বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২১
সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাসের ওমিক্রন ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ দ্রুত বেড়ে চলেছে এবং নিউইয়র্ক সিটিতে গত বছরের শুরুতে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের প্রাথমিক দিনগুলোর চেয়েও বেশি এই সংক্রমণ হার। নিউইয়র্ক সিটিতে এক সপ্তাহ আগের চেয়ে করোনা সংক্রামিত রোগীর সংখ্যা চার গুণ বৃদ্ধি পেয়ে গত সোমবার আক্রান্তের সংখ্যা ১২,২৪৫ এ উন্নীত হয়, যার মধ্যে ৭৩ শতাংশের দেহে ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে এবং সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্টোল এন্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) তথ্য অনুযায়ী সংক্রমিতদের ৯২ শতাংশই ওমিক্রন পজিটিভ। সিটিতে করোনা রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বুধবার পর্যন্ত সিটির হাসপাতালগুলোতে করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি ছিল প্রায় ১,৫০০ জন। এখন দৈনিক গড়ে ২৭৯ জন করে করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে। সিটি মেয়র বিল ডি ব্লাজিও বলেছেন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি নতুন কোন বিধিনিষেধ আরোপ করতে চান না। কিন্তু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক, তা না হলে এর বিস্তার হ্রাস করা সম্ভব হবে না। তারা বলেছেন ভ্যাকসিন নেয়া নিশ্চিত করাই করোনা ভাইরাস বিস্তার রোধের একমাত্র কৌশল।
এদিকে নিউইয়র্কের এটর্নি জেনারেল লেটিশিয়া জেমস ‘ল্যাবকিউ ডায়ানস্টিকস’কে এই মর্মে সতর্ক করেছেন যে করোনা ভাইরাসের টেস্ট করতে আসা লোকজনকে তারা যাতে আশ্বাস না দেন যে টেস্টেও ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তারা ফলাফল জানাতে সক্ষম। কারণ অনেক ক্ষেত্রে টেস্ট করানোর পর ফলাফল আসতে ৯৬ ঘন্টার অধিক সময়ের প্রয়োজন হয়। তিনি সংশ্লিষ্ট টেস্টিং কোম্পানিকে তাদের ওয়েবসাইটে সঠিক তথ্য সংযোজন করার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে লোকজন টেস্ট নিয়ে বিভ্রান্ত না হয়।
পাবলিক হেলথ কর্মকর্তারা দক্ষিণ আফ্রিকার অভিজ্ঞতাআশঙ্কা করছেন যে আগামী কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত ওমিক্রন সংক্রমণ দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং এরপর তা কমে আসতে পারে। সিডিসি’র সাবেক ডাইরেক্টর ডা: টম ফ্রিডেন, যিনি ইতিপূর্বে নিউইয়র্ক সিটির হেলথ কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি বলেছেন, গত কয়েক সপ্তাহে নিউইয়র্কে যেভাবে ওমিক্রন সংক্রমণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে সেটিকে শুধু সংক্রমন প্রবাহ না বলে ‘আকস্মিক বন্যা’ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। মেয়র ব্লাজিও চলতি সপ্তাহের শেষ নাগাদ ২৩টি নতুন করোনা ভাইরাস টেস্টিং সেন্টার চালু করার ঘোষণা করেছেন। এছাড়া প্রেসিডেন্ট বাইডেন মঙ্গলবার ঘোষণা করেছেন যে, ফেডারেল সরকার সিটিতে নতুন টেস্টিং সেন্টার চালু করবে। গত কয়েক দিন যাবত সিটিতে দৈনিক প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার লোকের করোনা টেস্ট করা হচ্ছে। সিটি কর্তৃপক্ষ আরো ঘোষণা করেছে যে তারা পাঁচ লাখ হোম টেস্ট করার ব্যবস্থা করা ছাড়াও বিনামূল্যে ১০ লাখ ‘কেএন৯৫’ মাস্ক সরবরাহ করবে। সিটির সাবেক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: আইজাক ওয়েসফিউজ এ উদ্যোগকে সমুদ্রে এক ফোটা পানির মত বলে বর্ণনা করেছেন।
নবনির্বাচিত মেয়র এরিক অ্যাডামস মঙ্গলবার বলেছেন যে ওমিক্রন সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষিতে তিনি তার ইনডোর অভিষেক অনুষ্ঠান বাতিল করছেন। তবে এখন পর্যন্ত টাইমস স্কোয়ারের থার্টি ফার্ষ্ট নাইট উৎসব বাতিল করা সংক্রান্ত কোন ঘোষণা দেওয়া হয়নি। পাবলিক হেলথ এক্সপার্ট প্রফেসর শ্যামন বলেছেন যে লোকজন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা নিয়ে ক্লান্ত ও ত্যক্তবিরক্ত হয়ে পড়েছে এবং তাদের পক্ষে নতুন বিধিনিষেধ মেনে নেয়া কঠিন। তা সত্বেও সংক্রমনের বিস্তার রোধ করার জন্য সিটি কর্তৃপক্ষের উচিত আরো কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা, যার মধ্যে লোকজনকে সম্ভব হলে বাড়ি থেকে কাজ করতে উৎসাহিত করা এবং সাময়িকভাবে সিটির স্কুলগুলো বন্ধ ঘোষণা করা। জেপি মরগ্যান চেজ, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমসসহ অনেক কোম্পানি তাদের কর্মীদের পুরো ডিসেম্বর মাস বাড়ি থেকে কাজ করার নির্দেশ প্রদান করেছে।
নিউইয়র্ক সিটিতে নতুন সংক্রমনের সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে গ্রীনউইচ ভিলেজ/সোহোতে, যেখানে প্রতি এক লাখ লোকের মধ্যে ২০০ জনের কম নতুন রোগী ছিল, সেখানে গত মঙ্গলবার প্রতি লাখে সংক্রমিত হয়েছে ২,৪৮৯ জন। এছাড়া গ্রামারসি পার্ক, মারে হিল, চেলসিয়া, লোয়ার ম্যানহাটান, ব্রুকলিনের গ্রীনপয়েন্ট এলাকায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত পাওয়া গেছে। মেয়র ব্লাজিও’র একজন সিনিয়র এডভাইজার ডা: জয় বর্মা মঙ্গলবার এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যেকোন সংক্রামক ব্যাধির বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিউইয়র্ক সিটি সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে। কারণ এই সিটিতে আন্তর্জাতিক পর্যটন ঘনত্বে দিক থেকে শীর্ষ সিটি, যে কারণে গত বছর করোনা ভাইরাস সংক্রমনের ক্ষেত্রে সিটির অবস্থা খুবই নাজুক ছিল এবং ওমিক্রন সংক্রমনের বেলায়ও তার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। তিনি বলেন, নিউইয়র্ক সিটিতে ভ্যাকসিন দেওয়ার হার যুক্তরাষ্ট্রের গড় হারের চেয়ে অনেক বেশি হওয়া সত্বেও ভাইরাসের বর্তমান বিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়নি। কারণ ওমিক্রন ভ্যাকসিনের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন। তবুও ভ্যাকসিন ভাইরাসে ঘাতক প্রবণতা হ্রাস করবে, বিশেষ করে ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ সংক্রমনের গুরুতর অবস্থাকে লাঘব করতে ভূমিকা রাখবে। নিউইয়র্ক স্টেটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ১৭ ডিসেম্বর সেখানে ২১ হাজার ২৭ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হলেও পরদিন গত ১৮ ডিসেম্বর এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২১ হাজার ৯০৮। নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, কয়েক সপ্তাহ ধরে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে অনেকে বড়দিনের ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা বাতিল করেছেন, কেউ কেউ করোনা পরীক্ষা করছেন। বর্তমানে শনাক্তের হারও অনেক বেড়েছে বলে জানিয়েছেন রাজ্যের কর্মকর্তারা। নিউইয়র্কে গত ২২ সেপ্টেম্বর করোনা শনাক্তের হার ছিল ২ দশমিক ৬ শতাংশ, বর্তমানে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশে। গত ১৭ ডিসেম্বর এক দিনে ৩ হাজার ৯০৯ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। আগের দিনের চেয়ে এ সংখ্যা ৭০ বেশি।
নিউইয়র্কের গভর্নর ক্যাথি হকুল গত ১৮ ডিসেম্বর বলেন, সবাইকে টিকার আওতায় নিয়ে আসার অংশ হিসেবে রাজ্যজুড়ে ৪০টি অস্থায়ী টিকাদান কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। টিকাদান জোরদার করাকে গুরুতর অসুস্থ হওয়া ও মৃত্যু থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন মহামারি বিশেষজ্ঞরা। এক বিবৃতিতে গভর্নর বলেন, ‘আমরা শীত মৌসুমে করোনার নতুন ঢেউয়ের জন্য প্রস্তুত, কারণ আমাদের হাতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম রয়েছে। মাস্ক পরা, টিকার বুস্টার ডোজ নেওয়া করোনার কারণে গুরুতর অসুস্থতার হাত থেকে বাঁচাতে পারে।’ নিউইয়র্কে করোনা সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি টম্পকিনস কাউন্টিতে। নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্য অনুযায়ী, ১৪ দিন আগের তুলনায় এই কাউন্টিতে সংক্রমণ ৬৪০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বর্তমানে এ কাউন্টির ১ লাখ মানুষের মধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন ২২৪ জন। এ কাউন্টিতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর বসবাস। গত ১৫ ডিসেম্বর স্থানীয় ইথাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, ২৪ ঘণ্টায় সেখানে উল্লেখযোগ্য হারে সংক্রমণ বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসে অপরিকল্পিতভাবে জমায়েত হতে শিক্ষার্থীদের জোরালোভাবে নিরুৎসাহিত করছে তারা। স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে গ্র্যাজুয়েটদের একটি অনুষ্ঠান বাতিল করেছে কর্নেল ইউনিভার্সিটি। বেশ কিছু শিক্ষার্থীর নমুনা সংগ্রহ করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা পরীক্ষাগারে টেস্টে তাঁদের অনেকের শরীরে অমিক্রন শনাক্ত হওয়ায় প্রমাণ পাওয়া গেছে। সংক্রমণের লাগাম টানতে রাজ্যজুড়ে মাস্ক পরা গত সপ্তাহে বাধ্যতামূলক করেন গভর্নর ক্যাথি হকুল।
Posted ১০:৫৫ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh