মন্তব্য প্রতিবেদন : | বৃহস্পতিবার, ০২ জুলাই ২০২০
নিউইয়র্ক ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারীতে বাংলাদেশী আমেরিকান প্রার্থীরা কেন পিছিয়ে? কেনইবা তাদের অনেকে জয়লাভ করতে পারলেন না। এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে। পোষ্ট মর্টেম চলছে নেপথ্যের কারণ উদঘাটনের। এসব অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে প্রার্থীদের দুর্বলতা সহ নানাদিক। যদিও অ্যাবসেন্টি ভোটের কারণে পূর্ণাঙ্গ ফলাফল ঘোষিত হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নির্বাচনের বছর ২০২০ সাল। আগামী ৩ নভেম্বর মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হবে এই নির্বাচন। কেন্দ্রীয়ভাবে হবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, ইউএস কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের সবক’টি এবং সিনেটের এক তৃতীয়াংশ আসনে অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন। এছাড়া অনেক রাজ্যের গভর্নরও আইন সভা সহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সাধারণ নির্বাচনে মূলত ডেমোক্র্যাটিক এবং রিপাবলিকান প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে থাকে। প্রথানুযায়ী এর আগে উভয় দলের অভ্যন্তরে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীদের মাঝে চলে বাছাই প্রক্রিয়া বা প্রাইমারী। ফলে প্রাইমারী নির্বাচনে সাধারণ নির্বাচনের জন্য নিজ দলীয় প্রার্থীতা চূড়ান্ত করা হয়। প্রাইমারী নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে আসনে যে রাজনৈতিক দলের প্রাধান্য রয়েছে সেই আসনে প্রাইমারীতে যিনি নির্বাচিত হন তিনিই শেষ পর্যন্ত জয়ী হন সাধারণ নির্বাচনে। প্রতিটি রাজ্যে পৃথক দিনক্ষণে অনুষ্ঠিত হয় প্রাইমারী। নিউইয়র্ক রাজ্যে প্রাইমারী অনুষ্ঠিত হয় গত ২৩ জুন, মঙ্গলবার। এই নির্বাচন ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান উভয় দলের জন্যই প্রযোজ্য ছিলো। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প একক প্রার্থী হওয়ায় প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাইমারী হয়নি রিপাবলিকান পার্টিতে। পক্ষান্তরে আদালতের নির্দেশে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ডেলিগেট নির্বাচিত করা হয়েছে ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারীতে। যারা দলটির জাতীয় সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী চূড়ান্ত করবেন। তবে একাধিক প্রার্থী রয়েছে এমন আসন সমূহে উভয় দলের প্রাইমারী অনুষ্ঠিত হয় ২৩ জুন।
নিউইয়র্ক রাজ্যে ডেমোক্র্যাটদের প্রাধান্য থাকায় দলটির প্রাইমারী বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী তথা সংখ্যালঘুদের সিংহভাগই ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থক। বাংলাদেশী অভিবাসীরা এর বাইরে নয়। নিউইয়র্ক সিটি এবং স্টেটের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী বাংলাদেশীরা মূলধারার রাজনীতিতে তেমন সরব না হলেও ক্রমান্বয়ে সক্রিয় হচ্ছেন। বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির কর্মকান্ডের সাথে। মূলত আশির দশক থেকে বাংলাদেশীদের অভিবাসন বাড়তে থাকে যুক্তরাষ্ট্রে। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও অনুমান করা হয় গত চার দশকে গোটা যুক্তরাষ্ট্রে এ সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। নূতন অথচ দ্রুত বর্ধিষ্ণু বাংলাদেশী অভিবাসীদের প্রথম এবং দ্বিতীয় প্রজন্ম জীবন-জীবিকার সংগ্রামে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছেন ঐকান্তিক ভাবে। কঠিন শ্রমের বিনিময়ে নিজেরা একটা অবস্থানে পৌছার চেষ্টা করছেন নিরন্তর। পাশাপাশি চেষ্টা করেছেন নিজ সন্তানদেরকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে। এর ধারাবাহিকতায় নূতন প্রজন্মের সন্তানদের অনেকেই ব্যবসায় বাণিজ্য এবং পেশাগত ক্ষেত্রে ভালো করছে, সফলকাম হচ্ছে। ভবিষ্যত আশার আলো এরাই দেখাচ্ছে কমিউনিটিকে। বাংলাদেশী অভিবাসী সমাজে এখনো ঢেড় অভাব ঐক্যের। অভাব সঠিক ও দূরদর্শী নেতৃত্বের। অভাব উদার মন-মানসিকতা ও পারস্পরিক সহমর্মিতার। প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীরা স্বদেশী রাজনীতির পিছুটান থেকে এখনো নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারেনি। ফলে তারা এখনো আটকে আছে অনৈক্যের বেড়াজালে। বিশেষ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও আঞ্চলিক সংগঠনের নেতৃত্বের কোন্দল দুর্বল করে দিচ্ছে কমিউনিটিকে।
মূলধারার রাজনীতি করলেও যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই অনেকেরই। অতীতে স্টেট এবং সিটি পর্যায়ের বিভিন্ন পদে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী আমেরিকান নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের অনেকেই রাজনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেননি। এসব নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। অতীতমুখী এ রাজনীতি ও সমালোচনা থেকে সরে আসতে হবে কমিউনিটিকে। আর এ কাজটিই এখন শুরু করেছে নূতন প্রজন্ম। যারা এদেশে পড়াশুনা করছে। এদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পোষণ করে। যারা বাংলাদেশী কমিউনিটির বিভিন্ন সংগঠন রাজনীতি থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ দূরত্বে রেখেছে। যারা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ধারণ করে অন্তরে। নূতন প্রজন্মের এমন অনেকেই এবার প্রার্থী হয়েছে নিউইয়র্ক রাজ্যব্যাপী অনুষ্ঠিত ডেমোক্রেটিক প্রাইমারীতে। এ নির্বাচনে তারা সফলকাম না হতে পারলেও ক্ষীণ আশার আলো জাগিয়েছে বৈকি? বিষয়টিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে না দেখে নির্বাচনে তাদের বিপর্যয়ের কারণগুলো উদঘাটন করতে হবে। সেভাবেই আমেরিকান প্রার্থী হিসেবে প্রস্তুত করে তুলতে হবে তাদেরকে। এজন্য কমিউনিটিকে পালন করতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
বাংলাদেশী আমেরিকান প্রার্থীদের কেন এ বিপর্যয়
মিশিগান, জর্জিয়া, পেনসিলভেনিয়া সহ কয়েকটি রাজ্যে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী আমেরিকান স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত হয়েছেন। নিউইয়র্কেও ভবিষ্যতে জনপ্রতিনিধির তালিকায় নাম উঠবে বাংলাদেশীদের। এমন প্রত্যাশা সবার। এজন্য প্রয়োজন সময় ও সুযোগ্য প্রার্থী। ভবিষ্যতে যারা প্রার্থী হবে তাদেরকে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে কমিউনিটির বয়স ও কলেবর এবং নির্বাচনী এলাকায় অভিবাসীদের সংখ্যানুপাত। নিউইয়র্ক সিটিতে প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষের বাস। সরকারী পরিসংখ্যানে এখানে ১৪ শতাংশ এশিয়ানের বসবাস। তন্মধ্যে বাংলাদেশীদের সংখ্যা এখনও এক শতাংশের কম। কাজেই শুধুমাত্র বাংলাদেশী বা এশিয়ানদের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ নেই। এজন্য বাংলাদেশী কমিউনিটি বা নেতৃবৃন্দকে দোষারোপ করে লাভ হবে না। এ নির্বাচনে জাতীয়তা, ধর্ম বা বর্ণের দোহাই দেয়াও যুক্তিযুক্ত নয়। আর সব বাংলাদেশীই তাদেরকে ভোট দেবে এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। কে কাকে ভোট দিবে। কোন কমিউনিটি নেতা কার পক্ষে যাবে এ নিয়ে সমালোচনা করাও ঠিক নয় গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়। তবে নিজ কমিউনিটিতে অবশ্য যে কোন প্রার্থী ভোট দাবি করতে পারেন। চূড়ান্ত বিচারে নিজ যোগ্যতা বলেই ভোট আদায় করতে হবে প্রার্থীকে।
রাজনীতি করতে হলে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার প্রয়োজন নেই। গণতন্ত্রের ধারা যেমন নীচ থেকে উপরের দিকে ধাবিত হয়। রাজনীতির শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের বিষয়টিও তদ্রুপ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি রাজনীতি চর্চা এবং এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা অজর্নের কোন বিকল্প নেই। আমেরিকান রাজনীতিতে এ প্রথা বরাবরই চলমান। একবারে তৃণমূল থেকে শুরু করে রাজনীতিকরা ধাপে ধাপে উপরের দিকে অগ্রসর হন। আর একবার বিফলকাম হলেই নির্বাচনের ময়দান ছেড়ে নিরুদ্দেশ হন না তারা।
কিন্তু আমাদের কমিউনিটিতে ঘটছে এর উল্টোটা। নির্বাচনের মৌসুমে হঠাৎ করেই অনেকে প্রার্থীতা ঘোষণা করেন। কোন ধরণের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং হোম ওয়ার্ক ছাড়াই বাঘা-বাঘা প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান। ডেমোক্রেটিক পার্টিতে যারা দীর্ঘদিন কাজ করে এ পর্যায়ে পৌছেছেন তাদের সাথে লিপ্ত হন প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।এদেশে রাজনৈতিক দল গুলো একেকটি প্রতিষ্ঠান। একটা সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় চলে দলগুলোর কর্মকান্ড। তবে যে কেউ নূন্যতম সমর্থন নিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন। এ ধরণের প্রার্থীরা অনেক বাংলাদেশী ডেমোক্রেট নেতাকে বিপাকে ফেলে দেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে সকল ধর্ম-বর্ণ, জাতি ও কমিউনিটির ভোট এবং সমর্থন প্রয়োজন। শুধুমাত্র বাংলাদেশী কমিউনিটির ভোটে জয়লাভ করা যাবে না। যেকোন পর্যায়ে নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলে অবশ্যই তাকে নিজ কমিউনিটিতে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করতে হবে আগে থেকেই। এদেশে নির্বাচন হয় ইস্যু ভিত্তিক। কমিউনিটির মানুষের সাথে মিশতে হবে। টাউন হল মিটিংয়ের মাধ্যমে সম্ভাব্য প্রার্থীরা কমিউনিটিকে সচেতন করবে মূলধারার রাজনীতি ও ভোটাধিকার সম্পর্কে। প্রাইমারী নির্বাচন কি? কবে ভোটার নিবন্ধন করতে হবে এসব জানাতে হবে সাধারণ মানুষকে। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির মানুষের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে নিজেদেরকে। হোম ওয়ার্ক করে বের করতে হবে কোন নির্বাচনী এলাকায় কোন জাতি গোষ্ঠির মানুষের বসবাসের হার কত। এবারের নির্বাচনে কুইন্সে অংশ নিয়েছেন অধিকাংশ প্রার্থী। যেমন কুইন্সের এসেম্বলী ডিস্ট্রিক্ট-২৪ এ ৪০ শতাংশ এশিয়ানের বসবাস। তন্মধ্যে ১৮ শতাংশ বাংলাদেশী। এটা বাংলাদেশী প্রার্থীর জন্য একটি উর্বর এলাকা। প্রাইমারীতে ভোট প্রদানের হার অত্যন্ত কম। সুতরাং এখানে বাংলাদেশীদেরকে ভোটার বানানো এবং তাদেরকে ভোট কেন্দ্রে যেতে উৎসাহিত করতে পারলে তা ভালো ফলাফল বয়ে আনতে পারতো। কিন্ত এলাকার বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত একজন হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেছেন। কমিউনিটির সাধারণ মানুষ এমনকি বাংলাদেশী মিডিয়ার সাথেও কোন যোগাযোগ করেননি তিনি। এ আসনে একজন শক্তিশালী এবং বর্তমান এ্যাসেম্বলিম্যানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য যে ধরণের প্রচারণা বা প্রস্তুতি প্রয়োজন ছিলো তা লক্ষ্য করা যায়নি।
নিউইয়র্ক কংগ্রেশনাল ডিস্ট্রিক্ট-৫ এ একজন জাদরেল কংগ্রেসম্যানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এক তরুণ। তার নির্বাচনী এলাকা বাছাই ছিলো যথার্থ। এই এলাকায় ৪০ শতাংশ এশিয়ানের বসবাস। ভোটও পেয়েছেন তিনি ভালো। তবে বর্তমান এ কংগ্রেসম্যানকে পরাজিত করার মত অভিজ্ঞতা বা কৌশলের অভাব ছিলো তার। নিজ কমিউনিটির সাথে নুন্যতম সম্পৃক্ততা না রেখে শুধু কমিউনিটির মানুষকে দোষারোপ করা ঠিক নয়। এমন ঘটনা প্রায় প্রতিটি প্রার্থীর ক্ষেত্রেই ঘটেছে। তারপরও অনেকে ভালো ফলাফল করেছেন।
ভবিষ্যতে যারা প্রার্থী হতে চান তাদেরকে রাজনীতির ময়দানে থাকতে হবে সার্বক্ষণিক। বিভিন্ন ইস্যুতে পাশে দাঁড়াতে হবে কমিউনিটির মানুষের। বছর কয়েক আগে থেকেই হোম ওয়ার্ক করে সেভাবে নিতে হবে প্রস্তুতি। নির্বাচন হলো কৌশলের খেলা। শুধু ভোট ব্যাংকের হিসেব কষে নির্বাচনে জয়ী হওয়া যায়না। কংগ্রেসে নির্বাচন করতে হলে বাংলাদেশী আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নির্বাচনী কৌশল কাজে লাগানো যাবে না। আঞ্চলিক সংগঠন ও কংগ্রেসে নির্বাচনকে এক পাল্লায় মাপা ঠিক নয়। এসব নির্বাচনে জয়ী হতে হলে নিজ মেধা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং সামষ্টিক জনসমর্থন প্রয়োজন। নূতন প্রজন্মের সন্তানরা সে পথেই এগোবে এমন প্রত্যাশা বাংলাদেশী অভিবাসী কমিউনিটির। এবারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিবে তারা।
Posted ১১:৩৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০২ জুলাই ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh