বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২২
বাংলাদেশের মহান বিজয়ের বায়ান্নতম দিবসে নিউইয়র্কে ধ্বণিত হলো-নতুন শ্লোগান “জয় বাংলাদেশ।” বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর মাহমুদের আহ্বানে ও তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় “বিজয়ের বায়ান্ন” উৎসব অনুষ্ঠিত হয় গত ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। এলামনাই এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশী ইউনিভার্সিটিজ এর ব্যানারে আয়োজিত বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানটি ছিলো সম্পূর্ন ভিন্নধর্মী। বার্তাবাহী জয় বাংলাদেশ শ্লোগান, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সত্যানুসন্ধান এবং সত্যিকারের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয় নেতৃত্বের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়টি উঠে আসে প্রদর্শিত প্রামাণ্য চিত্রে এবং বক্তব্যে। মুক্তিযুদ্ধের অকাট্য ইতিহাস ও আকর্ষনীয় প্রামাণ্য চিত্রটি টানা আধা ঘন্টা আবিষ্ট করে রাখে দর্শক শ্রোতাদের। এসময় আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েন অনেকে। এছাড়া ব্যানারে খচিত প্রতিকৃতিগুলি সাক্ষ্য দেয় ইতিহাস ও গৌরব গাঁথার। বিজয়ের বায়ান্ন অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে মুক্তিযুদ্ধের নিরপেক্ষ ও নির্মোহ বিশ্লেষনের চেষ্টা প্রশংসিত হয়েছে এবং সৃষ্টি করেছে ভিন্ন মাত্রিক আলোড়ন। স্বল্প দৈর্ঘের প্রামাণ্য চিত্রে আবু জাফর মাহমুদের ধারা বর্ণনা ছিলো সাবলীল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে এ প্রশ্ন তিনি ছুড়েছেন দর্শকশ্রোতাদের মাঝে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এক নম্বর সেক্টর কমাণ্ডের আওতায় গঠিত মাউন্টেন ব্যাটেলিয়ন কমাণ্ডার আবু জাফর মাহমুদ ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন ও গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার দাবির পাশাপাশি আইন শৃংখলা ও বিচার ব্যবস্থাকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখার দাবি জানিয়েছেন।
মূল বক্তব্যে জাফর মাহমুদ বলেন, প্রতিটি বাংলাদেশির প্রাণের শ্লোগান হওয়া উচিত ‘জয় বাংলা, জয় বাংলাদেশ। উডসাইডের গুলশান টেরেসে হোম কেয়ার প্রতিষ্ঠান বাংলা সিডিপ্যাপ ও অ্যালেগ্রা যৌথভাবে অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করে। তিনি বলেন, সন্তানের ভ্রুণ থেকে শুরু করে প্রসব পর্যন্ত যে যন্ত্রণা, যে ভালোবাসা ও পরীক্ষা তা প্রতিটি মা উপলব্ধি করেন। সন্তান পৃথিবীর আলো দেখে বড় হয় পুরোটাই মায়ের মমতা ও যত্নে। মায়ের চেয়ে ভালো আর কেউ বোঝে না। এই সত্য প্রত্যেক জাতির সঙ্গেও মিলে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে যারা যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা বাংলাদেশের সরকার গঠন করতে পারেননি। তাদেরকে দিয়ে আমরা সরকার গঠন করিনি। আমাদের ছিল না রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা। আমাদের কেউ মন্ত্রী ছিলেন না। একমাত্র বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী ছিলেন পাকিস্তান সরকারের, তাও কিছুদিনের জন্য। আমরা পাকিস্তানের ন্যাশনাল এসেমব্লির মেম্বার পর্যন্ত ছিলাম না। পূর্ব অভিজ্ঞতা ব্যতিরেকেই আমাদের বড় ভায়েরা সরকার গঠন করেন। তারাই আমাদের মুরুব্বি। আমরা তাদেরকেই মেনেছি। আমরা মেনে মেনেই এ পর্যন্ত এসেছি। এর ভেতরেই আমরা অনেক মূল্যবান সম্পদ হারিয়েছি। বহু জীবন হারিয়েছি। বহু নেতা ও মুরুব্বিদের হারিয়েছি।
জাফর মাহমুদ নিজের জীবনচিন্তা ও ধর্মানুভূতির কথা তুলে ধরে বলেন, জাকাত দিলে সম্পদ পবিত্র হয়। কিন্তু আল্লাহ যে জ্ঞান দিয়েছেন, যে ভালোবাসা দিয়েছেন তার জন্য কী করেছি, তার জাকাত কি? আমি বিশ্বাস করি, সেই জাকাতটিই হচ্ছে দেশের জন্য নিবেদিত হওয়া। সেই তাগিদ ও কর্তব্যের তাড়না থেকে, নতুন প্রজন্মের সামনে দেশপ্রেমের আদর্শ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের শুদ্ধ ইতিহাস তুলে ধরার চিন্তা থেকেই এই আয়োজন। জাফর মাহমুদ ষাটের দশকের দূরদর্শী ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খানের কথা তুলে ধরে বলেন, তিনি জয় বাংলা শ্লোগান তুলে ছাত্রসমাজকে আন্দোলিত করে গোটা জাতির মধ্যে ছড়িয়ে দেন তার প্রভাব। সেই শক্তির রেশ এখনও বিদ্যমান। কিন্তু আজকে ভারতের বাঙালিরাও ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দেয়। জাফর মাহমুদ বলেন, আমরা আমাদের রাষ্ট্র গঠন করেছি, আমরাই আমাদের পতাকা নির্ধারণ করেছি, আমরাই আমাদের জাতীয় সঙ্গীত নিয়েছি। তাই জয় বাংলা শ্লোগান যখন দেন, তা যদি ভালোবেসে দেন, তাহলে তার সঙ্গে অবশ্যই রাষ্ট্র থাকতে হবে। বাংলাদেশ থাকতে হবে। জয় বাংলার পাশাপাশি শ্লোগান হতে হবে ‘জয় বাংলাদেশ’। এটিই প্রতিটি বাংলাদেশির শ্লোগান।
অনুষ্ঠানে নির্ধারিত অতিথি নিউইয়র্কের মেয়র এরিক অ্যাডামস উপস্থিত হতে না পারায় যোগ দেন তার প্রতিনিধি ডেপুটি কমিশনার দিলীপ চৌহান । তিনি অভিবাসীদের সুযোগ ও স্বপ্ন পুরণের প্রশ্নে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহর নিউইয়র্কে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় উদযাপনের ব্যতিক্রমী ও বর্ণাঢ্য আয়োজনকে দৃষ্টান্তমূলক বলে অভিহিত করেন। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর মাহমুদের হাতে মেয়র এরিক অ্যাডাম্স এর পক্ষ থেকে প্রদত্ত সম্মানসূচক ‘রিসাইটেশন’ প্রদান করেন। দিলীপ চৌহান জানান, এটি মেয়রের পক্ষ থেকে দেয়া সর্বোচ্চ সম্মাননা। মেয়রের জন্যও অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশি ইউনিভার্সিটিজ এর বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সম্পাদক ড. ওয়াজেদ এ খান, সাপ্তাহিক আজকাল এর প্রধান সম্পাদক মনজুর আহমেদ, টাইম টিভি ইউএসএ’র সত্তাধিকারী ও বাংলা পত্রিকা সম্পাদক আবু তাহের, সাপ্তাহিক প্রবাস সম্পাদক মোহাম্মদ সাঈদ, নিউইয়র্ক মেয়রের উপদেষ্টা ফাহাদ সোলাইমান, জাতীয় চ্যাম্পিয়ন শুটার ও অলিম্পিয়ান এস এম ফেরদৌস, চট্টগ্রাম অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি কাজী আযম, সন্দ্বীপ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আশরাফ উদ্দিন, মূল ধারার রাজনীতিক মামনুনুল হক, অধ্যাপক এম রহমান সুজন, প্রমুখ।
ডাঃ ওয়াজেদ খান তার বক্তব্যে বলেন, স্বাধীনতা আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি বিজয়ের একান্ন বছর পরও অপূর্ণ রয়ে গেছে স্বাধীনতার স্বপ্ন ও আকাঙ্খা। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিলো সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার। অপশাসন, শোষন ও বৈষম্যের কারণে আমরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু দীর্ঘ দিনেও আসেনি অর্থনৈতিক মুক্তি। একাত্তুরের সকল শহীদ এবং সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের দাবি জানান। জাতীয় নেতৃবৃন্দের খন্ডিত মূল্যায়নের কারণে জাতি বিভক্ত হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেন ডাঃ ওয়াজেদ খান।
বিজয়ের বায়ান্ন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর জেনারেল এম এ জি ওসমানী, স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের অন্যতম নেতা সিরাজুল আলম খান, বিএলএফ নেতা কাজী আরেফ আহমেদ, বিএলএফ নেতা আব্দুর রাজ্জাক, একাত্তুরের ২ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী আ স ম আব্দুর রবের ভূমিকা তুলে ধরা হয় অনুষ্ঠানে। এছাড়া গোটা মঞ্চ জুড়ে শোভা পায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়া, মেজর রফিক, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর সি আর দত্ত, মেজর মীর শওকত আলী, উইং কমান্ডার বাশার, মেজর নাজমুল হক, মেজর মঞ্জুর, মেজর জলিল, মেজর তাহের, মেজর আবু ওসমানের প্রতিকৃতি।
অনুষ্ঠানে ডা. চৌধুরী সারওয়ার হাসান, নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদব মনোয়ারুল ইসলাম, সাপ্তাহিক জন্মভূমি সম্পাদক রতন তালুকদারসহ নিউইয়র্কে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে ধর্ম ও মানবতার বাণী প্রচার করা হয়। কোরআন তেলাওয়াত করেন মাওলানা মুহম্মদ আব্দুস সাদিক, বাইবেল থেকে পাঠ করেন রেভারেন্ড জেমস রয় এবং রামায়ণ ও গীতার শ্লোক থেকে আলোচনা করেন রাশেশ্বরী গোল্লাপুরি। আলোচনা পর্ব শেষে সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানসহ জনপ্রিয় সব দেশগান পরিবেশন করেন বিশিষ্ট শিল্পী রিজিয়া পারভীন ও চন্দন চৌধুরি। আবৃত্তি করেন অভিনয় শিল্পী ও আবৃত্তিকার টনি ডায়েস ও মোস্তফা কামাল। নৃত্য পরিবেশন করেন প্রিয়া ডায়েস।
উল্লেখ্য গত ১ অক্টোবর নিউইয়র্কে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ ঘটে ব্যতিক্রমধর্মী এ সংগঠনটির। বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখা এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার শ্লোগানের কারণে নতুন সংগঠনটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে দেশ ও প্রবাসে। আবু জাফর মাহমুদ এলামনাই এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশি ইউনিভার্সিটিজ এর আহ্বায়ক। মূলত বাংলাদেশের অর্ধশতাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে সংগঠনটি। প্রথম অনুষ্ঠানের পর সংগঠনটির কর্মপরিকল্পনা, আদর্শ ও উদ্দেশ্য প্রশংসিত হয়েছে সর্ব মহলে।
Posted ১:২০ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh