বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারি ২০২২
অস্থির সমাজেও স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চায় মানুষ। অপমৃত্যু বরাবরই অপ্রত্যাশিত-অনাকাংখিত। তারপরও নানাবিধ দুর্ঘটনায় ঘটছে অপমৃত্যু। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও অহরহ ঘটছে অপমৃত্যুর ঘটনা। বাংলাদেশী আমেরিকান কমিউনিটি এর বাইরে নয়। তাই এ কমিউনিটিতে অনেক অপমৃত্যু ঘটছে। এসব অপমৃত্যুর ঘটনায় শুধু ভুক্তভোগী পরিবার নয়। কখনো কখনো শোকের ছায়া ছড়িয়ে পড়ে গোটা কমিউনিটিতে। এমনি একটি অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশী অভিবাসী পরিবারে।
গত ৭ জানুয়ারি নিউইয়র্ক সিটির এলমহার্স্টে বড় ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে মৃত্যু হয়েছে আপন ছোট ভাইয়ের। জানা গেছে উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে নয় নিতান্তই দুর্ঘটনাবশত ঘটেছে এমন ঘটনা। যা অত্যন্ত মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক। মায়ের সাথে বখে যাওয়া সন্তান শ্যন সরকারের ঝগড়ার মাঝে জড়িয়ে পড়েন বড় ভাই সালমান সরকার। জানা যায় ঝগড়ার এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত শ্যন সরকার ছুরি হাতে তুলে নেয়। এসময় ধ্বস্তাধস্তি হয় বড় ভাই সালমান সরকারের সাথে। এপর্যায় ছুরি লেগে যায় শ্যন সরকারের গায়ে। ঘরের মেঝেতে বয়ে যায় রক্তের বন্যা। মা ৯১১ এ ফোন দিলে পুলিশ এসে শ্যন সরকারকে নিয়ে যায় স্থানীয় এলমহার্স্ট হাসপাতালে। চিকিৎসকগণ শ্যন সরকারকে মৃত ঘোষণা করেন। অপরদিকে বড় ভাই সালমান সরকারকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পুলিশ। এসময় তাদের পিতা আব্দুস সালাম সরকার ও সর্বকনিষ্ঠ ভাই বাসার বাইরে ছিলেন। খবর পেয়ে তারাও বাসায় ফিরে হতবাক হয়ে যান। ঘটনার পরদিন সকালে এলমহার্স্ট হাসপাতাল থেকে মৃতদেহ পাঠানো পোস্টমর্টেম করার জন্য।
গ্রেফতারকৃত সালমানকে পুলিশ পরদিন প্রথমবারের মত আদালতে হাজির করলেও অভিযোগ দায়ের করতে পারেনি। ফলে আবার তাকে ৯ জানুয়ারি হাজির করা হয় কুইন্স কাউন্টি ক্রিমিনাল কোর্টে। আদালত জামিন মঞ্জুর করেন সালমানের। ঘটনার প্রথম দু’দিন পুলিশ তাদের এলমহার্স্টের বাসা ঘেরাও করে রাখে। সালাম সরকারের পরিবারকে এ দু’দিন কাটাতে হয় অন্যত্র। শ্যন সরকারের মৃতদেহ ১০ জানুয়ারি দাফন করা হয় নিউজার্সির একটি মুসলিম কবরস্থানে। আব্দুস সালামের একজন পারিবারিক বন্ধু ও বড় ছেলে সালমান অংশ নেন দাফনকালে। এসময় চিৎকার করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সালমান।
১৩ জানুয়ারি সালমানকে তার এটর্নি সহ হাজির হতে হবে আদালতে। শ্যন সরকারের মৃত্যুর ঘটনাটি নাটকীয় হলেও সম্প্রতি নিউইয়র্কের বাংলাদেশী কমিউনিটিতে মাদকাশক্তির কারণে অকালে ঝড়ে গেছে অনেকগুলো প্রাণ। অস্বাভাবিক এবং অপমৃত্যুর এসব ঘটনা সাধারণত চেপে যায় তাদের পরিবার। কিন্তু সালাম সরকারের পরিবারে ঘটে যাওয়া বিয়োগান্তুক ঘটনার শুরু হয়েছে দ্বিতীয় অধ্যায়। এ নিয়ে আজ কঠিন জীবন জিজ্ঞাসার সম্মুখীন সালাম সরকার। এক সন্তানকে হারিয়ে এবং অপর সন্তানকে নিয়ে আইন আদালতের সম্মুখীন হয়ে বড় বেশী ক্লান্ত তিনি। সিরাজগঞ্জের শহরতলীতে বেড়ে উঠা আব্দুস সালাম সরকার আশির দশকের মাঝামাঝি আমেরিকা পাড়ি জমান উন্নত জীবন জীবিকার অন্বেষায়। পরবর্তীতে টেলিফোনে বিয়ে করেন বাংলাদেশে। একসময় তার স্ত্রী রুমানা চলে আসেন নিউইয়র্কে। সময়ের ব্যবধানে তিন পুত্র সন্তানের জনক হয়েছেন সালাম সরকার। বড় ছেলে সালমানের বয়স ২৪। ব্যাচেলর শেষ করে সম্প্রতি একটি সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। মেঝো ছেলে প্রয়াত শ্যন সরকারের বয়স হয়েছিলো ২১। ব্রুকলীন টেক হাইস্কুল শেষ করে শ্যন। এরপর আর কলেজে পড়া হয়নি তার। অসৎ সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তারপর যা হবার তাই হয়েছে। সবচেয়ে ছোট ভাই হাইস্কুলে পড়ে।
ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ সালাম সরকার। নিউইয়র্কে হাতে গুনা দু’একজন ছাড়া তার কোন বন্ধু নেই। নিজ জেলা সিরাজগঞ্জের কারো সাথে তার যোগাযোগ আছে এমনটিও জানা যায়নি। ফলে তার এহেন দুর্দিনেও এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি কাউকে। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো দীর্ঘ সময় আমেরিকা থাকার পরও গ্রীনকার্ডের মুখ দেখেননি সালাম-রুমানা পরিবার। ভাগ্য বিধাতাও কখনো ভর করেনি তাদের জীবনে। ফলে কখনো সুখ ও স্বচ্ছলতার মুখ দেখেননি তারা। কোন রকম দিনাতিপাত করে যাচ্ছিলেন। মানুষের জীবনে সব দিন নাকি একরকম যায় না।
কিন্তু তাদের জীবনে কোন পরিবর্তন আসেনি। এজন্য কেউ একজন তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ‘লটো’ খেলতে। যদি কখনো লেগে যায়। অপরিবর্তিত জীবন জীবিকা নিয়েও কোন দুঃখবোধ নেই তার। তিনি নীরবে নিভৃতে থাকতে পছন্দ করেন। এসবই জানিয়েছেন তার একমাত্র ঘনিষ্ঠজন কমিউনিটির বিশিষ্ট সমাজকর্মী। যিনি তার পরিবারের দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়েছেন ছায়ার মতো। এতোসব কিছুর পরও সালাম সরকার আশায় বুক বেঁধেছিলেন তিন সন্তানকে নিয়ে। তারা মানুষ হবে। একদিন হয়তোবা ঘুরবে ভাগ্যের চাকা। তার সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেলো। একদিকে সন্তান হারানোয় পাথর করে দেয়া শোক। অপরদিকে আরেক সন্তানের ব্যয়বহুল আইনি প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথযাত্রী এখন সালাম সরকার।
Posted ৬:৪০ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারি ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh