ডা. ওয়াজেদ খান : | বৃহস্পতিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২২
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিষোদগার ও ঢাকাস্থ আমেরিকান রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের হেনস্তার ঘটনায় বাংলাদেশী আমেরিকানরা বিব্রত। চলমান এসব ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সংগঠন উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস হেনস্থার শিকার হয়েছেন। ঢাকার শাহীনবাগে গত ১৪ ডিসেম্বর সরকার দলীয় সমর্থক ভূইফোঁড় একটি সংগঠনের সদস্যরা পন্ড করে দেয় রাষ্ট্রদূতের নির্ধারিত একটি কর্মসূচী। হামলাচেষ্টা চালায় রাষ্ট্রদূতের ওপর। এসময় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সদস্য ও পুলিশি সহায়তায় দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। ঘটনার আকস্মিকতায় উদ্বিগ্ন রাষ্ট্রদূত সরাসরি ছুটে যান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সেখানে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেনের নিকট।
প্রশ্ন উঠেছে রাষ্ট্রদূতের ব্যক্তিগত কর্মসূচীর বিষয়টি বাইরে চাউর হওয়া নিয়ে। এছাড়া সাবেক রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়ি বহরে ২০১৮ সালের আগষ্টে ঢাকার মহম্মদপুরে হামলা চালায় একদল সশস্ত্র যুবক। সেদিন তিনি সুজন সম্পাদক বদিউল আলমের মহম্মদপুরের বাসায় গিয়ে ছিলেন নৈশভোজে আমন্ত্রিত হয়ে। ফেরার পথে হামলার শিকার হন বার্নিকাট। আমেরিকান রাষ্ট্রদূত পিটার হাস নাজেহাল হওয়ার ঘটনায় তার নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অপরদিকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বাংলাদেশীরা। তারা মনে করেন বাংলাদেশ সরকার নিতান্ত দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি করছে। প্রকারান্তরে যা বাংলাদেশকে নিপতিত করবে গভীর সংকটে। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশীরা।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পরীক্ষিত অকৃত্রিম বন্ধু। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী দেশ। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সালের ৪এপ্রিল স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে এবং প্রথম দিনেই ঘোষণা দেয় ৩৩০ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তার। শুধু ইউএস এইডের মাধ্যমেই এ পর্যন্ত ৮ বিলিয়ন ডলার আর্থিক অনুদান দিয়েছে দেশটি। বর্তমানে পাওয়ার প্ল্যান্ট, কয়লাখনি, সার কারখানা সহ বড় বড় বিনিয়োগ খাতের শীর্ষে অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের। এছাড়া বাংলাদেশের মৌলিক অবকাঠামোগত প্রতিটি ক্ষেত্রেই উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র।
পাকিস্তানের সাথে ১৯৫৯ সালে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে সরাসরি কোন সহযোগিতা না করে বঙ্গোপসাগর থেকে ফিরিয়ে নেয় সপ্তম নৌবহর। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ সমর্থন দেয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ এবং দেশটির জনগণের সাথে বাংলাদেশীদের সম্পর্ক নিবিড়।
শুধু উন্নয়ন সহযোগীই নয় অভিবাসীর দেশ যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে বসবাস করছেন ১০ লক্ষাধিক বাংলাদেশী। যাদের সিংহভাগই লাভ করেছেন দেশটির নাগরিকত্ব। বসবাস করছেন পরিবার পরিজন নিয়ে। তাদের সন্তানরা যুক্তরাষ্ট্রে উন্নীত করছেন বাংলাদেশের জাতীয় মর্যাদা। মূলধারার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত অনেক বাংলাদেশী আমেরিকান প্রতিনিধিত্ব করছেন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশী আমেরিকানদের অবস্থান এখন অনেক সুদৃঢ়। বাংলাদেশী আমেরিকানরা সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রেরণকারী।
তাদের প্রেরিত অর্থে কম করে হলেও বাংলাদেশে ৩০ লক্ষ পরিবার সুবিধাভূগী। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশীদের অনেকেই বিনিয়োগ করেছেন নিজ দেশে। প্রবাসে বসেই তারা পরিচালনা করছেন দেশের অনেক দাতব্য, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা সচল রেখেছেন দেশের অর্থনীতির চাকা। অপরদিকে যে সকল রাজনীতিক যুক্তরাষ্ট্রকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে নেতিবাচক মন্তব্য ছুঁড়ছেন তাদের অনেকেরই সন্তান ও পরিবারের সদস্যরা বাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। দেশ থেকে পাচার করা অর্থে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি-গাড়ি ও ব্যবসায় বাণিজ্য করছেন তারা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন দেশটিতে তাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য। বর্তমান সকরারের মন্ত্রী এবং উপদেষ্টা পরিষদে বেশ ক’জন আমেরিকান পাসপোর্টধারী রয়েছেন বলেও খবর আছে বাজারে।
বাংলাদেশে শিক্ষা এবং প্রযুক্তি খাতেও সমান তালে অবদান রেখে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় ২০ সহস্রাধিক বাংলাদেশী ছেলেমেয়ে স্টুডেন্ট ভিসায় পড়াশুনা করছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ অনেক পেশাজীবী কর্মরত আছেন উচ্চপদে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পর বাংলাদেশে তৈরি পোষাক আমদানীতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান শীর্ষে। এছাড়া অন্যান্য পণ্য সামগ্রী রপ্তানীরও বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিটি দুর্যোগ দুর্বিপাকেই যুক্তরাষ্ট্র পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের। করোনা মহামারিকালে আগাম অর্থ নিয়ে ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয় ভারত। ভয়াবহ এ দুর্দিনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে বিনামূল্যে ১কোটি ১৬ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দিয়েছে, এশিয়া অঞ্চলের হিসেবে যা সর্বোচ্চ।
যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের শীর্ষ শক্তিশালী দেশ। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত নীতি নিয়ে সমালোচনা রয়েছে বর্হিবিশ্বে। তারপরও গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসনের ক্ষেত্রে তার অভ্যন্তরীন নীতিমালা অত্যন্ত কার্যকর। “ওয়ান ন্যাশন আন্ডার দ্য গড” নীতিতে দেশটি তার নাগরিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা বিধানে আপোষহীন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও গনতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকারের বিষয়টি বরাবর আমলে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রসমূহের উপর এ বিষয়ে তীক্ষ্ন নজর রাখে তারা। বাংলাদেশের গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকারের বিষয়টির উপরও দৃষ্টি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। বাংলাদেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটে যখন অস্থিরতা বিরাজ করছে তখন স্বাভাবিকভাবেই ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে গুম হওয়া একটি পরিবারের আকুতি শুনতে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। আর তাদের এ ধরণের তৎপরতা নতুন কিছু নয়। কিন্তু তাই বলে সরকার দলীয় সমর্থকরা রাষ্ট্রদূকে নাজেহাল করবে? সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা তাকে নিয়ে বাহাস করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশ নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে এমন হুমকি দেবে ? ওবায়দুল কাদের রাষ্ট্রদূতকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের গুম-খুনের পরিসংখ্যানের বিষয়টি। প্রধানমন্ত্রীও যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টি সামনে এনেছেন একই সমাবেশে। যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লংঘনকারীদের ভরন-পোষন করে বলেও উল্লেখ্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার প্রশ্নে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে থাকে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাব এবং প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর আগে ২০১৩ সালের ২৯ জুন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নির্বাহী আদেশে বন্ধ হয়ে যায় জিএসপি-(জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস) সুবিধা। জিএসপির আওতায় বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল ১২২টি দেশ থেকে বিনা শুল্কে যুক্তরাষ্ট্র ৫০০০ ধরণের বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী আমদানী করে থাকে। সাভারের তাজরীন ফ্যাশনস ও রানা প্লাজায় গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রাণহানি ও শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যাকান্ড ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা থেকে বাদ দেয়। দীর্ঘ ৯ বছরে অনেকবার তদবির করেও জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল করা সম্ভব হয়নি। এমতাবস্থায় নতুন করে কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে তার দায় কে নেবে? এছাড়া জাতিসংঘের বড় আর্থিক অনুদানকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। কোন কারণে যুক্তরাষ্ট্র বিরাগভাজন হলে জাতিসংঘ শন্তি মিশন থেকে বাংলাদেশ বাদ পড়লে তা হবে বড় ধরণের বিপর্যয়।
Posted ১:২৩ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh