বাংলাদেশ ডেস্ক : | বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন ২০২৩
নিউইয়র্কের অন্যতম বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা ব্রুকলিনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ড এভিনিউয়ের উভয় পাশে এবং নিকটস্থ এলাকা সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাংলাদেশিদের পদচারনায় ও গুঞ্জনে মুখর থাকে। কথাবার্তায় তারা ইংরেজির চেয়ে বেশি বাংলা ব্যবহার করে। সেখানকার বাতাসে পাওয়া যায় ঘন দুধে তৈরি চায়ের সুবাস। চার্চ ম্যাকডোনাল্ড এভিনিউ হয়ে উঠেছে “লিটল বাংলাদেশ।” সেখানে বাংলাদেশি কমিউনিটি বর্ধিষ্ণু এবং ক্রমবিকাশমান।
কয়েক দশক ধরেই কেনসিংটনের বাংলাদেশি কমিউনিটির কাজ ও ব্যবসা ছিল নির্মাণ কেন্দ্রিক। এখন তাদের কাজের ক্ষেত্র বহুবিধ। কাজ শেষে বাংলাদেশিরা শেয়ার করে থাকা অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে ভিড় করে চার্চ ম্যাকডেনাল্ড এভিনিউয়ে, অনানুষ্ঠানিক আড্ডায়, কখনো আনুষ্ঠানিক সমাবেশে। স্ন্যাকস মুখে পুড়ে, চায়ের কাপে চুমুক দেয় এবং উচ্চকণ্ঠে কথা বলে। এখানে বাংলাদেশিদের পদচারনা শুরু হয়েছে সত্তরের দশকের প্রথম দিক থেকে। যারা একসময় ছোটোখাটো কাজ করে জীবিকার সংস্থান করতো, তারা এখন ব্যবসা করছে, রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে এবং নিজেদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের সুব্যবস্থাও আছে তাদের।
গতকাল ১৪ জুন নিউইয়র্ক টাইমসে “অ্যা লুক অ্যাট ব্রুকলিন’স লিটল বাংলাদেশ” শিরোনামে জোনাহ মার্কোউইটজের ফটোগ্রাফি এবং কারেন জ্রাইক ও সামিরা আসমা সাদেক” এর তৈরি রিপোর্টের সূচনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, চার্চ ম্যাকডোনাল্ডের বাংলাদেশি কমিউনিটির ওপর একটি বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরির উদ্দেশ্যে ফটোগ্রাফার জোনাহ মার্কোউইটজ দুই বছরের অধিক সময় যাবত বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে কাজ করেছেন এবং পরবর্তীতে লেখার কাজের জন্য অপর দুজন তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নিউইয়র্ক সিটিতে বাংলাদেশিদের সংখ্যা এক দশক আগের চেয়ে একজন তিন গুণ বেড়ে এক লাখের অধিক হয়েছে। নবাগতরা সিটির বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাদের আগমণে সিটিতে অন্যান্য কমিউনিটির চেয়ে এশিয়ানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন তারা একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। গত অক্টৈাবর মাসে কেনসিংটনের একটি ছোট্ট এলাকাকে সরকারিভাবে ‘লিটল বাংলাদেশ’ নামকরণ করা হয়েছে, যা নিয়ে বাংলাদেশি অভিবাসীরা গর্ব অনুভব নকরে। নবাগত বাংলাদেশিরাও তাদের স্বগোত্রীয়দের কারণে এখানে জড়ো হয় কাজের সন্ধানে, মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের তালাশে ও বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। অনলাইন নিউজ সাইট পরিচালনাকারী বাংলাদেশি সাংবাদিক সোহেল মাহমুদ বলেছেন, “দেখাসাক্ষাতের জন্য এখানে সবাই আসছে, পাশাপাশি আগামীকালের কথাও তাদের ভাবতে হচ্ছে।”
তরুণ বাংলাদেশি-আমেরিকানরা রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসছে এবং সবচেয়ে উল্লেখ করার বিষয় হচ্ছে ২০২১ সালে সিটি কাউন্সিলে কেনসিংটনের কন্যা শাহানা হানিফের নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা। ত্রিশ বছর বয়সে কাউন্সিলওম্যান পদে তার বিজয় লাভ তাকে ওই এলাকা থেকে সিটিতে প্রতিনিধিত্ব করার প্রথম নারী এবং কাউন্সিলে দু’জন সাউথ এশিয়ান নারীর মধ্যে সর্বপ্রথম কোনো মুসলিম নারীর নির্বাচিত হওয়ার গৌরবের অংশীদার করেছে। শাহানা হানিফ কেনসিংটনের কোণার অংশটির নাম ‘লিটল বাংলাদেশ’ করার প্রস্তাব করেছিলেন। এছাড়া তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে নিউইয়র্ক সিটিতে ছুটি ঘোষণার একটি প্রস্তাব করেছেন।
শাহানা হানিফের বাবা আশির দশকের শুরুর দিকে নিউইয়র্কে এসে ব্রুকলিনের কেনসিংটন এলাকায় বসবাস শুরু করেন। তার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল কন্সট্রাকশনের কাজ ও রেন্টুরেন্টে কাজের মধ্য দিয়ে এবং পরবর্তীতে তিনি তার নিজস্ব রেস্টুরেন্ট শুরু করেন “রাঁধুনী সুইটস এন্ড রেস্টুরন্ট”, যেটি এখন অন্যেরা পরিচালনা করেন। শাহানা হানিফের অভিজ্ঞতাই তাকে উদ্বুদ্ধ করে এমন একটি স্থান গড়ে তুলতে, যেখানে কমিউনিটির লোকজন নিজেদের স্বাগত অনুভব করতে পারে। জায়গাটিতে প্রায়ই পুরুষদের প্রাধান্য থাকে, সেজন্য তিনি এবং অন্যান্য বাংলাদেশি আমেরিকান নারী সেখানে তাদের নিজস্ব স্থান বের করে নিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমি যেভাবে বেড়ে উঠেছি, একটি স্থানে লেখা ছিল, ‘একটি চাদরে বুক ঢেকে রাখো এবং দৃষ্টি নত করো,’ আমার মনে হয়, আমাদের অনেকে সেই বাণী অনুসরণ করেনি এবং আমরা আমাদের নিজস্ব পথ করে নিয়েছি।”
সাম্প্রতিক বছরগুলো বাংলাদেশিরা আরো অনেক অভিবাসীর মতো ল্যাটিন আমেরিকা হয়ে কষ্টকর পথ পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করার আশা নিয়ে; অনেকে অর্থ আয় করে দেশে পরিবারের কাছে পাঠানোর পথ খুঁজছে; অনেকে শুধু উন্নত জীবন অনুসন্ধান করছে। তাদের অনেক বঙ্গোপসাগরের আশপাশের নোয়াখালি, চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপেরপল্লী অঞ্চলের বাসিন্দা। যেমন মীর হোসেন (৪৭) পাঁচ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন, তার বক্তব্য হচ্ছে, তিনি দেশে তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে প্রতিপক্ষের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি কেনসিংটনের কোণায় মেটালওয়ার্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে পৌছতে তাকে এক মাস ধরে পথে থাকতে হয়েছে এবং ১৯টি দেশ ডিঙিয়ে তিনি ব্রুকলিনে এসেছেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিমানে দক্ষিণ আমেরিকায় আসেন এবং সেখান থেকে পায়ে হেঁটে কলম্বিয়া ও পানামার মধ্যবর্তী ডারিয়েন গ্যাপ অতিক্রম করেন। পথিমধ্যে যেখানের সুযোগ হয়েছে, তিনি সেখানে কাজ করেছেন। তার ভাগ্য ভালো। তার এসাইলাম আবেদন মঞ্জুর হয়েছে এবং ইতোমধ্যে তিনি গ্রিনকার্ড পেয়েছেন। লিটল বাংলাদেশে তার সঙ্গে যাদের যোগাযোগ হয়েছে, তাদের সহযোগিতায় তিনি নিজের অ্যাপার্টমেন্ট ও কাজ পেয়েছেন, দৈনিক কাজ করার পর্যায় শেষ করে তিনি এখন সাব-কন্ট্রাক্টরের কাজ করেন। তিনি তার কর্ণার থেকে কর্মীদের তার গাড়িতে তুলে কর্মস্থলে নিয়ে যান।
তবুও তিনি কিছু শূন্যতায় ভোগেন। তার স্ত্রী ও দুই সন্তান ঢাকায় থাকে এবং আশা করছেন শিগগির তারা তার সঙ্গে যোগ দেবে। তিনি বলেন, “আমার ভালো ঘুম হচ্ছে না, আমি আমার পরিবারের অভাব বোধ করছি।”
কেনসিংটনের মিলনস্থল অনেক তরুণ বাংলাদেশির জন্য ফুড ডেলিভারি অ্যাপস এর মাধ্যমে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেছে এবং করোনার সময়ে ফুড ডেলিভারির কাজ বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। কন্সট্রাকশনের কাজের চেয়ে ফুড ডেলিভারির কাজে পরিশ্রম কম এবং চাপের মধ্যে থাকতে হয় না। তা সত্বেও এ কাজে ঝুঁকি সার্বক্ষণিক ব্যাপার। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এবং হামলার মুখোমুখি হতে হয় অবিরত। ২০২১ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশি ডেলিভারিম্যান সালা মিয়াকে দুস্কৃতিকারী ম্যানহাটানে ছুরিকাঘাত করে এবং তিনি নিহত হন। একই বছরে তারেক আজিজ নামে এক বাংলাদেশি নিহত হন তার বাইক রাতের বেলায় রাস্তার পাশে ধাক্কা লেগে। তার মাথায় হেলমেট ছিল না। কেনসিংটনের বাংলাদেশিরা অনেক ক্ষেত্রে এক রুমে পাঁচ ছ’জন গাদাগাদি করে থাকেন। গ্রোসারি সামগ্রী কিনতে যান ওজোন পার্ক ও জ্যাকসন হাইটসের বাংলাদেশি দোকান থেকে।
বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেক নারী নিজেরা তাদের অবস্থান গড়ে নিয়েছেন তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি ধরে রাখার মধ্য দিয়ে। তারা বাংলাদেশি শিশুদের মাঝে দেশীয় সংস্কৃতি শিক্ষা দিচ্ছেন। ফারোজান সাঈদ (২৮) নিউইয়র্কে এসে টেকনোলজি ফিল্ডে কর্মরত তার স্বামী সাঈদ রেহানের সাথে যোগ দেন ২০১৬ সালে। এখন তিনি স্থানীয় এক পাবলিক স্কুলে ও বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ পারফর্মিং আর্টসে নাচ শেখান। তিনি একটি হোমকেয়ার কোম্পানিতে ইনটেক কোঅর্ডিনেটরের কাজ করেন।
তার স্বামী ২০ বছরের বেশি সময় যাবত কেনসিংটনের একই ছোট একটি অ্যাপার্টমেন্টে বাস করছেন, যেটি এখন তিনি তার বামা-মার সঙ্গে শেয়ার করেন। সাঈদ এখন একটি বাড়ি কিনতে চান, যেখানে তার স্ত্রী বাংলাদেশি শিশুদের নাচ শেখাতে পারবেন। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ পারফর্মিং আর্টস প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন অ্যানি ফেরদৌস। একটি রক্ষণশীল সংস্কৃতি, যেখানে নাচকে প্রায় ক্ষেত্রেই ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হয়, তেমন একটি পরিবেশের মাঝে তিনি স্থান করে নিতে চেষ্টা করছেন। অনেকে নাচকে ইসলামের ব্যাখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করেন না। মিসেস সাঈদের বেড়ে উঠার সময়ে তাকে তার মায়ের দিকের আত্মীয়দের বিরোধিতার মধ্যে পড়তে হয়েছে। কিন্তু তার বাবা তার নাচ শেখায় তাকে উৎসাহিত করেছেন।
Posted ২:৩৫ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন ২০২৩
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh