আশরাফ উদ্দীন আহ্মদ | বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১
নতুন বিয়ে করা বউ বলে কথা । এ তো আর যার তার ভাগ্যে জোটে না, একটা রগরগে কচি মেয়ে পাওয়া মানে তো বিশাল ব্যাপার, নিজের করে পাওয়া একটা আস্তো মেয়েমানুষকে। ভাবতেই মনটা কেমন আনমনা হয়ে যায় হাকিম পাগলার। কতো ভাগ্য করে এসেছিলো বলেই তো বিয়ের সাধ তার পূরণ হলো জীবনে, অথচ কতো মানুষই তো আছে বিয়ে না করেই ছেলেপুলের মুখ না দেখেই হুটহাট করে মরে গেলো। এমন তো হরদম ঘটছে, কিন্তু তার বেলায় ঘটলো না, এটাই তো মূল কথা।
হাকিম এখন বেশ আমোদেই আছে, কতো স্বপ্ন দেখেছে একটা মেয়েমানুষের জন্য, যে শুধু তার হবে, তাকেই জীবনভর ভালোবাসবে, কতো গল্প কতো আনন্দ কতো কথা সে জমিয়ে রেখেছে,আজ তার বিয়ের বয়স তিন দিন। যদিও ভালো করে বউটাকে এখনো দেখাও হয়নি। রাত্রে তো ঘুমে অস্থির ছিলো, দিনের বেলা যে ভালো করে দেখবে তারও কোনো সুযোগ নেই। তবে যাই হোক না কেনো, বউটা যে বেশ লক্ষèী তা অনুধাবণ করা যায়। হাকিম বসে-বসে চিন্তা করতে থাকে, তার তো তিন কুলে কেউই নেই, মা-বাপ কাকে বলে তা জানে না, বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই মন্ডল সাহেবকে বাপ বলে জেনে এসেছে, এ’বাড়িখানা যেন তারই, এ বাড়ির কেউ না হয়েও বিনা সুতোয় সে অতি আপনজন হয়ে গেছে। সেই মন্ডল বাপই অনেক সখ করে বিয়ে দিয়েছে হাকিম পাগলার, কাছেপিঠে গাঁয়েরই মেয়ে বটে রত্না। ক’দিনেই বাড়ির কাজকাম বেশ রপ্ত করে ফেলেছে, মন্ডলগিন্নি তো নিজের ছেলের বউয়ের মতো সব কিছু বুঝিয়ে-সুজিয়ে দিচ্ছে, হাকিমের ভালো লাগে দেখতে।
রত্নার চোখ দুটো নাকি বেশ সুন্দর, কে যেন সেদিন বলছিলো, কাজকামের বেশ চটপটে, মানুষজনকে আপন করে নিতেও পারে, অথচ কি আশ্চর্য শুধু মাত্র হাকিমকে সে এখনো আপন করে নিতে পারেনি। হাকিম তো তীর্থের কাকের মতো হা-হাপিত্তস করে বসে আছে কখন তার হবে, একটা মেয়ে মানুষ শুধু যে তার হবে এও বিশ্বাস করতে মনটাই কেমন খটকা লাগছে। মন্ডলগিন্নির কোনো ছেলেপুলে নেই, তাতে কি হাকিম তো আছে, মন্ডল সাহেব যখন যেভাবে তাকে ডাকে, সে তখনই উপস্থিত হয়,দলিজে বসেই ফয়ফরমায়েস করে সর্বদা, হাকিম তখন আশেপাশেই থাকে। এ’ বাড়ির সে যে কতো বড় একজন সদস্য তা সে ছাড়া আর কে জানে।
রাত্রে যখন হাকিম একেবারে আপন করে রত্নাকে কাছে পায়,তখন সে এক অন্যরকম অনুভূতি জাগে তার। কিন্তু রত্না কোনোরকম সাড়া দেয় না, একটা নিস্তল পাথর। রাত্রি বাড়ে নিজের নিয়মে কিন্তু কে কার, একসময় হাকিম আবিস্কার করে রত্না ঘুমিয়ে গেছে, শরীর তার ঘুমের মহাসাগরে ভেসে আছে আর কিছু ভাবতে পারে না। সমস্ত দিনের ভাবনাগুলো কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। কাছে পেয়েও নিজেকে বড় দীন-দরিদ্র মনে হয়। কতো কথা ছিলো মনের কোণে জমানো, অথচ সবই ঝরে-ঝরে পড়ে ফুলের পাপড়ির মতো। নিজেকে অসহায় লাগে। কিছুই করার নেই, আশা মরে গেলে কি থাকে তারপর, কিন্তু হাকিম তারপরও আশায় থাকে, হয়তো এরপরের রাত্রে আসবে সেই কাঙ্খিত সময়। আবার ভোর আসে প্রকৃতির মতো মানুষ জেগে ওঠে, ছুটে যায় দিনের কাজে, রত্না বাড়ির ঘরগেরস্থালীর কাজে ব্যস্ত হয়ে ওঠে, হাকিম চলে যায় মন্ডলের আড়তে দামনাসে, কিন্তু কথা হয় না নতুন বউয়ের সঙ্গে, মনের ভেতর শুধুই একটা নাম না জানা পাখি কেমন করে যেন অকারণে ডেকে মরে, হাকিম সবই বুঝতে পারে, কিন্তু এর বেশি সে তো কিছুই বলতে পারে না। মন্ডলের আড়তে বসে মন আর স্থির থাকে না, উদাস হয় ঘরের জন্য, একটা ঘরের স্বপ্ন মানুষ দেখে, সেও তো দেখেছে অথচ সেই ঘরের মানুষটিকে শুধুই এখনো দেখা হলো না। মনকে আবার সান্ত্বনা দেয় বিয়ে একবার যখন হয়েছে পচে বা নষ্ট হয়ে তো যাচ্ছে না, দেখা তো হবেই এতে আর অধর্য্যরে কি আছে! নিজের মনকে অনেকভাবে বোঝায় এবং সান্ত্বনা দেয়, রত্না তো তারই।
বেলা একটু গড়ালে মন্ডল আড়তে ফেরে, ইদানিং মন্ডলকে বেশ হাসিখুশি দেখে, চুলে কলপ দেয় ঘন-ঘন, বয়সটাকে কেমন ভাবে যেন আটকে রেখেছে, সত্যিই কি মন্ডল বাপের বয়স কমে গেছে,সত্যিই কি তাই হয় কখনো, হাকিম অনেক-অনেক কিছু ভাবতে থাকে, তার ভাবনার কোনো কুল কিনারা নেই। আবার রাত্রি আসে রত্নাকে কাছে পেয়েও যেন সে কাছে পায় না, দেখতে সাধ জাগে কিন্তু দেখা যেন আর শেষ হয় না। রত্না ঘুমের কোলে হারিয়ে যায়। এভাবে রাত্রি যায় দিন আসে, তারপর আবার রাত্রি আসে দিন যায়, মন পড়ে থাকে কোন্ সে মহাসিন্ধুর দিকে তাকিয়ে।
উঠতে-বসতে পাড়াপ্রতিবেশী ভাবীরা ঠাট্টা-তামাসা করে, হাকিম মিয়া যে নববধূঁ পেয়ে আমাদের আর পাত্তা দিতে চায় না গো! আরেকজন বলে ওঠে, আহা কি পেয়েছে আমাদের হাকিম্মা, বউ তো যেন ননীর পুতুল… সেদিন মহেষহাটার সুরেশ চৌকিদার বলে ফেললো, বিয়ে করেছো, বউটাকে চোখে চোখে রেখো, হারিয়ে যেন না যায়, আজকাল মানুষের মতিগতি বোঝা বড়ই কঠিন। হাকিম আর কথা বলেনি, কি যে বলে সুরেশ, মানুষ চেনেওয়ালা হয়ে গেছে কদিন চৌকিদারের কাজ পেয়ে, বড় বড় পা ফেলে হেঁটে চলে যায় গন্তব্যে।
মনে-মনে খানিক খিস্তি-খেউড় করে সুরেশকে, দিনদুনিয়া ত্রমশঃ কেমনভাবে যেন পাল্টে যাচ্ছে, মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ভালোবাসা উঠে যাচ্ছে, মন্ডল সাহেব ঠিক কথায় বলে, পৃথিবীতে কে কার রে, একদিন হয়তো তুই হাকিম বলেই বসবি কোনো অন্যয় কথা, কিন্তু সেটা সময় তোকে বলতে হয়তো দেবে না, সুরেশের মতো কতো শত লোক আছে নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ভেউ-ভেউ করে কুত্তার মতো রাস্তার মধ্যে কেঁদেকেটে মরছে, সবই বিশ্বাসের ব্যাপার।
সেদিন আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি নামে, বেশ গর্জন করেই বৃষ্টি আসে, টিনের চাল ছিন্ন করে ফেলে যেন, ঘুম আসতে চায় না, সন্ধ্যা কিছুক্ষণ আগে হয়েছে, বাড়ির মানুষ আর বাইরে যায়নি, রত্না এখনো ঘরে ফেরেনি, বাড়ির সমস্ত কাজ সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে, মন্ডলগিন্নির শরীরে তেলমালিশ করে দেওয়া থেকে মন্ডলের ওজুর পানি দেওয়া, চুলে বিলি কেটে দেওয়া ঘরগেরস্থালী দেখা সবই সে করে ,মুখে কোনো রাগ নেই প্রতিবাদ নেই যেন সে নিজের বাড়ির কাজ নিজেই করছে, এদিকে রাত্রি বাড়ে রাত্রির মতো, বৃষ্টির শব্দে তোলপাড় চারদিক, বিরাম নেই, তামাম রাত্রি বৃষ্টিধারা বইবে, হাকিমের শরীরে কিসের যেন টান ধরে, নিজেকে সে সামলে রাখতে পারে না, একটা পারদ একটা জোঁকের মতো কিছু যেন তার সমস্ত শরীরে উঠে আসে, আজ রাত্রে সে নদী সাঁতরে হারিয়ে যাবে সুদূর কোথাও, মাঝিমাল্লা থাকুক বা নাই থাকুক তাতে কি, নিজের ঘর থেকে বের হয়ে আসে একসময়, চারদিক মিসমিসে অন্ধকারে ছেঁয়ে আছে, কোথাও কোনো মানুষ জেগে আছে কি নেই তা আন্দাজ করা ভারী মুসকিল। ঘরের ভেতরে বসে যা ভেবেছিলো বাইরে এসে দেখে বৃষ্টির তান্ডব প্রচন্ড রকমের, মুহূর্তে বিদ্যুৎ চমকানির সঙ্গে বজ্্রকঠিন শব্দে কাছেপিঠে কোথাও বাঁজ পড়লো, এতো বড় বাড়িতে আজ একটাও জোনাকিপাখি নেই, বৃষ্টির শব্দেই সব কিছুকে গ্রাস করে ফেলেছে, হাকিম ভাবতে থাকে রত্না তাহলে কোথায় কি করছে, মন্ডিলগিন্নিমার ঘরে শুয়ে পড়েছে কি! মনটা একটু কেমন হয়ে যায়।
আকাশ দেখা যায় না,বৃষ্টির ভাড়ে নয়মাসের পোয়াতি যেন, শুধুই কাঁদছে, কতোকাল কাঁদেনি তাই আজ মন ভরে কাঁদবে, হাকিমের মন কিন্তু মানে না, নববিবাহিত স্বামীকে একলা ঘরে ফেলে রেখে কিভাবে ঘুমোতে পারে, সত্যিই একি মেয়ে মানুষ নাকি মেয়ের আড়ালে অন্য কোনো মানবী। আজ তার শরীর মানছে না, সাগরের মতো তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে, অনেকদিন আগে নয়নপুরের যাত্রা দেখতে গিয়ে, নায়িকা বা নর্তকীদের শরীরের ভিন্ন-ভিন্ন ভাঁজ বা সমতল-অসমতল কারুকাজে মূগ্ধ হয়ে যায়, ওমন একটা মেয়েমানুষ যদি তার থাকতো, শরীরে তার কিসের একটা টান পড়েছিলো, সেই টান সে এখন অনুভব করে, রত্নার শরীরখানাও বেশ,টুইটম্বুর রক্তগোলাপ, একটু হাত দিলে রক্ত ঝরে পড়বে, হাকিম আর হাকিমের খোলসে নেই, সে এখন অন্য দ্বীপের মানুষ। বৃষ্টির মধ্যে সে রোয়াক থেকে বিশাল উঠোনে নেমে আসে, কোন্ ঘরে মন্ডলগিন্নি থাকে, কোন্ ঘরে মন্ডলবাপ থাকে, আজ সে দেখবে কোথায় রত্না, এতো রাত্রি অবধি তাকে ফেলে রেখে কোথায় ঘুমোচ্ছে নিশ্চিন্তে, বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে তারপরও মনকে সান্ত্বনা দেয়, রত্নাকে আজ সে কাছে পেতে চায়, মন ভরে দেখবে নিজের বিয়ে করা বউকে, একটা অব্যক্ত কথা বুকের মধ্যে কলকলানি শুরু করে দিয়েছে, শরীরের ভেতর আরেক শক্তি সাপের মতো ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, চোখে ঘুম থাকলেও আজ রাত্রে সে ঘুমোবে না, কারণ রত্নাকে আজ কাছে নিয়ে বুকের গভীরে স্থান দেবে।
বাইরে থেকে বোঝা যায় মন্ডলগিন্নি ঘর অন্ধকার, কিন্তু মন্ডলের ঘরে আলোর বিন্দু-বিন্দু রেখা বাইরে বের হয়ে আসছে, হাকিম এবার বোঝে রত্না হয়তো মন্ডলের ঘরে টেলিভিষণ দেখছে, কিন্তু টেলিভিষণের কোনো শব্দ বের হচ্ছে না ভেবে মন্ডলবাপের ঘরের জানালার ফুটো দিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করতেই হাকিমের চোখ অকস্মাৎ আটকে যায়, নীল আবছা আলোর ভেতর অন্য কিছু যেন সে অনুভব করলো, কিন্তু কি সেটা বুঝতে না পেরে আবার দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে নিস্তব্ধ পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরের ভেতরে সে কি দেখলো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
চোখে লজ্জা এসে বিঁধে গেলো যেন। কি দেখছে সে, মন্ডলের বুকের ওপর রত্না, এতো আনন্দ কেনো ওর কন্ঠে, শরীরের বসণ নেই কারো, আর দেখতে পারে না, দেখতে ইচ্ছে হয় না, একটা যন্ত্রণার পাথর বুকের গভীরে কে যেন বসিয়ে দিলো, এমন কি হয়, এতোদিনের সাজানো স্বপ্নটা কেমন ভেঙে যাবে, তা তো কখনো ভাবেনি, ভাবনাও যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে হারিয়ে যায়। যে বাড়িঘর এতোকাল তার ছিলো, আজ হঠাৎ সব কেমন পর হয়ে গেলো, সে কে, নিজেকে ভূইফোঁড় মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে সে তো এবাড়ির কেউই নয়, একটা খড়কুটো বৈ তো কি, আর রত্না তো এবাড়ির দাসী, চোখের সামনে থেকে একে একে সমস্ত ফুলের পাপড়িগুলো খসে যাচ্ছে, নির্বোধ আকাশ অন্ধকারে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে, কিছুই দেখার অবসর নেই।
Posted ৭:৫৮ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh