদের স্বজনদের মুখ। ঘরে ঘরে কান্নায় রোল।
মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল, রেস্টুরেন্ট সবকিছু ছিলো বন্ধ। রাস্তায় শুধুই চলমান ছিলো রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স। মাত্র কিছুদিন আগেই এমন ভয়াল ও দুর্বিসহ সময় কাটাতে হয়েছে নিউইয়র্কবাসীকে। এ অবস্থা মার্চের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে চলতে থাকে জুন পর্যন্ত। জুলাইতে এসে মানুষ সুযোগ পায় নিঃশ্বাস ফেলার। সীমিত পর্যায়ে অনেক প্রতিষ্ঠান খুলে যায়। সেপ্টেম্বরের শেষে আংশিকভাবে চালু হয় স্কুল, রেস্টুরেন্ট সহ অনেক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। এমন একটি অবস্থায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় যখন মানুষ, তখনি নূতন করে আঘাত হানছে করোনার নূতন ঢেউ। আবার তছনছ করে দিচ্ছে সবকিছু। পুনরায় প্রকোপ বাড়ছে করোনার। আগামী ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে করোনা এমন আগাম বার্তাই দিচ্ছে সংক্রমন রোগ বিশেষজ্ঞগণ ও সিডিসি। চারদিকে যখন এমন দুঃসংবাদ এবং অন্ধকার ভবিষ্যত অপেক্ষামান তখনই সুসংবাদ এসেছে করোনা ভাইরাস ভ্যাকসিনের। ফাইজার এবং মর্ডানা কোম্পানী ভ্যাকসিন নিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। আগামী ডিসেম্বরেই শুরু হবে ভ্যাকসিন প্রয়োগ। তবে প্রথমদিকে সাধারণ মানুষ ভ্যাকসিন পাবে না। এজন্য তাদেরকে আরো অপেক্ষা করতে হবে কিছুটা সময়। আর অপেক্ষামান এ সময়টায় সুস্থ থাকতে অবশ্যই তাদেরকে মেনে চলতে হবে স্থাস্থ্যবিধি। এর কোন বিকল্প নেই। বিশেষ করে মাস্ক ব্যবহার করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। সাবান দিয়ে হাত ধৌত করা বা স্যানিটাইজার ব্যবহার করা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে সভা, সমাবেশ ও অনুষ্ঠানাদি বর্জন করা। রেস্টুরেন্ট, বার, পার্টিহল সহ বিভিন্ন স্থানে ১০জনের অধিক মানুষের সমাগম এবং সেখানে মাস্ক ব্যবহার না করায় দ্রুত সংক্রমন ঘটছে করোনা ভাইরাসের। অনেক মানুষই মানতে নারাজ এসব স্বাস্থ্য বিধি। করোনার দ্বিতীয় দফা আক্রমনের কারণে নিউইয়র্ক সিটির স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে বসানো হচ্ছে ফিল্ড হাসপাতাল। কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। সিটির পাবলিক স্কুলগুলোতে সশরীরে ক্লাশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে গত সপ্তাহে। আইন অমান্য করে যারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি করছে তাদেরকে আনা হচ্ছে আইনের আওতায়। সিটির শেরিফ বিভাগ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক জরিমানা করেছে আইন অমান্য করায়। থ্যাংকস গিভিং ডে’র সবধরণের আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ রাখা হয়েছে। এমনকি নিউইয়র্কের গভর্নর থ্যাঙ্কস গিভিং ডে উপলক্ষে তার মা’কে নিমন্ত্রণ জানিয়ে পরে তা বাতিল করেছেন।
ব্রুকলিনে সিনাগগকে জরিমানা : সহস্রাধিক অতিথি নিয়ে বিয়ের আয়োজন করায় নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে ইয়েতেভ লেভ টেম্পল নামে ইহুদিদের এক প্রার্থনালয় কর্তৃপক্ষকে ১৫ হাজার ডলার জরিমানা করেছে নগর কর্তৃপক্ষ। নিউইয়র্ক পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই সিনাগগের ধর্মগুরুর নাতির বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে কয়েক হাজার অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যাদের অধিকাংশই মাস্ক ব্যবহার করেননি এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলেননি। ২৩ নভেম্বর রাতে সিটি হলে এক সংবাদ সম্মেলনে নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডি ব্লাজিও বলেছেন, ৮ নভেম্বর ইয়েতেভ লেভ টেম্পলে ওই বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। সেখানে হাজারেরও বেশি অতিথি সামাজিক দূরত্ব না মেনে ও মাস্ক ছাড়াই উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তাঁরা নাচ-গান করছিলেন। এতে করোনা বিধি লঙ্ঘনের দায়ে ওই সিনাগগকে ১৫ হাজার ডলার জরিমানা করে সমন জারি করা হয়েছে।বিল ডি ব্লাজিও বলেন, ওই সিনাগগের এ ধরনের আচরণ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এটা তাদের পুরো দায়িত্বজ্ঞানহীন একটি কর্মকাণ্ড। ওই সিনাগগে সাত হাজার মানুষের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। আর যেহেতু হাজারের অধিক অতিথি উপস্থিত হয়েছিলেন তাই নিশ্চিন্তে বলা যায়, সেখানে করোনা বিধি মেনে চলার সুযোগই ছিল না।
নিউইয়র্কে সর্বত্র মাস্ক পরা ও সামাজিক ব্যবধান কঠোরভাবে মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। ১০ জনের বেশি মানুষ নিয়ে হাউস পার্টি না করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।নিউইয়র্ক ডেইলি নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০ নভেম্বর নিউইয়র্ক সিটি হল থেকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিউইয়র্ক নগরের ৪০টি জিপকোড এলাকায় ৪ শতাংশের বেশি হারে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। মাত্র কয়েকমাস পূর্বে দেখা ভয়াবহতা আমলে নিয়ে স্বাস্থ্য বিধি না মানলে এজন্য গুণতে হবে কঠিন মাশুল । নিজে সুস্থ থেকে অপরকে সুস্থ থাকার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। সতর্ক এবং সচেতন হতে হবে এখনই।
Posted ১১:১২ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh