সোমবার, ১৮ মার্চ ২০২৪ | ৫ চৈত্র ১৪৩০

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

করোনায় প্রয়াত পুলিশ কর্মকর্তা মুজিব চৌধুরী

ডাঃ ওয়াজেদ এ খান :   |   বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই ২০২০

করোনায় প্রয়াত পুলিশ কর্মকর্তা মুজিব চৌধুরী

প্রাণবিনাসী ব্যাধি করোনা ভাইরাস। ঝড়ের গতিতে বদলে দিয়েছে পৃথিবীর চিরচেনা সমাজ-সভ্যতা। মনুষ্য জনপদ পরিবেশ প্রতিবেশ করেছে তছনছ। করোনার সংক্রমনে সুখ-স্বপ্ন হারিয়ে গেছে নিমিষে। কেড়ে নিয়েছে লাখো মানুষের প্রাণ। জন্মিলে মরতে হবেই। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। মৃত্যুর কোন কাল নেই। তারপরও স্বজনের মৃত্যুতে মানুষ কাঁদে। বুকের ভেতরটা খান খান হয়ে যায় ভেঙ্গেচুরে।

আর করোনার মতো ভয়াল মহামারিতে মৃত্যু হলে তো কথাই নেই। করোনায় মৃত্যু শোক সইতে পারাটা স্বজনদের জন্য ছিলো বড় বেশী কঠিন। তারপরও সইতে হয়েছে। মেনে নিতে হয়েছে মহান আল্লাহ তা’য়ালার অমোঘ বিধান।


নিউইয়র্কে গত মার্চে মারাত্নক আঘাত হানে করোনা ভাইরাস। আর গত এপ্রিল মাসটা ছিলো মৃত্যুর খবরে ঠাসা। প্রতিদিনই পরিচিত জনের মৃত্যু সংবাদ ভাইরাল হয়ে যেতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বাড়িয়ে দিতো শোক, দুঃখ, কাতরতা। উনিশ এপ্রিল রোববার ছিলো এমন একটি দিন। খবর এলো নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের ট্রাফিক এনফোর্সমেন্ট’র সেকশন কমান্ডার মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান চৌধুরী আর নেই। আমাদের অত্যন্ত প্রিয় মুজিব ভাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। মৃত্যুর সপ্তাহখানেক পূর্বে করোনাক্রান্ত অবস্থায় তিনি ভর্তি হন কুইন্স জেনারেল হাসপাতালে। এর আগে বাসায়ই চিকিৎসা নেন। কিন্তু শ্বাসকষ্ট ও জটিলতা বাড়লে স্থানান্তর করা হয় হাসপাতালে।

প্রতিদিন তিনবেলা খবর রাখতাম তার শারিরীক অবস্থার। হাসপাতালে কেমন আছেন তিনি। প্রতীক্ষায় থাকতাম সুখবরের। কিন্তু সব প্রত্যাশা প্রতীক্ষার অবসান ঘটে উনিশ এপ্রিল দিনান্তে। তার মৃত্যু সংবাদ আসে। কিছুতেই মানতে পারছিলাম না তার এ অস্বাভাবিক মৃত্যু। মুজিব চৌধুরী আমার আত্মীয়। অনেক সময় এগিয়ে এসেছেন অভিভাবক হিসেবে। বড় বেশী বন্ধু বাৎসল ও স্বজন প্রিয় ছিলেন তিনি। পরিবার ও বন্ধু মহলে পরিচিত ছিলেন ‘নিনি’ নামে। ডায়াবেটিস সহ অন্যান্য কিছু রোগের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি আগে থেকেই। কিন্তু করোনা এতটা কাবু করে ফেলবে এমনটি ভাবতে পারেননি কেউ। আইসিইউতে ভেন্টিলেশনে থাকাবস্থায়ই মারা যান মুজিব ভাই। নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের উদ্যোগে প্লাজমা থেরাপিও দেয়া হয় তাকে। তার ছোট ভাই ডাঃ সাঈদুর রহমান চৌধুরী একই হাসপাতালের আইসিইউ’র চিকিৎসক। সবাই চেষ্টায় ছিলেন তাকে বাঁচিয়ে তোলার। কিন্তু সম্ভব হয়নি।


বাংলাদেশী আমেরিকানদের মধ্যে নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগ (ট্রাফিক এনফোর্সমেন্ট) এর সর্বোচ্চ সেকশন কমান্ডার পদে কর্মরত ছিলেন মুজিবুর রহমান চৌধুরী। তার মৃত্যু সংবাদে এনওয়াইপিডি ও বাংলাদেশী কম্যুনিটিতে নেমে আসে শোকের ছায়া। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, তিন কন্যা, চার ভাই এবং এক বোন সহ অনেক আত্মীয় স্বজন রেখে গেছেন। তার পরিবারের সকল সদস্যই এখন বসবাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রয়াত বড় ভাই ফার্মাসিস্ট মুশফিকুর রহমান চৌধুরীর মাধ্যমে তিনি ১৯৮২ সালে অভিবাসী হন এদেশে। বর্তমান মির্জাপুর এবং তৎকালীন মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজের পঞ্চম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন মুজিব চৌধুরী। ঢাকার রাজাবাজারে জন্ম ও বেড়ে উঠা মুজিব চৌধুরী পরিবারের আদি নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিউইয়র্ক পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে যোগ দেন ১৯৯০ সালে। প্রথম দিকের একজন বাংলাদেশী ট্রাফিক এজেন্ট তিনি। কর্মস্থলে দায়িত্বশীলতা, কর্তব্যপরায়নতা ও কর্মনিষ্ঠার জন্য এনওয়াইপিডি’র ট্রাফিক এনফোর্সমেন্টের এই পদে আসীন হন তিনি। আর এটা ছিলো বাংলাদেশী কম্যুনিটির জন্য অত্যন্ত গর্বের। দীর্ঘদিন চাকুরীকালে পুলিশ বিভাগ তাকে সম্মানিত করেছে বার কয়েক। প্রদান করেছে সম্মানসূচক পদক। এনওয়াইপিডি’র ট্রাফিক সুপারভাইজার হিসেবে ১৯৯৬ সালে পদোন্নতি লাভ করেন তিনি। নিজ দক্ষতা ও কর্মগুণে ট্রাফিক ম্যানেজার হন ২০০৯ সালে। প্রাপ্য ছুটি না কাটিয়ে অনেক সময়ই অফিস করতেন কাজ পাগল এ মানুষটি। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিকট তিনি ছিলেন বিশ্বাস ও আস্থাভাজন। অপরদিকে অধস্তনদের প্রিয়পাত্র ছিলেন মুজিব চৌধুরী। চাকুরী জীবনে ২০ বছর অফিসের নিয়মানুবর্তীতা মেনে চলার জন্য ২০১৬ সালে বিশেষ সম্মাননা পদক প্রাপ্ত হন তিনি। মুজিব চৌধুরী সেকশন কমান্ডার হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন ২০১৮ সালে। করোনাক্রান্ত হওয়ার সপ্তাহেও তিনি নিজ অফিসে বিভাগীয় সভায় অংশ নেন। তখন করোনার বিস্তার চলছিল অপ্রতিরোধ্য গতিতে। এর মাঝেই কাজ করতে হয়েছে তাকে। ধারণা করা হয় অফিস থেকেই করোনা ভাইরাস আক্রমন করে দ্বিতীয় সারির এ করোনা যোদ্ধাকে।

মৃত্যুর পর নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগ অভাবনীয় শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে নিবেদিত প্রাণ এই কর্মকর্তার প্রতি। গত ২২ এপ্রিল সিটির রিজউডের পাক ফিউনারেল হোমের সামনের রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। নিউইয়র্ক পুলিশের পতাকায় মুড়ানো কফিন সামনে রেখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ান পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তাগণ। বিউগলে বেজে উঠে বিদায়ের করুণ সুর। তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান সহকর্মীরা। জানাযা শেষে সামরিক কায়দায় গার্ড অফ অনার প্রদান করে নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগ। এসময় মুজিব চৌধুরীর স্ত্রী ও তিন কন্যার হাতে পুলিশ বিভাগীয় পতাকা তুলে দেন পুলিশ কর্মকর্তাগণ। গার্ড অনার শেষে মুজিব চৌধুরীর লাশ বহনকারী গাড়ির সামনে পেছনে এসকর্ট করে কবর কবরস্থানে নিয়ে যায় পুলিশ। নিউইয়র্ক সিটি থেকে ৩০ মাইল দূরে লং আইল্যান্ডের ফার্মিংডেলের পাইনলন কবর স্থানে দাফন করা হয় তাকে। এসময় তার পরিবারের সদস্যদের মাঝে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে।
মরহুম মুজিব চৌধুরী ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন ধর্ম পরায়ন ও পরোপকারী। তিনি তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনকে ভালোবাসতেন নিজ জীবনের চেয়ে বেশী। প্রতিটি উৎসব আয়োজনে সবাই সমবেত হতেন তার বাসায়। পরিবারের ছোট বড় সবারই একধরণের নির্ভরশীলতা ছিলো তার উপর। সবার দায়িত্ব পালনের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পেতেন তিনি। দেশ থেকে ক্যাডেট কলেজ জীবনের বন্ধুরা বেড়াতে এলে তাদেরকে যেমন আপ্যায়ন করতেন, তেমনি পছন্দ করতেন তাদেরকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। অসুস্থ হওয়ার সপ্তাহেও এক বন্ধু বাংলাদেশ থেকে সপরিবারে বেড়াতে আসেন তার বাসায়। পরে তিনি ও তার স্ত্রী তাদেরকে নিউজার্সির এক আত্মীয়ের বাসায় পৌছে দেন।


মুজিব ভাইর সাথে দীর্ঘ দুই যুগের পরিচয়। আমাদের আত্মীয়। জ্যামাইকা হিলসে আমাদের বাসাও ছিলো কাছাকাছি। আমার ও তার সন্তানরা বলতে গেলে এক সাথেই বেড়ে উঠেছে। নব্বুই সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। তখন আমার পরিবার এদেশে নূতন। সন্তানরাও ছোট ছোট। তখন আমাদের দু’পরিবার সবসময় একসাথে বেড়াতে বেড়িয়েছি। অন্য স্টেটে আত্মীয়ের বাসায়, দর্শনীয় স্থানে ঘুরেছি। শপিংএ ও অনুষ্ঠানাদিতে অংশ নিয়েছি এক সাথে। তার মাঝে কোন অলসতা বা বিরক্তির ভাব দেখিনি কখনো। শত শত মাইল আমরা ভ্রমণ করেছি এক গাড়িতে। আবার কখনো বা পৃথক গাড়িতে করে। চলতি পথে কোথাও কোন অসুবিধা হলে শরনাপন্ন হয়েছি মুজিব ভাইর। কয়েক বছর পূর্বে ক্ইুন্স ভিলেজে বাড়ি কিনে চলে যান। কিন্তুু প্রতিবছরই সেখানে ইনডোর-আউটডোর অনুষ্ঠান আয়োজন করতেন তিনি। বাড়ির আঙ্গিনায় তরি-তরকারি যখন যা ফলতো কখনোই তা শেয়ার করতে ভুলতেন না। অফিস চত্বরে আমাদের সবজি বাগানের জন্য গাছের চারা-সার এসব নিজেই আমাদের পৌছে দিতেন সময় মতো। দেশে যাওয়ার কথা শুনলেই ফোন দিয়ে বলে রাখতেন এয়ারপোর্টে পৌছে দিবেন তিনি। অনেকবার দিয়েছেনও। এবারও ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে দেশে যাওয়ার কথা শুনে এয়ারপোর্টে পৌছে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন মুজিব ভাই। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশ থেকে ফিরে লক ডাউনের শুরুতে মুজিব ভাইর সাথে দেখা করি তার বাসায়। আর সেটাই ছিলো শেষ দেখা। এরপর ফোনে বার কয়েক কথা হয়েছে। হাসপাতালে যাওয়ার দিনও কথা বলেছি। শ্বাস কষ্টের কথা জানালেন অস্থির কন্ঠে। বললাম কাল বিলম্ব না করে হাসপাতালে যেতে। তারপর আর কথা হয়নি। জানাযা ও দাফনে অংশ নিয়েছি আমি ও আমার স্ত্রী। করোনাকালে সেটাই ছিলো প্রথম বাইরে যাওয়া একজন সুহৃদের জন্য। পাইন লন বিশালকায় কবরস্থান। বিশাল মনের মানুষের জন্য অত্যন্ত মানানসই। আমাদের প্রার্থনা, মহান আল্লাহ তা’য়ালা তার রূহের শান্তি নিশ্চিত করুন। বেহেশ্তে সর্বোচ্চ মর্যাদায় স্থান দিন তাকে। মুজিব চৌধুরী চলে গেছেন। রেখে গেছেন অনেক স্মৃতি। নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের মতো আমরাও স্মরণ করবো তাকে যুগ যুগ ধরে।

advertisement

Posted ১০:০২ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই ২০২০

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.