রওশন হক : | বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫
বাংলা ইসলামী কাব্যধারার অন্যতম প্রধান কণ্ঠ ফররুখ আহমেদ আধ্যাত্মিকতা, সৌন্দর্যবোধ ও মানববিশ্বের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে এক নতুন নন্দনতত্ত্বে রূপ দিয়েছিলেন। তাঁর কবিতা শুধু শব্দের সৌন্দর্য নয়, বরং মানসিক জাগরণ, নৈতিক চেতনা ও নন্দন-দর্শনের শক্তিকে একত্রে ধারণ করে। সিরাজাম মুনিরা তাঁর কাব্যসৃষ্টির মধ্যবর্তী পর্যায়ের একটি বিশিষ্ট অর্জন, যেখানে আলোক, নীল আকাশ, পাখি, প্রভাতের তৎপরতা এবং আধ্যাত্মিক অন্বেষা মিলিত হয়েছে এক বৃহত্তর প্রতীকে। উদ্ধৃত অংশটি সেই প্রতীকী কাঠামোর এক উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
কবিতার সূচনায় তুলে ধরা হয়েছে পূর্বাচলের নীল আকাশে আলোক-পাখীর জাগরণ। “সে জাগে শাহানশাহের মত” – এই তুলনা কবির কাছে আলোর পরম প্রতাপ ও মহিমার প্রতীক। আলোর উদয়কে তিনি শুধু প্রাকৃতিক ঘটনায় সীমিত রাখেননি; এটিকে নৈতিক উত্তরণ ও মানসিক জাগরণের প্রতীক রূপে দেখিয়েছেন। এই প্রভাত যেন অন্ধকারের স্থবিরতা ভেঙে নতুন আশাবোধের জন্ম দেয়। তাই তাঁর প্রশ্ন – “ঘুম ভাঙলো কি হে আলোর পাখি?” – মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগিয়ে তোলার এক আধ্যাত্মিক আহ্বান।
উদ্ধৃত অংশজুড়ে পাখি একটি কেন্দ্রীয় প্রতীক। এই পাখি বাস্তব জগতের পাখির চেয়ে অনেক বেশি; এটি ঐশী বার্তাবাহক, সৃষ্টির গভীর রহস্যের অনুসন্ধানী এবং মানবমানসের পরিশুদ্ধতার প্রতীক। পাখির “শ্বেত পাখা” পবিত্রতার প্রতীক, আর তার আগমনে “আকাশের বুক ঘন হয়ে ওঠে নীল মরকত স্বচ্ছতায়”- এই চিত্রকল্প ফররুখের কাব্যদক্ষতার অসাধারণ উদাহরণ। নীল আকাশ এখানে রহস্যময় ও আধ্যাত্মিক জগতের প্রতীক; পাখির আগমনে সেই নীলিমা যেন আরও উজ্জ্বল ও অর্থবহ হয়ে ওঠে।
কবির ভাষার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর চিত্রকল্পের দ্বৈততা। দৃশ্যমান প্রকৃতির সঙ্গে তিনি অদৃশ্য আত্মিক বিশ্বের যোগসূত্র স্থাপন করেন। পাখির “পক্ষ-সঞ্চারে ভাষা-ভাবের কুসুম” ফুটে ওঠা মানে কবিতার জন্ম, আত্মার জাগরণ ও সৃষ্টিশীল শক্তির উন্মোচন। পাখির “জরিন জরির ফিতা” কল্পনা, জ্ঞান এবং সুপ্ত মানসিক সৌন্দর্যের বর্ণিলতা প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে কবি বুঝিয়ে দেন যে মানবমন অসীম সম্ভাবনার বাহক এবং সেই সম্ভাবনা উন্মোচিত হয় আলোর নির্দেশনায়।
ফররুখ আহমেদ এখানে অজানা সাগর ও সোনার দ্বীপের চিত্র এনেছেন। এটি মানুষের চেতনার অনাবিষ্কৃত অঞ্চল এবং নৈতিক-আধ্যাত্মিক সম্ভাবনার রূপক। মানবজীবনের গভীরে যত অস্থিরতা ও অন্ধকারই থাকুক, আলোর নির্দেশনায় সেই মানসে নতুন দ্বীপ জন্ম নিতে পারে। তরুণ মনের “লাল কমল” এই নবজন্মের প্রতীক; যা ভবিষ্যতের আশা, সৃষ্টিশীল শক্তি ও নির্মলতার ইঙ্গিত দেয়।
সব মিলিয়ে সিরাজাম মুনিরার এই অংশে ফররুখ আহমেদ আলোর দর্শনকে মানবজাগরণের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। আলোক-পাখী এখানে স্রষ্টার রহমতের প্রতীক, আর নীলাকাশ অশেষ সম্ভাবনার আকাশ। কবি বিশ্বাস করেন, মানুষের আত্মা যখন আলোর ডাকে সাড়া দেয়, তখন তার সামনে উন্মোচিত হয় নতুন সত্য, নতুন নন্দন ও নতুন পথ। এই অংশ তাই শুধু কাব্য-সৌন্দর্য নয়; এটি ফররুখের আধ্যাত্মিক মানবতাবাদের এক গম্ভীর ও মহিমান্বিত ঘোষণা।
বাংলা সাহিত্য ইতিহাসে আমরা সাধারণত নজরুল ইসলামকে “বিদ্রোহের কবি” হিসেবে স্মরণ করি; কিন্তু বাস্তবে কবি ফররুখ আহমেদও কোনো অংশে কম ছিলেন না। তাঁর কবিতার আধ্যাত্মিকতা, নান্দনিকতা ও ঐশী স্বপ্নদর্শনের আড়ালে যে অগ্নিগর্ভ প্রতিবাদী চেতনা লুকিয়ে ছিল, তাকে প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। সিরাজাম মুনিরার উদ্ধৃত অংশে যে আলোক-পাখীর জাগরণ, ভোরের শাহানশাহি উত্তরণ, এবং অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর বিজয় – এসবের মধ্যেই কবির সেই সাহসী, নত না হওয়া, অন্তর্গত বিদ্রোহের ছাপ স্পষ্টভাবে দেখা যায়। ফররুখের কবিতার ভাষা নিছক সৌন্দর্যচর্চা নয়, বরং নৈতিক দৃঢ়তা ও ন্যায়বোধের এক অদেখা শক্তিসঞ্চার।
ব্যক্তিজীবনেও ফররুখ ছিলেন অবিচল প্রতিবাদের প্রতীক। পাকিস্তান আমলে তিনি রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের কথিকা লেখক হিসেবে চাকরি করতেন। কিন্তু রাষ্ট্রের অনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাঁর আপসহীন মনোভাব, সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর স্বতন্ত্র অবস্থান এবং অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার না করার প্রবণতা তাঁকে একসময় চাকরিচ্যুত করে। ফররুখ আহমেদের এই বহিষ্কার কোনো সাধারণ প্রশাসনিক ঘটনা ছিল না – এটি ছিল একজন কবির সত্যনিষ্ঠ অবস্থানের বিরুদ্ধে ক্ষমতাবানদের প্রতিশোধ।
কিন্তু কবি থেমে থাকেননি। তিনি প্রতিবাদ করেছেন, লেখনিতে ও অবস্থানে। যে মানুষটি তাঁর কবিতায় আলোর পাখিকে ডেকে বলেন-ঘুম ভাঙলো কি হে আলোর পাখি?”- তিনি নিজেও অন্যায়ের ঘুম ভাঙাতে চেয়েছেন। বেতার থেকে চাকরি হারানোর পরও তিনি নীরব হননি; বরং সত্যের পক্ষে তাঁর দৃঢ় অবস্থান সরকারকে বাধ্য করে পুনরায় তাঁকে চাকরিতে ফিরিয়ে নিতে। এই পুনর্বহালই প্রমাণ করে, ফররুখ শুধু কাব্যের সাধকই নন, তিনি এক অবিনত আত্মার পুরুষ, যিনি নীরব নিপীড়নের সামনে মাথা নত করেননি।
ফররুখের কবিতায় যে আলো – তা শুধু আধ্যাত্মিক নয়, বিদ্রোহীও। তাঁর “আলোক-পাখী” আসলে মুমূর্ষু সমাজের অন্ধকার বিদীর্ণ করা এক বিপ্লবের প্রতীক। “রাত্রি-রুদ্ধ কণ্ঠ হতে ঝরে দিনের গান” – এ যেন কবির নিজের কণ্ঠস্বরও; প্রতিকূলতার অন্ধরাত্রি ভেদ করে যা সত্য, ন্যায় ও মর্যাদার দিনের দিকে অগ্রসর হয়। ফররুখের আলোক-রূপকগুলো আসলে মানবজাগরণ ও প্রতিবাদের শিল্পরূপ।
উদ্ধৃত অংশের প্রতিটি চিত্রকল্প / নীল মরকতে ভোরের আলো, শ্বেত পাখায় উড়ে আসা বিহঙ্গ, তরুণ মনের লাল কমল – এসবই ফররুখের বিশ্বাসকে স্পষ্ট করে ঃ মানুষের ভিতরে আলোর জন্মই সত্যিকারের মুক্তি। যে পাখি “সমস্ত সাগরের অশ্রুজল” নিজের পাখায় ধারণ করে, সে আসলে নিপীড়িত মানুষের বেদনা ও স্বপ্নের বাহক। এই স্বপ্নই কবিকে জীবনযুদ্ধে অনমনীয় করেছে।
সুতরাং ফররুখ আহমেদকে শুধু আধ্যাত্মিকতার কবি বলা তাঁর প্রতি অবিচার। তিনি ছিলেন সৌন্দর্য ও বিদ্রোহ – দুইয়েরই সমান জাগ্রত রূপ। যেখানে নজরুলের বিদ্রোহ অগ্নিবাণীর, সেখান ফররুখের বিদ্রোহ আলোর – তবু দু’জনের লক্ষ্য একই ঃ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের জয়। সিরাজাম মুনিরার আলোক-পাখী তাই শুধু কাব্যিক প্রতীক নয়; এটি একজন আপসহীন কবিমনের প্রতিবাদী উড়ান – যা অন্ধকারের বিরুদ্ধে নীলিমার দিকে ছুটে যায় অবিরাম।
Posted ১১:৩৫ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh