ডা. ওয়াজেদ খান | বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০
পশ্চিম উপকূলীয় রাজ্য অরিগন, ওয়াশিংটন স্টেট ও ক্যালিফোর্নিয়া জ্বলছে। স্মরণকালের ভয়াবহ দাবানলে দেখা দিয়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ইতোমধ্যেই ভস্মীভূত হয়েছে ৫০ লক্ষাধিক একর এলাকা। দাবানলে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫জনে। ধ্বংস হয়ে গেঠেছ ঘরবাড়ী সম্পদ। অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন অনেকে। এখনও নিখোঁজ রয়েছে অনেক মানুষ। দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে পার্শ্ববতী রাজ্য আইডাহোতে। সেখানেও জ্বলছে ৭০ সহস্রাধিক একর বনভূমি। বিশ্বের ইতিহাসে দাবানলের কারণে এতো বড় বায়ু দূষণের নজির নেই। দূষিত বায়ু ও ঘোলাটে ধোঁয়া শুধু পশ্চিম উপকূলীয় ও মধ্য পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর আকাশ ঢেকে ফেলেনি। হাজার হাজার মাইল দূরের পূর্ব উপকূলীয় শহর নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটন ডিসির আকাশও ঢেকে গেছে। জ্বলন্ত রাজ্যগুলোর জন-জীবন হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত। অনেক বন্দরে বন্ধ হয়ে গেছে বিমান উঠানামা। অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ায় বিঘ্ন ঘটছে যান চলাচলে। হাজার হাজার ফায়ার ফাইটার্স বিরামহীন চেষ্টা করেও নিয়ন্ত্রনে আনতে পারছে না দাবানল। ফলে শুধু পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল নয় গোটা যুক্তরাষ্ট্র এখন মোকাবিলা করছে মারাত্নক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এমনিতে বৈশ্বিক মহামারি করোনায় দেশজুড়ে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় দু’লাখ মানুষ। মহামারির ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব এখনো বিদ্যমান। অপরদিকে মেক্সিকান উপসাগরীও রাজ্যগুলোতে আঘাত হানছে হ্যারিকেন। সামনে জাতীয় নির্বাচন। সবকিছু মিলিয়ে এক ধরণের দুর্যোগপূর্ণ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে দেশটি। দাবানলের কারণে উপকূলীয় এসব রাজ্যে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায় বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। গৃহহীন মানুষ ভোগ করছে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট। দাবানলে সৃষ্ট ধোঁয়া ও বায়ু দূষণের কারণে জলবায়ুতে পরিবর্তন ঘটছে খুব দ্রুত।
দাবানল অতিক্রম করছে লস এঞ্জেলেস পাহাড়। আইডাহোতে দাবানলের বিস্তৃতি ঘটায় ঝুঁকির মুখে পড়েছে উইলসন পর্বতের দশর্নীয় স্থান। টানা একমাস ধরে স্থানীয় উপসাগর এলাকা ঘন কালো ধোঁয়ার আস্তরনে ঢেকে যাওয়ায় বড় ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে বাসিন্দারা। ওরিগন রাজ্য পুলিশ ভ্রাম্যমান মর্গের ব্যবস্থা করেছে মৃতদের জন্য। খোলা হয়েছে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র।কেবল ওরিগনেই অনেক মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। তাদের খুঁজে বের করতে উদ্ধারকর্মীদের নামানো হয়েছে। ওরিগনের জরুরি ব্যবস্থাপনা দফতর (ওইএম) জানিয়েছে, স্থানীয় সময় রবিবার সকাল পর্যন্ত রাজ্যে ৩৪টি বড় আকারের দাবানল সক্রিয় ছিল। এখন পর্যন্ত মৃতদের সিংহভাগই ওরিগনের বাসিন্দা। রাজ্যের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সেখানে আরও প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রবল বাতাসের কারণে দাবানল আরও তীব্রতর হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। হাজার হাজার ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে । আগুনের তীব্রতায় লাখো মানুষ তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। ওরিগনের গর্ভনর কেট ব্রাউন দাবানল অধ্যুষিত এলাকাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ বলে ঘোষণা দেয়ার দাবি জানিয়েছেন প্রেসিডেন্টের প্রতি। ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসম চলমান সমস্যা নিয়ে সাক্ষাত করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে। ক্যালিফোর্নিয়ার বনভূমির ৫৭ শতাংশ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বনভূমির শুষ্কতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে তাপমাত্রা। ফলে প্রতি বছর দাবানলের বিস্তৃতি ঘটছে আশংকাজনক হারে। এদিকে ফায়ার ফাইটাররা গত মঙ্গলবার পর্যন্ত কয়েক ডজন এলাকার আগুন নিয়ন্ত্রণ এনেছে বলে জানা গেছে।
গত আগস্ট মাসে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যাক্রোম্যান্টো শহরের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে ৭ লাখ ৫০হাজার একর বনভূমি ভস¥ীভূত হয়। এছাড়া একই রাজ্যের ফেসনো শহরের উত্তর পূর্বাঞ্চলে ২লাখ একরে ছড়িয়ে পড়া দাবানল যার ১৬ শতাংশ এখনো জ্বলছে। ওরিগন, রাজ্যের সালেম শহরের পূর্বাঞ্চলে দাবানল গ্রাস করেছে ২লাখ একর বনভূমি। এ এলাকার হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে অন্যত্র। ওরিগনের তিন ডজনেরও অধিক এলাকার সাড়ে ৯ লাখ একর বনভূমি জ্বলছে এখনও। দাবানলের কারণে প্রাণহানি ঘটছে পশুপাখির। এতে বিনষ্ট হচ্ছে জীব-বৈচিত্র। পশ্চিম উপকূলীয় তিনটি রাজ্যে দাবানলে ভস্ম হয়ে গেছে অসংখ্য বাড়িঘর ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান।
দাবানল এতোটাই সর্বগ্রাসী আকার ধারণ করেছে যে ক্যালিফোর্নিয়ায় সাড়ে ৫হাজার ফুট উচ্চতার পর্বতেও বিস্তৃতি ঘটেছে। আগুনের লেলিহান শিখা দৃশ্যমান হচ্ছে দূর-দূরান্ত থেকে। ক্যালিফোর্নিয়ায় গতত ১৪ ও ১৫ আগস্ট বিশ্বের সবচেয়ে তাপমাত্রা অনুভূত হয়। তাপমাত্রার এ রেকর্ড ছিলো ২০১৯ সালে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা, দমকা বাতাস ও শুষ্ক আবহাওয়া এবারের দাবানলের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। গত আগস্ট থেকেই জ্বলছে ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন বনভূমি এলাকা। ওরিগনে দাবানলের শুরু গত ২০ আগস্ট থেকে। রাজ্যের ওরভিলের সন্নিকটে ১৩ হাজার একর এলাকা জুড়ে প্রথম শুরু হয় দাবানল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্যালিফোর্নিয়াতে সর্বাধিক ও ব্যাপক দাবানলের ঘটনা ঘটলেও আলাস্কা এবং আইডাহোতে বড় ধরণের দাবানলের ইতিহাস রয়েছে। দাবানলের ৮৫ শতাংশ ঘটনার জন্য দায়ী মানুষ। এছাড়া প্রাকৃতিক কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে দাবানল । এদিকে পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টির আভাস পাওয়ার কারণে জনজীবন কিছুটা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। ওরিগনের দাবানল উপদ্রুত এলাকায় এখনো ৩০থেকে ৪০ মাইল বেগে বাতাস বইছে। তবে ক্যালিফোর্নিয়ায় এখনো বৃষ্টির কোন সম্ভাবনা দেখছে না আবহাওয়াবিদরা। এমনিতেই করোনা ভাইরাস আতঙ্ক। তারমধ্যে দূষিত বায়ুর কারণে অনেকেই অসুস্থ পড়ছেন। বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট সহ অন্যান্য রোগে।
ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন সতর্ক করে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করার জন্য তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করেন। অন্যদিকে দাবানলের কারণ হিসেবে দুর্বল বন ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন ট্রাম্প। আামেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক দাবানল সংঘটিত হয় ১৮৭১ সালে উইসকনসিন রাজ্যের পেশটিগুতে। এই দাবানলের ঘটনায় প্রাণ হারায় ১ হাজার ২’শ মানুষ। ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রায় প্রতিবছরই দাবানলের ঘটনা ঘটে। তবে ২০১৮ সালে বাটি কাউন্টিতে ক্যাম্প ফায়ারে সবচেয়ে বেশি সম্পদ ধ্বংস হয়। এই দাবানলে ১৮ হাজারের বেশি স্থাপনা ভস্মীভূত হয়। যার সিংহভাগই ছিলো বসতবাড়ি। রাজ্যটির দাবানলের ইতিহাস এটাই ছিলো সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনা।
Posted ৭:১৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh