জাফর আহমাদ | বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
ই’তিকাফ শব্দের অর্থ আঁকড়ে ধরে রাখা। ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহ তা’আলার কল্যাণ সন্তুষ্টি ও রহমত অর্জনের জন্য রমযানের শেষ দশকে মসজিদে অবস্থান করাকে ই’তিকাফ বলা হয়। এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি প্রসিদ্ধ সুন্নাহ। মৃত্যু অবদি তিনি নিয়মিত ই’তিকাফ করেছেন। নবী সহধর্মিনী উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত যে, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের শেষ দশক ই’তিকাফ করতেন। তাঁর ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তাঁর সহধর্মিনীগণও ই’তিকাফ করতেন।”(বুখারী: ২০২৬, ২০৩৩, ২০৩৪, ২৯৪১ ২০৪৫ তাওহিদ পাব:, আ: প্র: ১৮৮৪, ই.ফা: ১৮৯৬. কিতাবুল ই’তিকাফ, বাবুল ই’তিকাফ ফি আশরে আওয়াখির…..)
ই’তিকাফ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলার নির্দেশনা হচ্ছে,“আর যখন তোমরা মসজিদে ই’তিকাফে বসো তখন স্ত্রীদের সাথে সহবাস করো না। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমারোখা, এর ধারে কাছেও যেয়োনা। এভাবে আল্লাহ তাঁর বিধান লোকদের জন্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, আশা করা যায় এর ফলে তারা ভুল কর্মনীতি গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে।”(সুরা বাকারা:১৮৭) ই’তিকাফে বসার মানে হচ্ছে, রমযানের শেষ দশদিন মসজিদে অবস্থান করা এবং এই দিনগুলোকে আল্লাহর যিকিরের জন্য নির্ষ্টি করা। এই ই’তিকাফে থাকা অবস্থায় নিজের মানবিক ও প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া যায় কিন্তু যৌন স্বাদ আস্বাদন করা থেকে নিজেকে সম্পুর্ণ দূরে রাখা একান্ত অপরিহার্য। আয়াতে শুধুমাত্র সীমারেখা অতিক্রম করার কথা বলা হয়নি বরং বলা হয়েছে, এগুলোর ধারে কাছেও যেয়ো না। এর অর্থ হচ্ছে, যেখান থেকে গোনাহের সীমানা শুরু হচ্ছে ঠিক সেই শেষ প্রান্তে সীমানা লাইন বরাবর ঘোরাফেরা করা বিপদজ্জনক। সীমান্ত থেকে দূরে থাকাই নিরাপদ ব্যবস্থা। কারণ সীমান্ত বরাবর ঘোরাফেরা করলে ভুলেও কখনো সীমান্তের ওপারে পা চলে যেতে পারে। রাসুলুল্লাহ সা:ও সীমানার কাছাকাছি না যাওয়ার হুকুম দিয়েছেন।
ই’তিকাফ কেন করবেন? ই’তিকাফ এর লক্ষ-উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর অবারিত কল্যাণ ও রহমতকে আঁকড়ে ধরা। রমযানের শেষ দশকে মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে এমন একটি মহিমানি¦ত রাত্রি দান করেছেন যা হাজার মাসের চাইতেও উত্তম। সেই বরকতময় রাত্রিকে আঁকড়ে ধরার জন্য মুসলিম উম্মাহ রমযানের শেষ দশকে ই’তিকাফে মসজিদে অবস্থান করেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“আমি এ (কুরআন) নাযিল করেছি কদরের রাতে। তুমি কি জানো, কদরের রাত কি? কদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও বেশী ভালো। ফেরেশতারা ও রুহ এই রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাযিল হয়। এ রাতটি পুরোপুরি শান্তিময় ফজরের উদয় পর্যন্ত।” (সুরা কদর)
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই রাত কোনটি। এ ব্যাপারে ব্যাপক মতবিরোধ দেখা যায়। এ সম্পর্কে ৪০টি মতের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে আলেম সমাজের অধিকাংশের মতামত হলো, রমযানের শেষ দশ তারিখের কোন একটি বেজোর রাত হচ্ছে এই কদরের রাত আবার তাদের মধ্যে বেশী ভাগের মত হচ্ছে সেটি সাতাশ তারিখের রাত। সবগুলো মতের পক্ষে সহীহ হাদিস বিদ্যমান রয়েছে। তাই সকল হাদীসের আলোকে ওলামায়ে কেরামের মতামতকে সামনে রেখে লাইলাতুল কদরকে পাওয়ার জন্য ই’তিকাফই হলো, উত্তমপন্থা। কাঙিতবস্তুটিকে পাওয়ার জন্য সাঁড়াশি অভিযান চালানো মতো হলো, ই’তিকাফ।
মুফাসসিরগণ সাধারণভাবে এর অর্থ করেছেন, এ রাতের সৎকাজ হাজার মাসের সৎকাজের চেয়ে ভালো। হযরত উবাদাহ ইবনে সামেত রা: থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সা: বলেছেন, “কদরের রাত রয়েছে রমযানের শেষ দশ রাতের মধ্যে। যে ব্যক্তি প্রতিদান লাভের আকাংখা নিয়ে এসব রাতে ইবাদাতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে আল্লাহ তার আগের পিছনের সব গোনাহ মাফ করে দেবেন।(মুসনাদে আহমাদ) বুখারী ও মুসলিমেও কদরের রাতেআমলের এ ধরণের ফযিলতের কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু আয়াতে উচ্চারিত শব্দগুলোতে এ কথা বলা হয়নি যে, কদরের রাতের আমল হাজার রাতের আমলের চেয়ে ভালো। বরং বলা হয়েছে যে, “কদরের রাতের আমল হাজার রাতের আমলের চেয়ে ভালো।” আর মাস বলতে একেবারে গুণে গুণে তিরাশি বছর চার মাস নয়। বরং আরববাসীদের কথার ধরণই এ রকম ছিল যে, কোন বিপুল সংখ্যার ধারণা দেবার জন্য তারা “হাজার” শব্দটি ব্যবহার করতো। তাই আয়াতের অর্থ হচ্ছে, এই একটি রাতে এত বড় নেকী ও কল্যাণের কাজ হয়েছে যা মানবতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে কোন দীর্ঘতম ইতিহাসে কোন দীর্ঘতম কালেও হয়নি।
এটি এমন এক রাত যে রাতে জিবরীল আমীন আ: তাঁর সাথীদের নিয়ে আল্লাহর অনুমতিক্রমে প্রত্যেক হুকুম নিয়ে নাযিল হন। তাঁরা ‘আমরে হাকীম’ বিজ্ঞতাপুর্ণ কাজ নিয়ে নাযিল হন। অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলার রাজকীয় ব্যবস্থাপনায় এটা এমন এক রাত যে রাতে তিনি ব্যক্তি, জাতি এবং দেশসমুহের ভাগ্যের ফায়সালা অনুসারে কাজ করতে থাকে। এটি এমন এক রাত যা সন্ধা থেকে সকাল পর্যন্ত সারাটা রাত শুধু কল্যাণ আর কল্যাণে পরিপূর্ণ। সেখানে ফিতনা, দুস্কৃতি ও অনিষ্টকারিতার ছিটেফোটাও নেই। তাফসীরে মার’আরেফুল কুরআনে বলা হয়েছে, ফেরেশতাগণ সারা বছরের অবধারিত ঘটনাবলী নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। এ রাত্রিটি যাবতীয় অনিষ্ট ও বিপদ-আপদ থেকে শান্তিস্বরূপ।(ইবনে কাসির) কুরতবী বলেছেন, এ রাত্রিটি শান্তি শান্তিই, মঙ্গলই মঙ্গল। এতে অনিষ্টের নামই নেই। মাযহারী বলেছেন, ফেরেশতাগণ শান্তি ও কল্যাণকর বিষয় নিয়ে অবতীর্ণ হন। ফযর পর্যন্ত কল্যাণের এ ধারা অব্যাহত থাকে।
কোন কোন তাফসীরকার কদরকে তকদীর অর্থে গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ এই রাতে আল্লাহ তকদীরের ফায়সালা জারী করার জন্য তাঁর ফেরেশতাদের হাতে তুলে দেন। অন্যদিকে ইমাম যুহরী বলেন, কদর অর্থ হচ্ছে, শ্রেষ্টত্ব ও মর্যাদা। অর্থাৎ এটি অত্যন্ত মর্যাদশালী রাত। এই অর্থ সমর্থন করে এই সুরার নিম্নোক্ত আয়াতটি“কদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও উত্তম।”
এই একটিমাত্র রাত্রি যার মধ্যে সৎকাজ হাজার মাসের সৎকাজের চেয়ে ভালো। এ জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ রাত্রিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। আয়েশা রা: বলেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যান্য সময়ের তুলনায় রমাযানের শেষ দশকে অধিক পরিমাণে সচেষ্ট থাকতেন যা অন্য সময়ে থাকতেন না।”(মুসলিম: ২৬৭৮, হাদীস একা:, ই.ফা: ২৬৫৫, ই,সে:২৬৫৪, কিতাবুল ই’তিকাফ, বাবুল ইজতেহাদি ফি আশরি আওয়াখির…)
আল্লাহ তা’আলা তাঁর অন্যান্য নবী-রাসুল ও তাঁদের উম্মতগণকে শত শত কিংবা হাজার বছর পর্যন্ত জীবন দান করেছেন। তাঁরা বছরের পর বছর আল্লাহর ইবাদাত বন্দেগীতে জীবন কাটিয়েছেন। সে হিসাবে আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে স্বল্প আয় বা জীবনকাল দান করেছেন। কিন্তু দয়া করে আমাদেরকে এমন এমন কিছু সময় ও মহুর্ত দান করেছেন সেই সাথে দান করেছেন অফুরন্ত বরকত। তিনি দয়া করে আমাদেরকে দান করেছেন এক মহিমান্বিত রাত্রি যার নাম লাইলাতুল কদর। এ রাত্রিটি যার ভাগ্যে জুটে তিনি হাজার বছরের রাত্রি পেলেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ এ রাত্রিটিকে রমযানের শেষ দশকের কোন রাত্রি তা নির্দিষ্ট করেননি। তবে বেজোড় রাত্রি হিসাবে তিনি উল্লেখ করেছেন। তাই মুসলিম উম্মাহ এই রাত্রটি পাওয়ার জন্য শেষ দশদিন ই’তিকাফে বসে যান।
আবু সাঈদ খুদরী রা: থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের মধ্যম দশকে ই’তিকাফ করতেন। এক বছর এরূপ ই’তিকাফ করেন, যখন একুশের রাত এলো, যে রাতের সকালে তিনি তাঁর ই’াতকাফ থেকে বের হবেন, তখন তিনি বললেন: যারা আমার সাথে ই’তিকাফ করেছে তারা যেন শেষ দশকে ই’তিকাফ করে। আমাকে স্বপ্নে এই রাত দেখানো হয়েছিল। পরে আমাকে তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অবশ্যি আমি স্বপ্নে দেখতে পেয়েছি যে, ঐ রাতের সকালে আমি কাদা-পানির মধ্যে সেজদা করছি। তোমরা তা শেষ দশকে তালাশ করো এবং প্রত্যেক বেজোর রাতে তালাশ করো। পরে এই রাতে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়, মসজিদের ছাদ ছিল খেজুর পাতার ছাউনির। ফলে মসজিদে টপ টপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। একুশের রাতের সকালে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কপালে কাদা-পানির চিহ্ন আমার এ দু’চোখ দেখতে পায়।” (বুখারী: ২০২৭, তাওহিদ পাব, আ.প্র. ১৮৮৫, ই.ফা:১৮৯৭, কিতাবুল ই’তিকাফ, বাবুল ই’তিকাফ ফি আশরে আওয়াখির…..)
ই’তিকাফে বসার অর্থই হচ্ছে, রমযানের শেষ দশ দিন মসজিদে অবস্থান করা, নিজেকে আল্লাহর জন্য, আল্লাহর ইবাদাতের জন্য সুনির্দিষ্ট করে দেয়া এবং নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করে দেয়া। পরিণামে মহান আল্লাহ তাকে কল্যাণ ও বরকত দ্বারা সিক্ত করে দিবেন। এ যেন সেই আয়াতের প্রতিধ্বনি যেখানে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “কাজেই যখনই অবসর পাও ইবাদাতের কঠোর শ্রমে লেগে যাও। এবং নিজের রবেরই প্রতি মনোযোগ দাও।”(আলাম নাশরাহ:৭-৮) সুতরাং লাইলাতুল কদরের মহাকল্যাণ লাভ করার জন্য রমযানের শেষ দশদিন দুনিয়ার সমস্ত ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে একান্তভাবে আল্লাহর জন্য কঠোর ইবাদাতে লেগে যাওয়া এবং মহা কল্যাণ তালাশ করা একান্ত প্রয়োজন। আল্লাহ তা’আলা আমাদের প্রত্যেককে এই কল্যাণ ও বরকত লাভ করার জন্য ই’তিকাফে বসার তাওফিক দিন। আমিন।
Posted ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh