বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২১
মহামারি করোনা নিউইয়র্কে প্রায় তিন শত বাংলাদেশীর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। গত বছর মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে নিউইয়র্ক সিটিতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে করোনা ভাইরাস। এপ্রিল এবং মে মাসে মৃত্যুর হার পৌছে যায় শীর্ষে। এসময় প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশীদের মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। চিকিৎসক সহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশা ও বয়সের নারী-পুরুষ মৃত্যুবরণ করেন করোনাক্রান্ত হয়ে। একই পরিবারে একাধিক মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তন্মধ্যে একই পরিবারে দুই ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ শুধু সেসব পরিবার নয় গোটা কমিউনিটিকে করে তুলে শোকাহত। করোনাক্রান্ত হয়ে নিউইয়র্ক সিটিতে দুই পরিবারে চার সহোদর প্রাণ হারিয়েছেন। গত বছর ১৯ এপ্রিল করোনায় মারা যান নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান চৌধুরী। বাংলাদেশী আমেরিকানদের মধ্যে নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগ (ট্রাফিক এনফোর্সমেন্টের) সর্বোচ্চ সেকশন কমান্ডার পদে কর্মরত ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর সাড়ে ৮মাস পরে তার আপন বড় ভাই কৃষিবিদ ওহিদুর রহমান চৌধুরী করোনাক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। গত ৯ জানুয়ারি কুইন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তার ছোট ভাই মুজিবুর রহমান চৌধুরীও একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাদের ছোট ভাই ডাঃ সাইদুর রহমান চৌধুরী এই হাসপাতালে কর্মরত একজন চিকিৎসক। ঢাকা সিটির রাজা বাজারে একই পরিবারে বড় হয়ে উঠা দু’ভায়ের করোনায় মৃত্যুর ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক। এদের মাঝে পারিবারিক বন্ধনও অনেক সুদৃঢ়।
অপরদিকে নিউইয়র্ক সিটিতে বসবাসকারী টাঙ্গাইলের একই পরিবারের দুই ভাই করোনা মহামারিতে প্রাণ হারিয়েছেন। এই পরিবারের ছোট ভাই সাইফুর হায়দার খান আজাদ (৪৭) জ্যামাইকা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান গত বছরের ৪ এপ্রিল। এরপর প্রায় তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ২১ এপ্রিল মাউন্ট সাইনাই হাসপাতালে মারা যান বড় ভাই সফি হায়দার খান (৫৪)। দু’ভাই প্রায় কাছাকাছি সময়ে অভিবাসী হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে দু’ভাই সুখেই বসবাস করছিলেন। তাদের পরিবারের আরো অনেকেই আছেন এই শহরে। করোনায় দুই সহোদরের মৃত্যুতে তাদের পরিবারে নেমে এসেছে বিপর্যয়। কোন কিছু দিয়েই এ ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব নয়। এছাড়া গত মাসে করোনায় দ্বিতীয় ঢেউ ব্রুকলীনে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে কেড়ে নিয়েছে পিতা-পুত্রের জীবন।
ওহিদুর ও মুজিবুর চৌধুরীর মৃত্যু
নিউইয়র্কে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত বাংলাদেশীদের মাঝে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। প্রয়াত বাংলাদেশীদের এ তালিকায় সংযুক্ত হলো আরো একটি নাম-ওহিদুর রহমান চৌধুরী(৭২)। গত ৯ জানুয়ারি শনিবার সকালে সিটির কুইন্স জেনারেল হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। এর আগে সপ্তাহধিককাল ধরে একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। করোনাক্রান্তের পর প্রথমদিকে বাসায়ই ছিলেন ওহিদুর রহমান। শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাকে কুইন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
শারিরীক অবস্থার অবনতি হলে তাকে নেয়া হয় আইসিইউতে। সেখানে ভেন্টিলেশনে থাকাবস্থায় মারা যান ওহিদুর রহমান চৌধুরী। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, একপুত্র, ২ কন্যা সহ বিপুল সংখ্যক আত্মীয়-স্বজন রেখে যান। তার পরিবারের প্রায় সকল সদস্যই আমেরিকা প্রবাসী। তার ছোট ভাই নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান চৌধুরী করোনাক্রান্ত হয়ে গত ১৯ এপ্রিল একই হাসপাতালে মারা যান। প্রায় ৭ মাসের ব্যবধানে সহোদর ওহিদুর রমান চৌধুরীর মৃত্যুতে তাদের গোটা পরিবাওে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই কিডনি রোগে ভুগছিলেন তিনি। এজন্য তার দেহে ডায়ালাইসিস চলছিলো। ফলে করোনা সংক্রমনে তিনি সহজেই গুরুতর অসুস্থ হড়ে পড়েন। ঢাকা শহরের রাজা বাজারে বেড়ে উঠা ওহিদুর রহমান চৌধুরীর গ্রামের বাড়ী কুমিল্লার কসবা উপজেলায়। কৃষিবিদ ওহিদুর রহমান চৌধুরী ১৯৬৬ সালে শেরে বাংলা কৃষি কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭৩ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষে সরকারী চাকুরীতে যোগদান করেন। দীর্ঘদিন তিনি বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি জ্যামাইকা এলাকায় সপরিবারে বসবাস করতেন। গত ১১ জানুয়ারি সোমবার লং আইল্যান্ডের পাইন লন কবরস্থানে নামাজে জানাযা শেষে তাকে দাফন করা হয়। উল্লেখ্য একই কবরস্থানে গত এপ্রিল মাসে তার ছোট ভাই মুজিবুর রহমান চৌধুরীকে দাফন করা হয়। কৃষিবিদ ওহিদুর রহমান চৌধুরীর মৃত্যুতে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন অব আমেরিকার কার্যকরী সভাপতি এম, এ রশীদ ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং মরহুমের পরিবারের প্রতি জানান সমবেদনা ।
মুজিবুর চৌধুরী : নিউইয়র্কে গত মার্চে মারাত্নক আঘাত হানে করোনা ভাইরাস। আর গত এপ্রিল মাসটা ছিলো মৃত্যুর খবরে ঠাসা। প্রতিদিনই পরিচিত জনের মৃত্যু সংবাদ ভাইরাল হয়ে যেতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বাড়িয়ে দিতো শোক, দুঃখ, কাতরতা। উনিশ এপ্রিল রোববার ছিলো এমন একটি দিন। খবর এলো নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের ট্রাফিক এনফোর্সমেন্ট’র সেকশন কমান্ডার মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান চৌধুরী আর নেই। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। মৃত্যুর সপ্তাহখানেক পূর্বে করোনাক্রান্ত অবস্থায় তিনি ভর্তি হন কুইন্স জেনারেল হাসপাতালে। এর আগে বাসায়ই চিকিৎসা নেন। কিন্তু শ্বাসকষ্ট ও জটিলতা বাড়লে স্থানান্তর করা হয় হাসপাতালে। ডায়াবেটিস সহ অন্যান্য কিছু রোগের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি আগে থেকেই। কিন্তু করোনা এতটা কাবু করে ফেলবে এমনটি ভাবতে পারেননি কেউ। আইসিইউতে ভেন্টিলেশনে থাকাবস্থায়ই মারা যান তিনি । নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের উদ্যোগে প্লাজমা থেরাপিও দেয়া হয় তাকে।
বাংলাদেশী আমেরিকানদের মধ্যে নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগ (ট্রাফিক এনফোর্সমেন্ট) এর সর্বোচ্চ সেকশন কমান্ডার পদে কর্মরত ছিলেন মুজিবুর রহমান চৌধুরী। তার মৃত্যু সংবাদে এনওয়াইপিডি ও বাংলাদেশী কম্যুনিটিতে নেমে আসে শোকের ছায়া। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, তিন কন্যা, চার ভাই এবং এক বোন সহ অনেক আত্মীয় স্বজন রেখে গেছেন। মুজিবুর রহমান চৌধুরী ১৯৮২ সালে অভিবাসী হন এদেশে। বর্তমান মির্জাপুর এবং তৎকালীন মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজের পঞ্চম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন মুজিব চৌধুরী। ঢাকার রাজাবাজারে জন্ম ও বেড়ে উঠা মুজিব চৌধুরী পরিবারের আদি নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিউইয়র্ক পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে যোগ দেন ১৯৯০ সালে। প্রথম দিকের একজন বাংলাদেশী ট্রাফিক এজেন্ট তিনি। কর্মস্থলে দায়িত্বশীলতা, কর্তব্যপরায়নতা ও কর্মনিষ্ঠার জন্য এনওয়াইপিডি’র ট্রাফিক এনফোর্সমেন্টের এই পদে আসীন হন তিনি। আর এটা ছিলো বাংলাদেশী কম্যুনিটির জন্য অত্যন্ত গর্বের। দীর্ঘদিন চাকুরীকালে পুলিশ বিভাগ তাকে সম্মানিত করেছে বার কয়েক। প্রদান করেছে সম্মানসূচক পদক।
দুই ভাই সাইফুর ও সফি হায়দার
নিউইয়র্ক (ইউএনএ): করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ছোট ভাইয়ের পর বড় ভাইও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। প্রায় তিন সপ্তাহের ব্যবধানে একই পরিবারের দু’জনের মৃত্যুতে শোকে পাথর হয়ে গেছেন পরিবারের সদস্যরা। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী টাঙ্গাইলবাসীদের সামাজিক সংগঠন টাঙ্গাইল জেলা সমিতি ইউএসএ’র সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক মোহাম্মদ খান রাজেস-এর বড় ভাই সফি হায়দার খান (৫৪) ইন্তেকাল করেন ২১ এপ্রিল । তিনি ৩০ মার্র্চ থেকে ম্যানহাটানের মাউন্টসিনাই হাসপাতালের আইসিসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার ছোট ভাই সাইফুর হায়দার খান আজাদ (৪৭) করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন গত ৪ এপ্রিল জ্যামাইকা হাসপাতালে । সফি হায়দার খান বিগত ২১ দিন ম্যানহাটানের মাউন্টসিনাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানে তার করোনা ভাইরাস পজেটিভ সনাক্ত হওয়ার পর চিকিৎসা চললেও শেষ পর্যন্ত আর রক্ষা হয়নি। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক ছেলে (২১) ও এক মেয়ে (১৩) সহ অরেক আত্নীয়-স্বজন রেখে যান। তিনি দীর্ঘ ১০ বছর ধরে নিউইয়র্কের রীচমন্ড হিলে সপরিবারে বসবাস করছিলেন।
পারিবারিক প্রয়োজনে তিনি দেশে যাওয়ার পর করোনা পরিস্থিতিতে তার নিউইয়র্ক ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ফরে চরম অসুস্থতা এমনকি মৃত্যুর সময়ও স্বামীর পাশে থাকতে পারলেন না স্ত্রী, বাবাকে দেখতে পেলো না আদরের কন্যা। তারা ৫ ভাই ও এক বোন নিউইয়র্কে বসবাস করেন। মৃত্যুবরণকরী তার দুই ভাই নিউইয়র্ক সিটির রিচমন্ডহীলে দুই ফ্যামিলির একই বাসায় বসবাস করতেন। উল্লেখ্য, মোহাম্মদ খান রাজেসরা টাঙ্গাইল শহরের ছয়আনী বাজারের স্থায়ী বাসিন্দা এবং তাদের গ্রামের বাড়ী টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার চকতৈল।
Posted ৭:০৯ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh