বিশেষ প্রতিবেদন : | বৃহস্পতিবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১
বাংলাদেশ থেকে অর্থ লুন্ঠন করে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বসবাসকারী লুটেরাদের এখন দিন কাটছে আতঙ্কে। অবাধে লুন্ঠন করা দেশের অর্থ দিয়ে উত্তর আমেরিকায় সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে এতোদিন নিরাপদেই ছিলেন তারা। সম্প্রতি কানাডা সরকার সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মুরাদ হাসানকে টরেন্টো বিমান বন্দর থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের র্যাব-পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা ও সাবেক সেনা প্রধানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় ঘুম হারাম হয়ে গেছে অন্যান্যদের।
প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেনের এ নির্বাহী আদেশের তালিকায় নাম রয়েছে আরো অনেকের। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, ব্যাংক, বীমা ও অর্থ লগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান থেকে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে এনে নিউইয়র্ক সহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে বাড়ি-গাড়ি ও ব্যবসায় বাণিজ্য গড়ে তুলেছেন একটি শ্রেনী। তাদের পরিবার এসব দেশে চলছে রাজার হালে। কয়েকটি বেসরকারী ব্যাংকের মালিক এখন পালিয়ে আছেন নিউইয়র্কে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ঠিকাদার এবং আইন শৃংখলা রক্ষাবাহিনী ও আমলার নামে বেনামে রয়েছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ।
স্থানীয় বাংলাদেশীরা তাদের অনেকেই চেনেন। কানাডায় ডাঃ মুরাদ হাসান যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশীরা তার অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরেন দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগে। এই ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশীরা এসব লুটেরাদের তালিকা প্রস্তুত করছেন বলে জানা গেছে। দেশ প্রেমিক বাংলাদেশীরা তাদের নাম, বাসস্থান ও সম্পদের তত্ত্ব-তালাশ করে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনে পৌছে দেয়ার জন্য গোপনে কাজ করছেন।
দুর্বৃত্তায়িত এবং অস্থিতিশীল রাজনীতির কারণে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচারে চলছে মহোৎসব। অপরদিকে ক্রমাগত বাড়ছে দারিদ্র। রাষ্ট্রীয় মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আর এই সুযোগে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী অবাধে লুণ্ঠন করছে দেশের অর্থ। চিহ্নিত এই সিন্ডিকেট গত এক দশকে পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলে বিভিন্ন সংস্থার খবরে জানা গেছে। দেশের দরিদ্র মানুষের অর্থে তারা বিদেশে যাপন করছে বিলাসী জীবন। অর্থ পাচারকারী এসব প্রতারকের অনেকে দেশে ব্যবসা বাণিজ্য ও রাজনীতি করলেও তাদের পরিবার পাঠিয়ে দিয়েছে বিদেশে। আর সেখানে তারা আলিশান বাড়িতে বাস করছে। হাকাচ্ছে নামী দামী মডেলের গাড়ি। বিদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে তাদের সন্তানরা। বাংলাদেশের এসব অর্থপাচারকারীরা কানাডায় বেগমপাড়া এবং সাহেব নগর গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রে। প্রতিষ্ঠা করেছে বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্য। শুধু এ দুটি দেশ নয়Ñযুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, হংকং, সৌদি আরব, ভারত, অষ্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এরা একই কায়দায় অবৈধ অর্থ লগ্নি করেছে। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্র ড. আবদুল মোমেন দেশের অর্থ পাচারের জন্য আমলাদেরকে দায়ী করেন।
দেশ থেকে প্রকাশ্যে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার হচ্ছে। অথচ পাচারকারীদের প্রকৃতপক্ষে কোন শাস্তি হচ্ছে না। ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না পাচারকৃত অর্থ। পাচারকারীদের অনেকে একবারে দেশ ছেড়েছে। যখন তারা দেশে থাকে তখন তাদেরকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করার নজীর খুব কম। কিন্তু দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর সবার টনক নড়ে। ইন্টারপোলে জারি করে রেড এলার্ট। বাংলাদেশ থেকে ব্যাংকের ঋণ খেলাপি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় বড় দুর্নীতিবাজরা যে অর্থ পাচার করে কানাডায় নিয়ে যায়। অর্থ পাচার এবং অবৈধ লেন-দেন বন্ধ করতে কানাডায় কাজ করে ফিনান্সিয়াল ট্রান্সেকশনস অ্যান্ড রিপোর্ট এনালিসিস সেন্টার অব কানাডা বা ‘ফিনট্রাক।’ এক্ষেত্রে বড় দায়িত্ব রয়েছে বাংলাদেশের। পাচারকারীদের অভয়ারন্য বলে খ্যাত কানাডায় বেগমপাড়া গড়ে উঠার পর সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশীরা প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশ থেকে কানাডায় পালিয়ে আসা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন তারা। টরন্টোতে বাংলাদেশি ‘বেগমপাড়া’ নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই অনেক কথাবার্তা চলছে। বলা হয় বাংলাদেশে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া বহু ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিক তাদের স্ত্রী-সন্তানদের পাঠিয়ে দিয়েছেন কানাডায়। তাদের নিয়েই গড়ে উঠেছে এই ‘বেগমপাড়া’। সম্প্রতি বাংলাদেশশ সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মুরাদ হাসানকে কানাডায় প্রবেশ করতে না দেয়ায় কানাডায় পাড়ি জমানো লুটেরাদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ সন্ধান করছেন নিরাপদ আশ্রয়ের।
ডা. মুরাদ হাসানের দেশে ফিরে আসা এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় সারা দেশে আলোচনা শুরু হয়েছে নতুন করে। এসব ঘটনায় দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী এবং অপরাধপ্রবণ ব্যবসায়ী, রাজনীতিকসহ অনেকেই আতঙ্কে আছেন। সামনের দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় কি না, তা নিয়েও শঙ্কা বিরাজ করছে। বাড়ি ঘর বিক্রি এবং ব্যবসায় বাণিজ্য গুটিয়ে নিরাপদ অন্য কোন দেশে পাড়ি জমানোর কথা ভাবছেন বলে জানা গেছে। ঢাকাই সিনেমার এক নায়িকার সঙ্গে ডা. মুরাদ হাসানের কুরুচিপূর্ণ ফোনালাপ ফাঁস হয়। এছাড়া কিছু অশ্লীল অডিও-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ৬ ডিসেম্বর ডা. মুরাদ হাসান পদত্যাগ করেন। এর পরদিনই কানাডার উদ্দেশে তিনি দেশত্যাগ করলেও দেশটিতে তিনি প্রবেশ করতে পারেননি। ব্যর্থ হন সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবেশের চেষ্টা করেও। অপরদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে র্যাবের সাবেক ও বর্তমান ছয়জন কর্মকর্তাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটি। আইনবহির্ভূত কাজের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, অর্থ পাচারকারী ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের জন্য এটি বড় বার্তা। এখন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। পরে হয়তো ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ থেকে এ ধরনের বার্তা আসতে পারে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ যে ইমেজ তৈরির চেষ্টা করছে, সেখানে বড় ধাক্কা লাগবে। ডা. মুরাদ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ইস্যু একই সময়ে হওয়ায় বেশি আলোচনা তৈরি হয়েছে। এটি ভাবিয়ে তুলছে সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়কেও। বিশেষ করে সরকারের ইমেজ ক্ষুণ্ন হচ্ছে।বিদেশে সম্পদ গড়ে যারা নিজেদের নিরাপদ ভাবছেন, তাদের জন্য এটি একটি বড় বার্তা।
নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরের এসব দুর্বৃত্ত আস্তানা গেড়েছে। অঢেল অর্থ বিনিয়োগ করছে নানা ব্যবসায়। নগদ অর্থে কিনছে বাড়ি ও তৈরি করছে অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলাদেশি কয়েকজনের অর্থ পাচারের বিষয়টি উঠে আসে। তাদের মধ্যে সরকার ও বিএনপি সমর্থক কয়েকজন ব্যবসায়ীর নামও রয়েছে। বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনায় হাইকোর্টে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে অর্থ পাচারের অভিযোগে ৪৩ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিতে এ ৪৩ জনের নাম উঠে এসেছে। সম্প্রতি প্যান্ডোরা পেপারসে দ্বিতীয় তালিকায় আট বাংলাদেশির নাম আসে। তাদের বিরুদ্ধেও অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে।
Posted ৮:৪৯ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh