বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ০৭ জানুয়ারি ২০২১
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ব্যাপক হতে শুরু করলে নিউইয়র্ক স্টেটের গভর্নর সরকার পরিচালিত হাসপাতালগুলোর প্রতি নির্দেশ জারি করেছিলেন যে তারা যাতে রোগীদের অপরিশোধিত বিলের কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের না করে। নিউইয়র্কের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর উপর এ আদেশ অনুসরণের কোন বাধ্যবাধকতা না থাকলেও উদ্ভুত পরিস্থিতিতে প্রায় সকল বড় বেসরকারি হাসপাতাল স্বেচ্ছাপ্রনোদিত হয়েই রোগীদের বিল পরিশোধ না করার কারণে তাদের বকেয়া আদায়ের জন্য মামলা করেনি। কিন্তু নিউইয়র্কের বৃহত্তম অলাভজনক চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান ‘নর্থওয়েল’, যার মালিক বা ব্যবস্থাপনা স্টেট গভর্নর এন্ড্রু ক্যুমোর ঘনিষ্ট মিত্র, তারা করোনা-জনিত ব্যাপক বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বিরাজ করা সত্বেও ২০২০ সালে ২,৫০০ এর বেশি রোগীর বিরুদ্ধে তাদের মেডিকেল বিল আদায়ের জন্য মামলা দায়ের করেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্ট অনুযায়ী রোগীদের বিরুদ্ধে নর্থওয়েলের দায়েরকৃত মামলায় প্রত্যেক রোগীর কাছে হাসপাতালের গড় পাওনার পরিমাণ ১,৭০০ ডলার এবং এর সাথে যুক্ত উচ্চ হারের সূদ। সর্বনিম্ন ৭০০ ডলার অপরিশোধিত রয়েছে, এমন রোগীর বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে।
রোগীদের অধিকাংশই স্কুল শিক্ষক, নির্মাণ কর্মী, দোকান কর্মচারি এবং অন্যান্য নিম্ন ও স্বল্প আয়ের লোকজন, যাদের অধিকাংশই করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে কর্মচ্যুত হয়েছে, বা আয় সংকুচিত হয়েছে। সিটির এক হোটেল কর্মী কার্লোস কাস্টিলোর নামে ৪,০৪৩ ডলার বিল পরিশোধ না করা কারণে মামলা হয়েছে। তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলায় তাকে লং আইল্যাণ্ড জুইশ মেডিক্যাল সেন্টারে ভর্তি করা হয়েছিল। তিনি উৎকণ্ঠিত যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার বেতনের চেক নিয়ে নেবে এবং তার পক্ষে বাড়ি ভাড়াও পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। কার্লোস বলেন, ‘মহামারী শুরু হওয়ার পর আমার বেতন অর্ধেক হয়ে গেছে। আমি এখন সপ্তাহে মাত্র দুইদিন কাজ করি এবং এই আয় দিয়েই আমাকে সবকিছু করতে হয়।
রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, সাম্প্রতিককালে সমগ্র দেশে অপরিশোধিত মেডিকেল বিলের কারণে চিকিৎসা গ্রহণকারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার হার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি এবং হেলথ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো কর্তৃক রোগীর উপর অধিক আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দেয়ার কারণে কো-পেমেন্টের নামে রোগীকে চিকিৎসা প্রদানকারীদের জিম্মিতে পরিণত করে ফেলেছে। কিন্তু রোগীদের আর্থিক সামর্থ বৃদ্ধি না পাওয়ায় তাদেরকে অনেক ক্ষেত্রেই মেডিকেল বিল পরিশোধ না করেই দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে যে কোনভাবে বিল পরিশোধ করা সম্ভব হয় কিনা। হাসপাতালের পক্ষ থেকে রোগীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলো খুব কম সময়েই অভিযুক্ত কর্তৃক চ্যালেঞ্জ করা হয় এবং বিচারক হাসপাতালের পক্ষে এবং প্রাপ্য অর্থ আদায়ের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সংশ্লিষ্ট রোগীর বেতন থেকে সরাসরি অর্থ আদায় এবং ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ করার পক্ষে একতরফা রায় প্রদান করেন এবং রায় সম্পর্কে অনেক সময় রোগীর কোনকিছু জানা থাকে না।
পাওনা আদায়ের জন্য রোগীদের বিরুদ্ধে ‘নর্থওয়েল’ যে শুধু একা মামলা দায়ের করেছে তা নয়, মহামারী চলাকালে স্টেট জুড়ে নিউইয়র্কের আরো প্রায় ৫০টি হাসপাতাল গত মার্চ মাস থেকে ৫,০০০ এর বেশি রোগীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। মামলা দায়েরকারী অধিকাংশ হাসপাতালের সামর্থ স্বল্প এবং আপস্টেটে অবস্থিত। এককভাবে ‘নর্থওয়েল’ সর্বাধিক সংখ্যক রোগীর বিরুদ্ধে মামলা করায় এবং হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা স্টেট গভর্নরের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাদের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে বেশি। সিটির অন্যান্য বড় হাসপাতাল, যারা রোগীর বিরুদ্ধে মামলা করা বন্ধ রেখেছিল সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নিউইয়র্ক-প্রেসবাইরেরিয়ান ও নিউই্য়র্ক ইউনিভার্সিটি ল্যাঙ্গোনে হেলথ। এই চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো মহামারী চলাকালে পাওনা আদায়ের জন্য আবারও মামলা করা শুরু করবে কিনা তা স্পষ্ট নয়।
উল্লেখ্য, নর্থওয়েল ব্যবস্থাপনা লং আইল্যান্ড জুইশ মেডিকেল সেন্টার, লেনক্স হিল হসপিটাল ও নর্থ শোর ইউনিভার্সিটি হসপিটালসহ মোট ২৩টি হাসপাতাল পরিচালনা করে। হাসপাতালগুলোর সম্মিলিত আয়ের পরিমাণ সাড়ে ১২ মিলিয়ন ডলার এবং গতবছর (২০২০) ফেডারেল কেয়ারস অ্যাক্টের আওতায় স্টিমুলাস প্যাকেজের মাধ্যমে ১.২ বিলিয়ন ডলার সহায়তা লাভ করেছেন। নর্থওয়েলের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার মাইকেল ডাউলিং একসময় নিউইয়র্ক স্টেটের সাবেক হেলথ ডাইরেক্টর এবং বর্তমান গভর্নর এন্ড্রু ক্যুমোর পিতা সাবেক গভর্নর মারিও ক্যুমোর ডেপুটি সেক্রেটারী ছিলেন। তিনি গত তিন দশকের অধিক সময় যাবত এন্ড্রু ক্যুমোর ঘনিষ্ট বন্ধূ। মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে স্টেটের হাসপাতালগুলোতে করোনা ভাইরাস সংক্রমণজনিত চিকিৎসার ব্যাপারে ডাউলিং গভর্নরের সাথে লিয়াজোঁ বজায় রেখে কাজ করেছেন।
গভর্নরের করোনা সংক্রান্ত নিউজ ব্রিফিংগুলোতেও মাইকেল ডাউলিং উপস্থিত থাকতেন। গভর্নর এন্ড্রুর পক্ষপাতিত্বের কারণেই গত মাসে নর্থওয়েল এ হসপিটাল সিষ্টেমসে স্টেটের প্রথম করোনা ভাইরাস ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। রোগীদের নিকট থেকে পাওনা আদায়ের জন্য মামলা দায়ের করার আগে মাইকেল ডাউলিং তার বন্ধু গভর্নর এন্ড্রু ক্যুমোর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন কিনা জানতে চাইলে নর্থওযেলের মুখপাত্র বারবারা ওসবোর্ন এ সম্পর্কে কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানান। গভর্নরের মুখপাত্রও কোন মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। অবশ্য নর্থওয়েলের চিফ বিজনেস ষ্ট্র্যটেজি অফিসার রিচার্ড মিলার মামলা দায়েরের যৌক্তিকতাকেই তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, পাওনা আদায়ের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের অধিকার নর্থওয়লের রয়েছে। নিম্ন আয়ের রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য নর্থওয়েলের নিজস্ব কর্মসূচি রয়েছে, যা সরকারের চিকিৎসা সহায়তা কর্মসুীচর চেয়েও উদার। তাছাড়া মামলা করা হয়েছে শুধুমাত্র যারা চাকুরিরত রয়েছে সেই রোগীদের নামে, যারা পাওনা পরিশোধ করতে সক্ষম বলে আমরা বিশ্বাস করি। তিনি আরো বলেন, ফেডারেল সরকারের দেয়া স্টিমুলাসের পরও গত বছর নর্থওয়েলের ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ মিলিয়ন ডলার। যে মামলাগুলো করা হয়েছে সবগুলোই করোনা ভাইরাস সংক্রমণের আগে ভর্তি হওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে। কোনো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর নামে মামলা করা হয়নি।
অ্যালবেনি এলাকায় চিকিৎসা সেবা দানে নিয়োজিত সেন্ট পিটার্স হেলথ পার্টনারস তাদের পরিচালিত হাসপাতালগুলোর পক্ষ থেকে প্রায় এক হাজার রোগীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে পাওনা আদায়ের জন্য। সাইরাক্যুজের ওনেডা হেলথ প্রায় ৫০০ রোগীর নামে পাওনা আদায়ের জন্য মামলা করেছে।
এসব মামলার অধিকাংশের দাবীর পরিমাণ ন্যূনতম। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে রোগীর কাছে পাওনার পরিমাণ বেশি থাকে এবং তা দেখা গেছে নর্থওয়েল পরিচালিত লং আইল্যান্ডের জন টি মাদার মেমোরিয়াল হসপিটালের মামলায়, যেখানে জনৈক টমাস ক্যাসপারকে ৩১,৩৪০ ডলার অপরিশোধিত বিলের কারণে মামলা করা হয়েছে, এর সাথে যোগ হয়েছে প্রায় ৮,০০০ ডলার সূদ। এছাড়া স্কট বাকলের নামে ২১,০২৮ ডলার ও প্রায় ৪,০০০ ডলার সূদ আদায়ের জন্য মামলা করা হয়েছে। স্কট বলেন, আমি ভেঙে পড়েছি। আমার নামে কোথাও একটি পেনিও নেই। আমার তিনটি সন্তান। তারা যদি আমার বেতনের চেক নিয়ে নেয় তাহলে আমার আর কিছুই থাকবে না। কমিউনিটি সার্ভিস সোসাইটির এক রিপোর্টে দেখা যায় যে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে নিউইয়র্কের নন-প্রফিট হাসপাতালগুলো অনাদায়ী বিল আদায়ের জন্য রোগীগের বিরুদ্ধে ৪০,০০০ মামলা করেছে। নর্থওয়েল অন্যান্য চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অধিক সংখ্যক মামলা করে থাকে। রিপোর্ট অনুযায়ী ওই সময়ে নর্থওয়েল প্রায় ১৪,০০০ মামলা করেছে, অর্থ্যাৎ বছরে প্রায় ২,৮০০ করে মামলা দায়ের করেছে নর্থওয়েল।
Posted ৬:৫৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৭ জানুয়ারি ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh