বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২২
নিউইয়র্ক সিটিতে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে চলেছে অপরাধ। সাবওয়ে, বাস, রাস্তাঘাট এবং একসময়ের শান্ত, নিরাপদ নেইবারহুডগুলোতেও হত্যা, ধর্ষণের মতো অপরাধ ঘটছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অপরাধীদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, সন্দেহভাজন অপরাধীদের গ্রেফতার করার পর যখন আদালতে হাজির করা হয়, আদালত অপরাধীদৈর জামিন দিয়ে দেয়। এতে একদিকে পুলিশ অপরাধী গ্রেফতার করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে, অপরদিকে জামিন পেয়ে অপরাধীরা আরো উৎসাহে অপরাধকর্মে নিয়োজিত হয়। নিউইয়র্ক সিটির কোনো কাউন্টিকেই এখন আর নিরাপদ এলাকা বলে ধরে নেওয়া যায় না। যেসব এলাকা আগে নিরাপদ পদে প্রশংসিত হতো এবং যেসব এলাকার নিরাপত্তার প্রতি কোনো হুমকি নেই বলে ধারণা করা হতো, এখন আর কারও পক্ষে বলা সম্ভব হচ্ছে না যে সিটির কোন এলাকায় নিñিদ্র নিরাপত্তা বজায় রয়েছে। এখন সিটির প্রতিটি কাউন্টির প্রায় প্রতিটি নেইবারহুড অপরাধীদের নেটওয়ার্কের আওতায়। যখন তখন তারা যেকোনো অঘটন ঘটাতে পারে এবং কার্যত তা ঘটিয়ে চলেছে। ব্রুকলিনের সাইপ্রেস হিলস এলাকার ফুলটন স্ট্রিটে একটি পরিবার ১৩ বছর যাবত বসবাস করে আসছিলেন। পরিবারের ক্রিস্টাল শিমেল, যিনি সন্তান লালন থেকে পরিবারের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তার মতে, “এলাকায় অপরাধ এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে আমাকে এ স্থান ছেড়ে অন্য স্থানে চলে যেতে হবে, যাতে আমার আট বছর বয়সী পুত্রকে অপরাধ তৎপরতার দেখে বা কোনো অপরাধ ঘটনা শুনে বেড়ে ওঠতে না হয়। কিন্তু কোথায় যাব, সর্বত্র একই অবস্থা বিরাজ করছে।” তার ১৪ বছর বয়সী আরেকটি ছেলেও আছে। এনওয়াইপিডি’র ৭৫ পিসিঙ্কটের আওতাধীন ব্রুকলিনের সাইপ্রেস হিল এলাকাকে গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে সিটির অপরাধ সংঘটনের গুরুতর শ্রেনির মধ্যে ফেলা হয়েছে।
মিসেস শিমেল যেখানে বাস করেন, সেই ফুলটন স্ট্রিটে অথবা কাছাকাছি স্থানে এ বছর অন্তত ১৬টি গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ এলাকায় দু’জন নারীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, খন্ডবিখন্ড অবস্থায়। পুলিশের তদন্তকারী দল যখন আলামত সংগ্রহ করছিল, তখন মিসেস শিমেলের বড় ছেলে ইয়ান একটি খন্ডিত অঙ্গ দেখতে পায় বলে জানিয়েছে। পরিবারটিতে ভীতি এমনভাবে ছড়িয়েছে যে পরিবারের কোনো সদস্য এখন বিকেল ৫টার পর ঘর থেকে বের হয় না। যখন বাইরে থাকে তখন ফোনে কথা বলেন না। কারণ তিনি ভয়ে থাকেন যেকোনো সময় কেউ তার ফোন নিয়ে দৌড় দিতে পারে। তিনি তার অর্থ আর ওয়ালেট বা হাতব্যাগে রাখেন না, বরং স্যান্ডউইচ ব্যাগে ভরে সেটি জামার মধ্যে গুঁজে রাখেন।
করোনা ভাইরাস মহামারী শুরুর আগে নিউইয়র্ক সিটিতে অপরাধ তৎপরতার হার বিগত বছরগুলোর চেয়ে বেশ নিচু ছিল, কিন্তু মহামারীর চরম কাল থেকে সিটিতে অপরাধ যেভাবে বেড়ে চলেছে, তার লাগাম টেনে ধরা সিটি পুলিশের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত আগস্ট মাসে পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যান মূল্যায়ন করলে দেখা যায় যে, গুরুতর অপরাধ বলতে এনওয়াইপিডি যেসব অপরাধকে বিবেচনা করে, যেমন হত্যা, ধর্ষণ, দস্যুবৃত্তি, গাড়ি চুরি ইত্যাদি গত বছরের ওই সময়ের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেড়েছে। যদিও পুলিশ বিভাগ আত্মতৃপ্তি অনুভব করছে যে ৯০ এর দশকের তুলনায় নিউইয়র্ক সিটি এখন অনেক নিরাপদ। তখনকার চেয়ে হত্যাকান্ড কমেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য বড় বড় সিটিতে এখনো যে হত্যাকান্ড ঘটে তার চেয়ে নিউইয়র্ক সিটিতে হত্যার ঘটনা কমেছে।
সাবওয়েতে ভ্রমণ করা যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে এবং সাবওয়ের অপরাধ ঘটনা বন্ধ করতো অথবা কমাতে পুলিশ যে শুধু হিমসিম খাচ্ছে তা নয়, বরং ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। অপরাধ এখন আর দরিদ্র এলাকাগুলোতে সীমাবদ্ধ নেই, সকল শ্রেনির বসবাসের এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে।
সাবওয়ের নিরাপত্তা ভেঙে পড়েছে, যাত্রীরা আতঙ্কে
নিউইয়র্ক সিটিতে যাতায়াতের সবচেয়ে নিরাপদ মাধ্যম সিটি সাবওয়েকে কিছুতেই নিরাপদ করতে পারছে না সিটি পুলিশ বিভাগ। গত সপ্তাহে সাবওয়েতে দু’জন যাত্রীকে হত্যা করার ঘটনা ঘটায় সাবওয়ে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর সাবওয়েতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মোট সাত জন। গত বৃহস্পতিবার সাবওয়েতে দুর্বৃত্তদের দ্বারা যাত্রীদের ওপর মোট তিনটি ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে এবং কোনো ঘটনাই পূর্ব উস্কানিমূলক ছিল না বলেই তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। এভাবে চলতে থাকলে সাবওয়ের যাত্রীসংখ্যা আরো হ্রাস পেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সিটি সাবওয়ে পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত মেট্টোপলিটান ট্রানজিট অথরিটি (এমটিএ)। উল্লেখ্য, করোনাকালে সাবওয়ের যাত্রীসংখ্যা যে হারে হ্রাস পেয়েছে তা এখন পর্যন্ত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।
গত বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্কসে সাবওয়ের একটি ট্রেনে কোনো ধরনের উস্কানি ছাড়াই দুর্বৃত্তদের হাতে একজন যাত্রী নিহত হওয়ার ঘটনার উল্লেখ করে নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কমিশনার কীচ্যান্ট সিওয়েল সাবওয়ের নিরাপত্তা জোরদার করার আহবান জানিয়েছেন। গত শুক্রবার পুলিশ কমিশনার কীচ্যান্ট সিওয়েল সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, সাবওয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের আরো প্রবল উদ্যোগ নিতে হবে এবং আমরা তা অবশ্যই করবো।”
ব্রঙ্কসে সাবওয়ের ‘ফোর’ ট্রেনে গত ৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে রাত সাড়ে আটটায়। ব্রঙ্কসের ১৭৬ স্ট্রিট স্টেশনে ট্রেন থামলে ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে নেমে যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে কালো রঙের হুডসহ সোয়েটশার্ট পরিহিত এক ব্যক্তি বড় আকৃতির ছুরি দিয়ে অপর এক যাত্রীর বুকে ও পিঠে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকে এবং স্টেশনে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ৈ পালিয়ে যায়। সাবওয়ের ইমার্জেন্সি কর্মীরা গুরুতর আহত চার্লস মুরকে (৩৮) সেন্ট বার্নাবাস হসপিটালে স্থানান্তর করে, যেখানে তার মৃত্যু ঘটে। হত্যাকান্ডে জড়িত সন্দেহে পুলিশ ব্রঙ্কসের স্যাকুয়ান লেমনস নামে সাতাশ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তাকে গ্রেফতারের জন্য অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
ট্রানজিট ব্যুরোর প্রধান জেসন কে উইলফক্স সাবওয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার উদ্দেশ্যে ট্রেনে ও প্ল্যাটফর্মে টহল দেওয়ার জন্য পুলিশ বিভাগ ট্রেনিং ইউনিটকে কাজে লাগাবে। ডেমোক্রেট নিয়ন্ত্রিত নিউইয়র্ক সিটিতে, বিশেষ করে সাবওয়েতে সহিংস ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রিপাবলিকানরা এটিকে জনরিাপত্তা ভেঙে পড়ার দৃষ্টান্ত হিসেবে ডেমোক্রেট বিরোধী প্রচারণায় কাজে লাগাচ্ছে। গত শুক্রবার নিউইয়র্ক স্টেটের গভর্নর পদের জন্য রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী লী জেলদিন ব্রঙ্কসে সংঘটিত হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে অপরাধ বিরোধী আইনকে আরো কঠোর করা এবং পুলিশ বিভাগে আরো অধিক সম্পদ জোগান দেওয়ার আহবান জানান। তিনি বলেন, আইন প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন অধিক পরিমাণে সম্পদ ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনশক্তি।
ব্রঙ্কসে ছুরিকাঘাতে বাসযাত্রী হত্যা, অভিযুক্ত মহিলা গ্রেফতার
গত ৯ অক্টোবর রোববার ব্রঙ্কসে যাত্রীবাহী বাসে এক মহিলা ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে বাসের অপর এক যাত্রীকে। ঘাতক মহিলাকে পরদিন সোমবার গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে গত ৮ বছরের মধ্যে এ ঘটনা ছিল সিটি বাসে হত্যার প্রথম ঘটনা এবং ২০০০ সাল থেকে এ যাবত বাসে সংঘটিত ৬ষ্ঠ হত্যাকান্ডের ঘটনা বলে সিটি মেট্টোপলিটান ট্রান্সপোর্টেশন অথরিটির (এমটিএ) একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। জানা গেছে, রোববার রাত সাড়ে আটটার দিকে ব্রঙ্কসের মট হ্যাভেনে ১৪৯ স্ট্রিট ও জেরার্ড এভিনিউয়ের কাছে অভিযুক্ত মহিলা বাস যাত্রী এবোনি জ্যাকসন (৪২) ও তার সঙ্গী অপর ব্যক্তি লেমন্ট বার্কেলি (৫৫) নামে এক যাত্রীর সঙ্গে এক বচসায় লিপ্ত হয় এবং এক পর্যায়ে বার্কেলির বুকে ছুরিকাঘাত করে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছার আগেই এবোনি জ্যাকসন ও তার সঙ্গী পালাতে সক্ষম হয়। ছুরিকাঘাত প্রাপ্ত ব্যক্তিকে লিংকন হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
এবোনি জ্যাকসন ও তার সঙ্গী যাকে ছুরিকাঘাত করে, তিনি তাদের পূর্ব পরিচিত কিনা এবং কী কারণে তাদের মধ্যে বচসা হয়েছে সে সম্পর্কে পুলিশ কোনো তথ্য জানাতে পারেনি। করোনা ভাইরাস মহামারী চলাকালে সিটির সাবওয়েতে অপরাধ সংঘটনে আতঙ্কের কথা বলা হচ্ছিল এবং বাসে এ ধরনের ঘটনার আশঙ্কা কম বলে সকলে ধারণা পোষণ করছিল। কিন্তু গত রোববারের ঘটনা নিয়মিত বাসযাত্রীদের উৎকণ্ঠিত করে তুলেছে। চলতি বছর সাবওয়ে ট্রেনে ৭ জন নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে আরো অনেক বেশি।
Posted ৩:১২ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh