বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর ২০২০
যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি ষ্টেটেই করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির বিশ্লেষণ অনুযায়ী ৪৫টি ষ্টেটে কোভিড ১৯ পজিটিভ টেস্ট রেজাল্ট গত সপ্তাহের চেয়ে চলতি সপ্তাহে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত এক কোটি ১০ লাখ লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যু ঘটেছে ২ লাখ ৪২ হাজার জন। গবেষকরা আশংকা করছেন আগামী দুই মাসে যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের কাতারে শামিল হতে পারে আরো ১ লাখ করোনা ভাইরাস আক্রান্ত আমেরিকান। নিউইয়র্ক স্টেটে গত বুধবার পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯৩৩ এবং মৃতের সংখ্যা ৩৩ হাজার ৩৪৩ জন। সমগ্র বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ৫ কোটি ১০ লাখ এবং মৃতের সংখ্যা ১২ লাখ ৬০ হাজারের বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রে গত এক সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে এক লাখ করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগী সনাক্ত হয়েছে এবং বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছে যে খুব শিগগিরই দৈনিক সংক্রমিতের হার দুই লাখে উন্নীত হতে পারে। নিউইয়র্ক সিটিতে গত রোববার ৭৯৫ জন করোনা রোগী সনাক্ত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেই বিশ্বের সর্বোচ্চ সংখ্যক করোনা সংক্রমিত রোগী সনাক্ত হয়েছে এবং মৃতের হারও এখানো সর্বোচ্চ। ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটার সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজ রিসার্চ এন্ড পলিসির পরিচালক মাইকেল অস্টারহোম গত সোমবার সিএনএনকে জানান, আমাদের ধারণার চেয়েও ভাইরাস সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে চলেছে। আগামী সপ্তাহগুলোতে এই সংখ্যা দৈনিক দুই লাখ অতিক্রম করবে।
গত সোমবার পর্যন্ত এক সপ্তাহে দৈনিক সংক্রমণ হার ছিল গড়ে ১ লাখ ১৯ হাজার ২৩৮ জন। সারাদেশে গত বুধবার পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি ছিল ৬১ হাজার ৯৬৪ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী। এর আগে গত ২৫ জুলাই এর পর হাসপাতালে সর্বোচ্চ সংখ্যক করোনা রোগী ভর্তি ছিল গত ১৫ এপ্রিল এবং এ সংখ্যা ছিল ৫৯ হাজার ৯৪০ জন। সংক্রমণ হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং মৃতের সংখ্যাও বেড়ে চলবে। গত এক সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে ১,০০০ জনের মৃত্যু হয়েছে, আগস্ট মাসের পর গত সপ্তাহে এভাবে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে চলতি নভেম্বর মাসে। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির গবেষক ও ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের ইন্সটিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস এন্ড ইভেলুয়েশন আশঙ্কা করছেন যে আগামী ২ মাসে আরো এক লাখ করোনা রোগীর মৃত্যু ঘটতে পারে।
এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ সংখ্যক আক্রান্তের সংখ্যা টেক্সাসে এবং সেখানে ১০ লাখের বেশি লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। গত মার্চ থেকে টেক্সাসে ভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যু ঘটেছে ১৯ হাজার ৩৩৭ জনের। ক্যালিফোর্নিয়ায় আক্রান্ত ৯ লাখ ৯১ হাজার এবং মৃত্যু হয়েছে ১৮ হাজার ৭৮ জনের। ফ্লোরিডায় আক্রান্ত ৮ লাখ ৫২ হাজার এবং মৃত ১৭,২৪৮। ইলিনয়ে আক্রান্ত ৫১১,১৮৩ এবং মৃত ১০,৬৪৫। জর্জিয়ায় আক্রান্ত ৪১১,৬৫২ এবং মৃত ৮,২৬৪। নর্থ ক্যারোলিনায় আক্রান্ত ২৯৭,৪৪২ ও মৃত ৪,৬৬০। উইজকনসিনে আক্রান্ত ২৯৩,৮১২ এবং মৃত ২,৩৯৫। এ মুহূর্তে নিউ জার্সিতে আক্রান্তের সংখ্যা কম হলেও সেখানে এখন পর্যন্ত মারা গেছে ১৬,৪৬১ জন। মিশিগানে মারা গেছে ৮,০৯৪ জন। পেনসিলভেনিয়ায় মৃতের সংখ্যা ৯,০৭৯ জন। লুইজিয়ানায় মৃত ৬,০৫৮ জন। ম্যাসাচুসেটস এ মৃত ১০,১৮৪ জন।
এদিকে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজার ইনকের পরীক্ষামূলক করোনা ভ্যাকসিন ৯০ শতাংশের বেশি কার্যকর বলে দাবী করা হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে।
এটি বাজারজাত করার আগে ব্যাপক ভিত্তিক ক্লিনিক্যাল টেষ্ট, বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও ভ্যাকসিন তৈরীর জন্য বিনিয়োগকারীর পাওয়ার চেষ্টা চলছে। ফাইজারের জার্মান পার্টনার বায়োটেক এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা এখনো ভ্যাকসিন সংরক্ষণের নিরাপত্তা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি, তবে সমস্যা কাটিয়ে উঠে তারা চলতি নভেম্বর মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এণ্ড ড্রাগ এডমিনিষ্ট্রেশনের অনুমোদন পাওয়ার আশা করছে। অনুমোদন পাওয়া গেলে তারা চলতি বছরের অবশিষ্ট সময়ের মধ্যে তাারা এবং তাদের সহযোগী ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো ৫ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন প্রস্তুত করতে সক্ষম হবে, যা আড়া কোটি মানুষকে করোনা ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা করতে যথেষ্ট। ২০২১ সালে তারা ১.৩ বিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে পারবে। গত সোমবার ভ্যাকসিনে কার্যকারিতা ঘোষণা করতে গিয়ে ফাইজার ইনকের চিফ এক্সিকিউটিভ আলবার্ট বোরলা বলেছেন, বিজ্ঞান ও মানবতার ইতিহাসে আজ এক গৌরবোজ্জ্বল দিন।
বিশ্ববাসীর জন্য স্বস্থির খবর ভ্যাকসিনের ফলাফল ইতিবাচক প্রমাণিত হয়েছে। তা সত্বেও প্রশ্ন রয়েছে যে এই ভ্যাকসিন বিভিন্ন জাতিগোত্র, বা বয়সের ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর হবে এবং ভ্যাকসিন মানবদেহে কতদিন পর্যন্ত করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে পারবে। ফাইজার এর পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ১৬ বছর থেকে ৮৫ বছর পর্যন্ত বয়সের লোকদের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য অনুমোদন চেয়েছে। এর প্রেক্ষিতে ইউএস হেলথ এন্ড হিউম্যান সার্ভিসেস সেক্রেটারী অ্যালেক্স আজার বলেছেন যে, এজন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিতে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে।
ইউএস ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ এলার্জি এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজ এর ডাইরেক্টর অ্যান্থনি ফসি বলেছেন যে, ভ্যাকসিন বিতরণ করার প্রশ্নটি অত্যন্ত সংকটজনক হয়ে যেতে পারে। কারণ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ভ্যাকসিন সংরক্ষণে উপযুক্ত হিমাগারের ব্যবস্থা নেই। এটি কমপক্ষে মাইনাস ৮৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটে রাখতে হবে।তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশের জন্য হয়তো ভ্যাকসিন সংরক্ষণ কঠিন কিছু নয়, কিন্তু ভ্যাকসিন বিতরণ করতে হবে সমগ্র বিশ্বে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামর্থের দিকটিও মাথায় রাখতে হবে। সেই লক্ষ্যে আমরা একযোগে কাজ করে যাচ্ছি।
করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতার পর ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স তার অবকাশ বাতিল করেছেন। কিন্তু হোয়াইট হাউজের করোনাভাইরাস টাস্কফোর্স রহস্যজনক নীরবতা পালন করছে। হোয়াইট হাউজের চিফ অফ স্টাফ মার্ক মেডোস করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি গত মাসে ঘোষণা করেন যে, আমরা এই মহামারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবো না। কারণ ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে যথেষ্ট মনোযোগ দেয়া হচ্ছে না। আমাদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য স্থির করতে হবে। পরিস্থিতি সংকটজনক হলেও যুক্তরাষ্ট্রের ষ্ট্র্যাটেজিক ন্যাশনাল স্টকপাইলে ৩০ কোটি এন৯৫ মাস্ক থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র সাড়ে ১১ কোটি। এসব সত্বেও ফেডারেল কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিচ্ছে যে, মহামারীর প্রাথমিক দিনগুলোর চেয়ে এখন অবস্থা অনেক ভালো। স্টেট এবং হাসপাতালগুলোর নিজস্ব প্রস্তুতি রয়েছে এবং ফেডারেল সরকার ১ লাখ ৫৩ হাজার ভেন্টিলেটর সংগ্রহের লক্ষ্য পূরণে কাজ করছে। কিন্তু নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন এমনকি মহামারী নিয়েও কাজ করছে না। প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট জো বাইডেন ইতোমধ্যে করোনাভাইরাস এডভাইজরি বোর্ড গঠনের কথা বলেছেন এবং সকল আমেরিকানকে মাস্ক পরিধানের জন্য আহবানর জানিয়েছেন। কিন্তু আগামী জানুয়ারী মাসের ২০ তারিখের পূর্ব পর্যন্ত তিনি কোনোকিছু করার কর্তৃত্ব পাবেন না।
এমরয় ইউনিভার্সিটির ইনফেকশাস ডিজিস স্পেশালিষ্ট ড. কার্লোস ডেল রিও বলেছেন, দৈনিক এক হাজার মৃত্যুর ঘটনায় মনে হয় যেন দুটি জাম্বোজেট আকাশ থেকে পতিত হচ্ছে। প্রতিদিন যদি এভাবে দুটি করে জাম্বোজেট পতিত হয় এবং সকলকে ধ্বংস করে, তাহলে কি তা আতঙ্কিত হওয়ার বড় কারণ নয়? কিন্তু কোনো কারণে আমাদের মধ্যে সে উদ্বেগ আতঙ্ক নেই। জাতি হিসেবে কোনো কারণে আমরা সতর্ক নই। তিনি বলেন, “আমাদের একজন চার্চিল প্রয়োজন, এমন কাউকে প্রয়োজন, যিনি বিদ্যমান শূন্যতা পূরণ করে দেশকে নেতৃত্ব প্রদান করবেন।
২০ হাজারের অবস্থা আশঙ্কাজনক : যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রায় ২০ হাজার রোগী আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে মরণব্যাধী এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করছেন তারা। শরীরে কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না তাদের। ওয়ার্ল্ডমিটারের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের বেশ কয়েকটি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১৯ হাজার ৬৩ জন করোনা রোগী। তাদের শরীরে উপসর্গগুলো কমছে না। কেউ দূর্বল হয়ে পড়ছেন। কারও শরীরে ওষুধ কাজ করছে না। নির্বাচনের মাঝেও করোনার প্রভাব ছিল বেশ। নির্বাচন পরবর্তী সময় যুক্তরাষ্ট্রে করোনা সংক্রমণ বেড়েছে ব্যাপক হারে। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় টানা ছয় দিন করোনা সংক্রমণ রেকর্ড করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এই ছয়দিনে করোনা রোগীর সংখ্যা পাওয়া গেছে ১ লাখ।
এদিকে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রে গত ১০ দিনে নতুন করে ১০ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। করোনার প্রথম ধাপে যে গতিতে ভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তার হয়েছিল, দ্বিতীয় ধাপের এর গতি অনেক বেশি। গত ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশটিতে মৃতের সংখ্যা আগের সপ্তাহ থেকে ১০ শতাংশ বেশি। এখন পর্যন্ত দেশটিতে মোট ১ কোটি ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি লোক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মৃতের সংখ্যা ২ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি।
Posted ৯:৫৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh