| মঙ্গলবার, ১৪ জুলাই ২০২০
কবি শামসুর রাহমান। আমার আব্বু। আমার জন্মদাতা নন; কিন্তু আপন বাবার চেয়েও অধিক ছিলেন। আমার ভাবনা, চিন্তা, আমার অস্তিত্বের একটি অংশ তিনি। আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন কবি শামসুর রাহমান। আজ প্রতিটি মুহূর্তে তাঁর কথা মনে পড়ে।
আজ ১৪ বছর আব্বু আমাদের মধ্যে নেই। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন আব্বু। মনে পড়ে, যখন তাঁর পুত্রবধূ হয়ে আসি, প্রথম দিন থেকেই আমাকে স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছেন। বিয়ের পরদিন খুব সকালে আব্বুর পায়ে হাত দিয়ে যখন সালাম করলাম, আব্বু আমাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে তাঁর চেয়ারে বসতে বললেন। কিন্তু আমি ইতস্তত করছিলাম। একে তো নতুন বউ, তার ওপর এত বড় একজন কবি, আমার শ্বশুর, তাঁর আসনে কিভাবে বসি! আব্বু আমাকে বললেন, এখন থেকে এই চেয়ারে বসার অধিকার তোমাকে দিলাম। এটা যে আমার জন্য কত বড় গর্বের, কত বড় ভালোবাসার নিদর্শন তা ভাবলে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সেদিন থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ১৫ বছর আপন মেয়ের মতো আব্বুর স্নেহ পেয়েছি। আমার শাশুড়ি অসুস্থ থাকায় আব্বুর ওষুধপত্র থেকে তাঁর দেখাশোনা আমি করতাম। আমার অপার সৌভাগ্য, আমি আমার শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করার সুযোগ পেয়েছি।
আব্বুর থাকা এবং না থাকার ২৯ বছর। এই পুরোটা সময় আব্বু আমার সঙ্গেই আছেন। আমি শামসুর রাহমানের মেয়ে, আমি তাঁর পুত্রবধূ, এর চেয়ে গৌরবের আর কিছু হতে পারে না।
তাঁর ব্যবহার ছিল অমায়িক। মানুষকে খুব সম্মান করতেন। কখনো কেউ বলতে পারবে না, কবি শামসুর রাহমান কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন। রাত ১২টা, ১টায় বাসায় অনেকে আসতেন। তিনি কখনো কাউকে না করতেন না। অনেক সময় ফোন আসত। কখনো বিরক্ত হতেন না। কখনো কখনো আমাকে ফোন ধরতে বলতেন। তাঁর আরেকটি দিক আমার খুব চোখে পড়ত। তিনি তাঁর মাকে খুব ভালোবাসতেন। দাদী একবার দেড় বছর আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তখন দেখেছি, মায়ের প্রতি তাঁর কত খেয়াল। কী অগাধ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা মায়ের জন্য। দাদী হয়তো নামাজ পড়তেন, কোরআন পড়তেন, এরপর ছেলের ঘরে গিয়ে বসে থাকতেন। দাদী এটা-ওটা বলতেন; কিন্তু বাবা শুধু শুনতেন। কখনো কখনো ‘হুঁ’-‘হা’ উত্তর দিতেন। কিন্তু আব্বু মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। কী যেন খুঁজতেন মায়ের মুখে! আমি দূর থেকে লক্ষ করতাম, কী অসীম মমতায় মায়ের মুখে চেয়ে আছেন আমার আব্বু!
অসম্ভব বিনয়ী, ভদ্র আমার আব্বুর মধ্যে কখনো লোভ ছিল না। অর্থ, গাড়ি, বাড়ির পেছনে ছোটেননি কখনো। তাঁর একটি মাত্র ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল। কিন্তু ব্যাংক ব্যালান্স ছিল না। মাঝেমধ্যে লেখার সম্মানীর চেক এলে আমি তা জমা দিয়ে আসতাম। শুধু একটা জিনিসের প্রতি তাঁর সমস্ত আকাক্সক্ষা ছিল, কিভাবে আরো ভালো কবিতা লেখা যাবে! তাঁর অসংখ্য লেখার সাক্ষী আমি। কত কবিতার জন্ম দিতে দেখেছি! একটি কবিতার কথা খুব মনে পড়ছে। আমার দাদী শাশুড়ির মৃত্যুর কিছুদিন পর রাত আড়াইটায় তিনি একটি কবিতা লিখলেন ‘রাত আড়াইটার পঙিক্তমালা’ শিরোনামে। কবিতাটি পড়ার পর বাসার সবার মন ভেঙে কান্না এলো। মায়ের মৃত্যুর পর মাকে নিয়ে লেখা কবিতায় যে আবেগ ও যন্ত্রণা কবি লিখে রেখেছেন, আজও মনটা হু হু করে ওঠে।
আব্বু যখন মারা যান, আমার দুই মেয়ে নয়না আর দিপিতা তখন সবে স্কুলে পড়ে। আজ যখন ওরা বড় হয়ে যাচ্ছে, জীবনের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখনো আমার আব্বুকে ছায়া হিসেবে যেন পাই। মনে হয়, দূর থেকে তিনি প্রিয় নাতনীদের দেখে রাখছেন। নয়না ইংরেজিতে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে। দিপিতা ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে পড়ছে। দিপিতা মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার বেশ পরে একবার তার কলেজে গিয়ে অধ্যক্ষ স্যারের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তখন পরিচয়ে জানিয়েছিলাম, আমি কবি শামসুর রাহমানের পুত্রবধূ। তিনি ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। সম্মানবোধ করেছেন, কবি শামসুর রাহমানের নাতনী তাঁর স্টুডেন্ট। আব্বু এভাবেই আমাদের গৌরবের অংশীদার করে রেখেছেন।
আব্বু অনেক লিখতেন। জীবনের শেষ দিকে এসে অসুস্থতার জন্য লিখতে পারতেন না। তবু বিভিন্ন পত্রিকা থেকে অনুরোধ আসত নতুন কবিতার জন্য। আব্বু চেষ্টা করতেন। তাঁর অনেকগুলো বই। এসব বই যাঁরা প্রকাশ করেছেন, তাঁরা অসম্ভব ভালো মানুষ। অর্থাৎ আব্বুর প্রকাশকভাগ্য খুব ভালো। এমনিতেই কবিতার বই খুব বেশি বিক্রি হয় না। কিন্তু এর পরও অনন্যার মনির ভাই, সাহিত্য প্রকাশের মফিদুল হক চাচা, অন্যপ্রকাশের মাযহার ভাই, ঐতিহ্যের নাঈম ভাইসহ প্রত্যেকে আমাদের নিয়মিত খোঁজখবর নেন। উদারভাবে সম্মানী দিয়ে আসছেন। এ ছাড়া আরো অনেকেই আছেন, যাঁরা কবির অবর্তমানেও আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। না রাখলেও চলত, তবু তাঁরা রাখেন। প্রথম আলোর মতি চাচা, সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন ভাই- এ রকম আরো অসংখ্য নাম আছে, যাঁরা সব সময় আমাদের পাশে আছেন। কাজী শাহেদ আহমেদের কথা কখনো ভুলতে পারব না। তিনি আব্বু-আম্মুকে খুব ভালোবাসতেন, খুব সম্মান করতেন। তিনি আব্বুর জন্য যা করেছেন, কোনো দিন সেই ঋণ শোধ করা যাবে না।
টুকরো টুকরো অনেক প্রসঙ্গ, অনেক কথা। আর প্রতিটি কথায় আব্বুর স্মৃতি। আব্বু পিঠা খেতে খুব পছন্দ করতেন। পাটিসাপ্টা পিঠা। গরুর মাংস খেতে খুব পছন্দ করতেন। আব্বু খুব নিয়ম করে চলতেন। অনেক সময় কবি-সাহিত্যিকদের অনিয়ম করার প্রবণতা থাকে। আব্বুর একেবারে তা ছিল না। সকাল ৮টার মধ্যে নাশতা করতেন। সবাইকে টেবিলে নিয়ে নাশতা করতেন। ১টার মধ্যে দুপুরের খাবার খেতেন। বিকেল ৪টার মধ্যে চা-নাশতা। এসব একটা রুটিনের মতো ছিল। আর এই রুটিন অনুযায়ী আমাকে সব আয়োজন করতে হতো। এ সবকিছুই আমি ভীষণ মিস করি।
নয়না প্রচুর বই পড়ে। দিপিতা দাদার মতো লেখালেখি পছন্দ করে। সেও প্রচুর বই পড়ে। আবৃত্তি করে। ওরা ওদের দাদুকে খুব মিস করে। আব্বু প্রায়ই বলতেন, ‘আমি তো থাকব না, ওদের প্রতিষ্ঠিত হওয়া দেখে যেতে পারব না।’ এই আক্ষেপ সব সময় আব্বুকে ভাবাত।
১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর তাঁর জন্ম। আজ তিনি নেই। তাঁর জন্মদিন আসে। মৃত্যুদিন আসে। কত ভক্ত তাঁকে স্মরণ করেন। যখন কবি বেঁচে ছিলেন, নিজে কখনো জন্মদিন পালন করেননি। অসংখ্য মানুষ ফুল নিয়ে আসতেন। উপহার নিয়ে আসতেন। বাসা ভরে যেত। তাঁরাই কবির জন্মদিন উদযাপন করতেন। রাজধানীর বনানীর কবরস্থানে চিরঘুমে শুয়ে আছেন কবি শামসুর রাহমান। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের অনুভবে থাকেন আব্বু। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন, শান্তিতে থাকুন; পিতার ঊর্ধ্বে আমার পিতা।
অনুলিখন : মাহমুদ শাওন।
Posted ১১:৩৫ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৪ জুলাই ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh