বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ১১ মার্চ ২০২১
যুক্তরাষ্ট্রে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উদযাপন
ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ উপলক্ষে নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুস্পস্তবক অর্পণ, শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনার জন্য দোয়া ও মিলাদ মাহফিল এবং ভার্চুয়াল আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ আহবান করে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটির স্মরণে দিবসটি গুরুত্বের সঙ্গে উদযাপন করা হয়।
বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন : জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করা হয়েছে। গত ৭ মার্চ জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটির সূচনা করা হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মুনাজাত করা হয়। এ ছাড়া দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী পাঠ এবং ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ এবং একটি প্রামাণ্য ভিডিও প্রদর্শন করা হয় অনুষ্ঠানটিতে। আলোচনা পর্বে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা। ১৯৭১ সালে জাতির পিতা প্রদত্ত ৭ই মার্চের ভাষণ একটি জাতিকে কিভাবে বজ্রকঠিন ঐক্যের পতাকাতলে সমবেত করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণে উজ্জীবিত করেছিল তা উঠে আসে রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে। তিনি বলেন, “এটি কোনো পূর্বলিখিত ভাষণ ছিল না। এটি ছিল ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর হৃদয় উৎসারিত তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। এতে এক দিকে রয়েছে আমাদের সুদীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস, আর অন্য দিকে রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সুস্পষ্ট নির্দেশনা”। তিনি আরও বলেন, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের সফল পরিণতি হচ্ছে স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ। ৭ই মার্চের ভাষণ যাতে সর্বদা দীপ্যমান থাকে এবং জাতির পিতার সম্মোহনী দরাজ কণ্ঠ যাতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অনুরণিত হয় সেজন্য নতুন প্রজন্মকে ভাষণটি বারবার শোনানোর আহ্বান জানান রাষ্ট্রদূত ফাতিমা।
অন্য আলোচকগণ ভাষণের প্রেক্ষাপট, বিষয়বস্তু, সুদূর প্রসারী প্রভাবের উপর আলোকপাত করেন। জাতির পিতার এই ভাষণে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একজন সুযোগ্য রাষ্ট্রনায়কের সুচিন্তিত কৌশলের সবটুকুই প্রতিভাত হয়েছে মর্মে মন্তব্য করেন বক্তাগণ।
বাংলাদেশ কনস্যুলেট : নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল গত ৭ মৃার্চ যথাযথ মর্যাদায় ’ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ’ উদযাপন করে। অনুষ্ঠানের শুরুতে কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুননেসা কনস্যুলেটের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান জানিয়ে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন। এ উপলক্ষ্যে কনস্যুলেটে আয়োজিত কর্মসূচির মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুননেসাসহ কনস্যুলেটের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ। এ উপলক্ষ্যে ঢাকা হতে প্রেরিত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী’র বাণী পাঠ করা হয় এবং দিবসটির তাৎপর্য ও ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্বের উপর আলোচনা করা হয়। আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। এছাড়াও জাতির পিতা, তাঁর পরিবারের অন্যান্য শহীদ সদস্য ও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এবং দেশের অব্যাহত সমৃদ্ধির জন্য বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত করা হয়।অনুষ্ঠানে কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুননেসা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণই বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর মাহেন্দ্রক্ষণে আজকের দিবসটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। দিবসটি উদযাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশী-আমেরিকান নাগরিকগণ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম, বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানতে পারবেন এবং তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণে অনুপ্রাণিত হবে বলে কনসাল জেনারেল উল্লেখ করেন। এ সময় তিনি বলেন যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি সুখী, সমৃদ্ধ, শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
অনুষ্ঠানে কনসাল জেনারেল যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ব–দ্ধ হয়ে যারা দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন তাদের সকলকে শুভেচ্ছা জানান। নিউইয়র্কে করোনা ভাইরাসজনিত বৈশ্বিক মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে স্বাগতিক দেশের বিধি-বিধান প্রতিপালন করে কনস্যুলেটে এই দিবসটি পালন করা হয়। তবে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে কমিউনিটির অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাৎপর্যপূর্ণ ২০২১ সালটি উদযাপন করা হবে বলে কনসাল জেনারেল আশা প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতার প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এ অন্তর্ভুক্ত করে।
বঙ্গবন্ধুর ১০০ ছবির প্রদর্শনী : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ আন্দোলন-লড়াই-কারাবাস আর বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের পথ-পরিক্রমায় দুর্লভ ১০০টি ছবির প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। ২৫ দিনব্যাপী প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয় গত ৭ মার্চ অপরাহ্নে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের আলোকে এ প্রদর্শনী শুরু হলেও এটি উৎসর্গ করা হয় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর প্রতি। নিউইয়র্কস্থ মুক্তধারার উদ্যোগে জ্যাকসন হাইটসে আইএসপি ভবনের দু’তলায় এই প্রদর্শনীর ভার্চুয়ালে উদ্বোধন করেন জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। নিউইয়র্কে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রদর্শনী কেন্দ্র সংলগ্ন একটি মিলনায়তনে সুধীজনের উপস্থিতিতে এই প্রদর্শনীর গুরুত্ব উপস্থাপন করে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন প্রদর্শনীর সমন্বয়কারি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ। বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠযোদ্ধা রথীন্দ্রনাথ রায় এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমাম। সাংস্কৃতিক সংগঠক সেমন্তী ওয়াহিদের সঞ্চালনায় বঙ্গবন্ধু স্মরণে কবিতা আবৃত্তি করেন এফআরএম রাশেদুল হাসান ও স্বাধীন মজুমদার। প্রদর্শনীর কিউরেটর হচ্ছেন ড. ওবায়দুল্লাহ মামুন এবং সার্বিক সমন্বয়ে রয়েছেন বিশ্বজিৎ সাহা ও শুভ রায়। প্রতিটি ছবির ক্যাপশন ইংরেজীতেও থাকায় প্রবাস প্রজন্মে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন তথা বাঙালির মুক্তির জন্যে তার ত্যাগ-তিতিক্ষা সম্পর্কে সম্যক একটি ধারণা দেয়া সম্ভব হবে বলে মনে করছেন প্রবাসীরা। উদ্বোধনী পর্বে বিশিষ্টজনদের মধ্যে আরো ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশার চুন্নু, বীর মৃুক্তিযোদ্ধা লাবলু আনসার এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা রাশেদ আহমেদ। ৩১ মার্চ পর্যন্ত এই প্রদর্শনীতে আসতে আগ্রহীদেরকে ফোন করে অনুমতি সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। করোনার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখেই সোমবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা এবং শনি ও রবিবার সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত প্রদর্শনী উন্মুক্ত থাকবে।
বঙ্গবন্ধু পরিষদ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ, কারণ এই ভাষণ বিশ্বের শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ের ভাষণ বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা সভার বক্তারা। জুম কনফারেন্সে আয়োজিত যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু পরিষদের আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা ডঃ নুরুন নবী এবং সভা পরিচালনা করেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্বীকৃতি বড়ুয়া। আলোচনা সভায় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতৃবৃন্দ সংযুক্ত হন। ডঃ নুরুন নবী জাতির জনকের ৭ই মার্চের ভাষণের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন এবং ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে নিজের উপস্থিত থাকার অভিজ্ঞতার কথা বলেন। তিনি বলেন পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর পরেই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানের যে স্ট্রাকচার, তাতে বাঙালীদের স্বার্থ রক্ষা হবে না।
তখন তিনি পরিকল্পনা করতে থাকেন কিভাবে বাঙ্গালীদের অধিকার আদায়ে এগিয়ে যাওয়া যায়। তারপর তিনি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন, ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন পেছন থেকে এবং তখনি তিনি বাঙালী জাতীয়তাবাদের বীজ রোপণ করেন। সেই থেকে শুরু করে বাঙ্গালী জাতির অধিকার আদায়ে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু এবং সেই আন্দোলন সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে ৭ই মার্চ, যেই ৭ই মার্চের ভাষণে ৭ কোটী বাঙালীকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন। সভায় অন্যান্য বক্তারা বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে মাত্র ১৮ মিনিটের অলিখিত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শুধু দেশের স্বাধীনতা অর্জনের দিক নির্দেশনাই দিয়ে যাননি, স্বাধীনতা পরবর্তী অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির কথাও তিনি বলে গেছেন। এই ভাষণ আজ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণের একটি। অসংখ্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ। এটি ইউনেসকোর বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা গোটা দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত গর্বের। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় বঙ্গবন্ধুকে আমরাই রক্ষা করতে পারিনি, এটা আমাদের বাঙালীদের ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
Posted ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১১ মার্চ ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh