নিউইয়র্ক : | বৃহস্পতিবার, ০৭ আগস্ট ২০২৫
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল ইসলামকে (৩৬) শোক-শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় শেষবিদায় জানিয়েছেন হাজারো মানুষ। স্থানীয় সময় নিউইয়র্ক শহরের পার্চেস্টার এলাকায় দিদারুলকে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষবিদায় জানানো হয়। শেষবিদায়ের আনুষ্ঠানিকতায় দিদারুলকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করে নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগ (এনওয়াইপিডি)। তাঁকে মরণোত্তর ‘ডিটেকটিভ ফার্স্ট গ্রেড’ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। দিদারুলের বীরত্বের স্বীকৃতি দিতে, তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা দেখাতে এ আনুষ্ঠানিকতায় যোগ দেন নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের গভর্নর, নিউইয়র্ক সিটির মেয়র, নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের কমিশনারসহ হাজারো কর্মকর্তা। এ আনুষ্ঠানিকতায় হাজারো সাধারণ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। সবাই শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-শোকে অবনতমস্তকে দিদারুলকে শেষবিদায় জানান। অনুষ্ঠানে এনওয়াইপিডির কমিশনার জেসিকা টিশ বলেন, দিদারুল নিজের জীবন দিয়ে অন্যদের রক্ষা করেছেন। তিনি এক নিঃস্বার্থ বীর। জানাজার জন্য দিদারুলের মরদেহ পার্চেস্টার জামে মসজিদে নেওয়া হয়।
তাঁর জানাজায় হাজারো মুসল্লি অংশ নেন। জানাজা শেষে নিউজার্সির টোটোওয়া ইসলামিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। স্থানীয় সময় গত সোমবার নিউইয়র্কের ম্যানহাটানের পার্ক অ্যাভিনিউয়ে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন দিদারুল। পার্ক অ্যাভিনিউয়ের একটি বহুতল ভবনে ঢুকে রাইফেল থেকে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকেন এক তরুণ। তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হামলাকারীকে থামাতে গিয়ে বন্দুকধারীর গুলিতে দিদারুল নিহত হন। দিদারুলের পরিবারকে সহায়তার জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। এই তহবিলে এরই মধ্যে ৬৫ হাজার ডলারের বেশি অর্থ জমা পড়েছে। বাংলাদেশে দিদারুলের গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায়। ২০০৯ সালে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন দিদারুল।
জানাজায় মানুষের ঢল : নিউইয়র্কে বন্দুকধারীর হামলায় নিহত বাংলাদেশি-আমেরিকান পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল ইসলামকে মরণোত্তর পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের পক্ষে বৃহস্পতিবার তার জানাজার পূর্ব মুহূর্তে ডিডেকটিভ (১ম গ্রেড) পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়। দিদারুলের জানাজা বৃহস্পতিবার জোহরের নামাজের পর ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টার জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমামতি করেন বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার ড. জাকির আহমেদ।
জানাজা শেষে নিউ জার্সির লাওরেল গ্রোভ সিমিট্রিতে তাকে দাফন করা হয় । জানাজার সময় নিউ ইয়র্ক মেয়র এরিক এডামস, নিউইয়র্ক স্টেটের গভর্নর ক্যাথি হকুল, সিটি মেয়র এরিক অ্যাডামস, পুলিশ কমিশনার জেসিকা টিশ, সাবেক গভর্নর এন্ড্রু কওমু, ডেমোক্রেটিক পার্টির মেয়র প্রার্থী যোহরান মামদানিসহ সিটি ও ফেডারেল বিভিন্ন অফিসের প্রতিনিধি, পুলিশ ডিপার্টমেন্টের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাসহ বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি ও বিভিন্ন দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। হাজার হাজার পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি দিদারুলকে ফুলেল শ্রদ্ধা ও গার্ড অব অনার দিয়ে শেষবারের মতো বিদায় জানানো হয়। এদিকে জানাজা উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই পার্ক চেস্টার এবং আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে এনওয়াইপিডি।অংশগ্রহণকারীদের সুবিধার্থে বিভিন্ন রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। দুপুরে নামাজের আগেই পার্কচেস্টার মসজিদ প্রাঙ্গণে হাজারো মুসল্লির সমাগম ঘটে। জানাজার পূর্বে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বক্তারা দিদারুলের কর্মজীবনের উপর আলোকপাত করেন এবং তার পরিবারের সদস্যদের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। দিদারুলের পরিবারের যে কোনো প্রয়োজনে পাশে থাকার আশ্বাস দেন সবাই । উল্লেখ্য, সোমবার সন্ধ্যায় সন্দেহভাজন বন্দুকধারী শেন তামুরার হামলায় নিউ ইয়র্ক সিটির ৩৪৫ পার্ক অ্যাভিনিউয়ের একটি বহুতলভবনে পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল ইসলামসহ চারজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হোন।
দিদারুলের বাবার কৃতজ্ঞতা
কথায় আছে কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। কথাটি একেবারে মিলে যায় বাংলাদেশি অ্যামেরিকান এনওয়াইপিডি ডিটেকটিভ অফিসার দিদারুলের বেলায়। বিশ্বের অন্যতম সেরা শহরকে নিরাপদ রাখতে নিজের জীবন উৎস্বর্গ করা দিদারুল যেন এক বীর। তাই সহকর্মী থেকে নগরবাসী, সবাই চোখের জলে বিদায় জানালেও অন্তরে অনন্তকাল থেকে যাবেন বাংলাদেশের কুলাউড়ার সন্তান দিদারুল।
এনওয়াইপিডির তথ্য মতে, নিউ ইয়র্ক সিটিতে বর্তমানে সক্রিয় অফিসার আছেন প্রায় ৩৪ হাজার। যার মধ্যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত প্রায় ১ হাজার। সেখানে গত ১০ বছরে সিটিতে দায়িত্বরত অবস্থায় নানা কারণে খুন হয়েছেন ১২ জন অফিসার। যার মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশি ছিলেন দিদারুল। ২ সন্তান ও অনাগত সন্তান রেখে যাওয়া দিদারুল সেখানে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। অ্যামেরিকার নিরাপত্তার জন্য জীবন বিলিয়ে দিলেন বাংলাদেশের এ কৃতি সন্তান। যা দিদারুলের পিতার শোককে করেছে শক্তি। সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারানো এনওয়াইপিডি ডিটেকটিভ দিদারুল ইসলামকে বীরোচিত সম্মান জানানোর জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানালেন তার বাবা আব্দুর রব।
নিজের একমাত্র ছেলের মুত্যুর খবরে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন দিদারুলের পিতা। কিন্তু বীর সন্তান জন্ম দেয়া আবদুর রব দমে যাবার মানুষ নন। নাতিদের দিদারুলের মত অকুতোভয় হিসেবে বড় করার দায়িত্ব নিচ্ছেন। তবে, সিটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো কঠোর করার পরামর্শ গর্বিত এ পিতার। সেই সঙ্গে পরিবারের এ কঠিন সময়ে শুধু শ্রদ্ধা বা শোক জানানো নয়, আগামীতে এ শহরের জনপ্রতিনিধি থেকে সাধারণ মানুষ সবাইকে সুখে দুঃখে তাদের পাশে পাবেন, এমনটাই প্রত্যাশা করেন তিনি।।
দিদারুল ইসলামের পিতা’র অভিযোগ
বাংলাদেশ দূতাবাস বা কনসুলেট তার খোঁজ খবরও নেয়নি
নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটানের এক বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত বাংলাদেশী পুলিশ অফিসার দিদারুল ইসলাম রতনের পিতা আব্দুর রব আক্ষেপের সাথে বলেন, দিদারুল ইসলাম নিহত হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশ দূতাবাস বা কনসুলেট অফিসের কেউ তার সাথে কোন যোগাযোগ করেনি বা খোঁজ খবরও নেয়নি। মঙ্গলবার ৫ আগষ্ট বিকেলে দিদারুল ইসলামের বাসভবনে বিভিন্ন মিডিয়া-কে সাক্ষাৎ দেয়ার পর টাইম টিভির সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেন, আমি আমার দুই নাতির জন্য সবার কাছে দোয়া চাই। যেন তাদেরকে আমি মানুষ করতে পারি। পাশাপাশি তিনি বলেন, ছেলের জন্য যে সম্মান আমি পেয়েছি, সেজন্য বাবা হিসেবে আমি গর্বিত। এসময় দিদারুল ইসলামের স্ত্রী, দুই পুত্র ও পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, নিউইয়র্কের সিটির মিডটাউন ম্যানহাটানে গত ২৮ জুলাই সোমবার বিকেল সাড়ে ছয়টার দিকে এক বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত এনওয়াইপিডি’র বাংলাদেশী পুলিশ অফিসার মোহাম্মদ দিদারুল ইসলাম রতন (৩৬) সহ ৪জন নিহত হন। ম্যানহাটান শহরের ৫১ ও ৫২ স্ট্রীটের মাঝামাঝি ৩৪৫ পার্ক এভিনিউ এলাকায় একটি বহুতল ভবনে এই ঘটনা ঘটে। নিহত দিদারুল ইসলামের রতন বাড়ী মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া সদর উপজেলাধীর পৌর এলাকার মাগুড়া। গত ৩১ জুলাই বৃহস্পতিবার ব্রঙ্কসের পার্কচেষ্টার জামে মসজিদে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে গভর্ণর ক্যাথি হোকুল, মেয়র অ্যারক অ্যাডামস ও পুলিশ কমিশনার জেসিকা টিশ সহ বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা শ্রদ্ধা জানান। নিউইয়র্কের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই জানাজায় ১৫ হাজার পুলিশ সদস্য সহ ২৫/৩০ হাজার মানুষ অংশ নেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিমত।
Posted ১:৩৭ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৭ আগস্ট ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh