সানজিদা হোসাইন | বৃহস্পতিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১
ছেলেটা যখন জন্ম নিলো
তখনো সে জানতো না..
তার পৃথিবী হবে ভাষাহীন।।
আতুর ঘরে মায়ের শেষ মুহূর্তের যন্ত্রণা পেরিয়ে
যখন পৃথিবীর আলো দেখলো,
চাপা উদ্বেগে ধাত্রী লক্ষ্য করলো,
গলার শিরা ফুলে উঠছে, নিঃশ্বাস আটকে আসছে,
কিন্তু শব্দ বেরোচ্ছে না।
কয়েক বছর পেরোতেই সে বুঝতে পারলো..
তার পৃথিবী শব্দহীন, ভাষাহীন।।
শুরুর দিকে খুব চেষ্টা করতো
একটু আওয়াজ করতে,
কখনো ভীষণ চেষ্টায় একটু চাপা গোঙানির মতো আওয়াজ বের হলেও..
একটা শব্দও বলতে পারতো না..
ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠলো।
ভাষাহীন পৃথিবীতে একটা ছোট্ট শিশু
‘মা’ বলে ডাকতে না পারায়
পৃথিবীর কোথাও কিছু আসলো গেলো না।
আকাশ, বাতাস, ফুল, পাখি
সবকিছুর সাথে নিজের মতো করে
সখ্যতা গড়ে তুললো।
তার মুখে ভাষা নেই বলে
প্রকৃতির কোথাও কিছু তাকে অবজ্ঞা করেনি।
ভাষাহীন পৃথিবীতে যাদের নিষ্ঠুরতা তাকে আঘাত দিতো.. তারা মানুষ।
সে ভাবতো – ভালোই হয়েছে…
আমি এমনি নির্বাক, আমায় আর তোমরা কি বাকরুদ্ধ করবে?
এভাবেই চলছিল…
হঠাৎ করেই ছেলেটা টের পেলো
কোথায় যেন, কি যেন একটা অস্থিরতা বাড়ছে।
জন্মাবধি যে ভাষাহীনতায় সে একা ভুগছিলো,
হঠাৎ করেই তার চারপাশের সবাক প্রাণগুলো
সেই ভাষার জন্য রগ ফুলিয়ে শ্লোগান দিচ্ছে…
মাতৃভাষা বাংলা চাই।।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।।
সকালের নাস্তায়, দুপুরের খাবার টেবিলে..
পাড়ার মোড়ে, কলেজ ক্যান্টিনে…
খবরের কাগজে, রেডিওতে…
দেয়ালের পোস্টারে, মস্তিষ্কে ও মননে..
আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে।
ভাষাহীন ছেলেটা দেখলো,
সবাক মানুষগুলোর বুকেও
টগবগ করে ফুটছে প্রতিবাদ…
ভাষা চাই, ভাষা চাই।।
সেই প্রথম বার আতুর ঘরে
চিৎকার করার জন্য যেমন সংগ্রাম করতে হয়েছিল তাকে,
শ্লোগানে শ্লোগানে, মিছিলে মিছিলে তেমন ভাবেই
গলার শিরা ফুলে উঠছে তরুনদের।
ভাষা চাই.. ভাষা চাই।।
মাতৃভাষা বাংলা চাই।।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।।
একদিন পাড়ার দাদারা মিটিং এ তার দিকে আঙুল তুলে বললো,
“আমরা তো ওর মতো বাধ্য চুপচাপ ছেলে নই।
আমাদের গলা দিয়ে তো আওয়াজ বেরোয়।
আমাদেরকেও বোবা করে দেবে ওর মতো?
না… এভাবে আমাদের ওপর অন্য ভাষা চাপিয়ে দিতে পারে না।
এভাবে আমাদের মুখের ভাষা ওরা কেড়ে নিতে পারে না।”
মুহুর্তেই… কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা সংকোচে মাথা নিচু করে সরে পড়ে ছেলেটা।
বোবা হয়ে যাবে সবাই? তার মতো?ৃ
তাকে তো বিধাতা গলার আওয়াজ দেননি।
কিন্তু যাদের মুখে ‘মা’ ডাক দিয়ে বিধাতা পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন,
তাদের মুখের ভাষা কারা কেড়ে নিতে চায়?
আছে কেউ এমন বিধাতার চেয়ে শক্তিশালী?
দুদিন পর হঠাৎ একদিন সকাল বেলা..
ঢাকার বুকে বিক্ষোভের ঝড় উঠলো।
দিনটা ছিল ফেব্রুয়ারির একুশ…
জোর করে চাপিয়ে দেয়া সমস্ত ফরমান ভেঙে গুড়িয়ে দিতে চাইছে
বুকে আগুন নিয়ে গর্জে ওঠা বঙ্গসন্তানেরা।
মায়ের বারন, ভাইয়ের শাসন উপেক্ষা করে ব্যারিকেড ভেঙ্গে এগিয়ে চললো দামাল ছেলের দল।
হঠাৎ গর্জে উঠলো স্বেচ্ছাচারীদের বন্দুক,
বুলেটে বুলেটে বিক্ষত হয়ে উঠলো ঢাকার রাজপথ।
চারিদিকে হৈচৈ, চিৎকার, ছোটাছুটি ছাড়িয়ে ছেলেটা ধীর পায়ে বারান্দা থেকে নেমে এলো রাস্তায়।
সে জানে বোবা হয়ে বেঁচে থাকার কি কষ্ট..
এগিয়ে গেলো ভাষার জন্য লড়াই করতে।
একটু দূরে গিয়েই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তার শব্দহীন, ভাষাহীন নিরব নিথর দেহ।
তীব্র কষ্টে তার ঝাঝড়া হয়ে যাওয়া বুক থেকে প্রথম এবং শেষবারের মতো
একটা শব্দ ছিটকে বেড়িয়ে এলো!!
মা…… মা……
Posted ১১:২৫ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh