মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪ | ৫ চৈত্র ১৪৩০

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

আমার বন্ধু মাওলানা তাহেরের জীবনাবসান

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু   |   শুক্রবার, ০৭ আগস্ট ২০২০

আমার বন্ধু মাওলানা তাহেরের জীবনাবসান

তাহের ভাই আর আমাদের মাঝে নেই। গত ৯ মে, ২০২০ তারিখে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক এতো নিবিড় ছিল যে শিক্ষা জীবনের সাতটি বছর এক সাথে কাটিয়ে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরও কখনো মনে হয়নি আমাদের মাঝে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। এই যে তিনি গত প্রায় তিন মাস যাবত অস্তিত্বের জগৎ থেকে হারিয়ে গেছেন, তবুও আমার মনে হয় না তিনি নেই। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকায় তাঁর সংক্ষিপ্ত অবস্থানের পর তিনি তো দূরেই ছিলেন, কিন্তু সবসময় আমার বোধে ছিলেন। এখন পৃথিবী ছেড়ে গেছেন, কিন্তু একইভাবে আমার বোধে আছেন। যিশুকে কবরস্থ করতে আসা লোকজন তাঁর দেহ খুঁজে পায়নি এবং ফেরেশতার মাধ্যমে ঐশী আওয়াজ এসেছে, “মৃতের মাঝে জীবিতকে খুঁজছো কেন? তিনি তো এখানে নেই। তাঁকে ওঠিয়ে নেয়া হয়েছে।” সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে মৃত্যুর পর দেহ বিলীন হয়ে গেলেও যেহেতু ‘রুহ’ বা আত্মার মৃত্যু নেই, অতএব আমার আপন ও ঘনিষ্ট যারা জড়জগৎ থেকে হারিয়ে গেছেন, তারা আমার সাথেই আছেন। আমার কাছে তাদের মৃত্যু নেই। তাহের ভাই আমার আপনজন ছিলেন।


মৃত্যু নিয়ে রসিকতা করতে আমার সবসময় ভালো লাগে। সেই রসিকতা তাহের ভাইয়ের সাথেও করতাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাঁর দলীয় কাজের সময়টুকু ছাড়া আমরা একজনকে ছাড়া আরেকজন কোথাও যেতামই না। কোনো পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানেও আমাদের একসাথে যেতে হতো। পরিচিত জনেরা তাঁকে একা দেখলে আমার কথা জানতে চাইতো, আমাকে একা দেখলে তাঁর কথা জানতে চাইতো। তাঁকে বলতাম, “আমার আগে আপনি মারা গেলে শোকসভার আয়োজন করা হবে এবং আয়োজকরা অবশ্যই বক্তা হিসেবে আমাকে ডাকবে। তখন আমার বক্তব্যে আমি বলবো, উনার অনেক যোগ্যতা ও গুণের কথা আপনারা জানেন। কিছু বিষয় আমি ছাড়া কেউ জানেন না যে, গান গাইতে পারতেন এবং ধুমপান করতেন।” কে কীভাবে আমার এই রসিকতাটুকু নেন তা আমি জানি না। আমার আরো দু’জন খ্যাতিমান বন্ধু আছেন। একজন জাতিসংঘের পদস্থ কর্মকর্তা, অপরজন একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর পদে আসীন ছিলেন। দু’জনই তাদের ঘনিষ্টদের স্মৃতি ও কর্মজীবনের মূল্যায়নের ওপর স্মরণিকা প্রকাশের আগ্রহ ব্যক্ত করেন। আমাকেও অনুরূপ লেখা দিতে বলেন। আমি দু’জনকেই বলি, “আগে মরেন। তাহলে ভালো লিখতে পারবো।

জীবিত মানুষের ওপর আমার লেখা ভালো হবে না।” আমার স্কুল ও কলেজ জীবনের সহপাঠি আবদুল ওয়াহাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় আমার দুই বছর পর। তাঁর স্ত্রী বিদ্যুৎ একই বছরে ভর্তি হয়। ওয়াহাব সমাজ কল্যাণে, বিদ্যুৎ বাংলায় । ওরা ক্যাম্পাসেই এক বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারির বাসায় একটি রুম ভাড়া নিয়ে থাকতো। আমি মাঝে মাঝে ওদের কাছে যেতাম। এসময়ে আমি একটি মুভি দেখি। অমিতাভ বচ্চন ও রাজেশ খান্না অভিনীত ‘আনন্দ’। রাজেশ খান্না ক্যান্সার রোগী। অমিতাভ একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ তাঁর চিকিৎসক। রাজেশ খান্না কতদিন পর্যন্ত বাঁচতে পারেন তাও তাঁেকে জানিয়ে দেয়া হয়। এই সময়টিকে তিনি অর্থবহ করতে হাসিখুশির মধ্যে কাটান, নিজে প্রফুল্ল থাকেন এবং অন্যকে প্রফুল্ল রাখেন। জীবন ও মৃত্যু যে ওপরওয়ালার হাতে, অন্য কারো হাতে নয় এবং আমরা সবাই পৃথিবীর এই রঙ্গমঞ্চে কাঠের পুতুল, এই বিশ্বাসকে রাজেশ খান্না তুলে ধরেন তাঁর অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। মুভিটি দেখার পর থেকে আমার মৃত্যু ভয় চলে যায়। আমি কথাটি বহুবার বহুভাবে ওয়াহাব ও ওর স্ত্রীকে বলেছি। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করার পর ওয়াহাবের সাথে দেখাসাক্ষাত কম হতো। তবে বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে খোঁজখবর জানতে পারতাম। আমার বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) কর্মরত থাকা অবস্থায় ২০০৬ সালে একদিন রাতে ওয়াহাব দেখা করতে অফিসে আসে। সাথে ওর স্ত্রীসহ আরো কয়েকজন। ওয়াহাব রসিকতা ছাড়া কথা বলে না। কিন্তু সেদিন সে কিছু বলছিল না। ওয়াহাবের স্ত্রী যা বলে তার অর্থ ছিল ওয়াহাবের ক্যান্সার হয়েছে। আমি ওকে ‘আনন্দ’ মুভির কথা স্মরণ করিয়ে দেই। হাসিখুশি থাকতে বলি, মাথা থেকে বের করে দিতে বলি মৃত্যু চিন্তা। মুভিটি দেখে থাকলে আবার দেখতে বলি। ওকে কিশোর কুমারের গাওয়া একটি গানের কথাও বলি, “মওত ্আনি হায় আয়েগি একদিন/জান জানি হ্যায় জায়েগি একদিন/ অ্যয়সি বাতোঁ সে ক্যায়া ঘাবড়ানা/ইহাঁ কাল ক্যায়া হো কিসনে জানা।” বুঝতে পারি আমার কথার কোনো প্রভাব তার মধ্যে পড়ে না। কয়েকদিন পর ওয়াহাব মারা যায়। ক্যান্সারের চিকিৎসা করতে নিউইয়র্কে দীর্ঘদিন ছিলেন সাবেক মন্ত্রী ও ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। কথায় কথায় তাঁকেও একদিন প্রশ্ন করি, মৃত্যুকে কী খুব ভয় করেন? তিনি উত্তর দেন, “মানুষ তো, ভয় কিছুটা হয়ই।” আমি তাকেও ‘আনন্দ’ মুভিটি দেখতে বলি। তাঁর মৃত্যু ভয় কেটেছিল কিনা জানি না। তবে মৃত্যুশয্যায় তিনি আমাকে স্মরণ করেন এবং তাঁর মৃত্যুর দু’দিন আগে হাসপাতালে তাঁকে দেখতে গেলে তিনি স্মিত হাসেন। আমি তাঁর হাত ধরে চিন্তা করতে মানা করি। দেশে থাকলে হয়তো তাহের ভাইকেও এমন কথাই বলতাম।


তাহের ভাই আ আমার বয়োজ্যষ্ঠ কেউ নন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠি, এসএম হলে আমার রুমমেট, ঘনিষ্ট বন্ধু। এখনকার সহপাঠিরা যেমন “তুই” ছাড়া পরস্পরকে সম্বোধনই করে না। আমরা কখনো তা করিনি। কারো সাথেই না। আমরা পরস্পরকে ‘ভাই’ এবং ‘আপনি’ সম্বোধন করতাম। “তুমি” বলার কিছু সহপাঠি আছে। “তুই” একটাও নেই। তাহের ভাইয়ের মারা যাওয়ার খবরে সীমাহীন কষ্ট অনুভব করছি। দীর্ঘ দিন থেকেই তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। ২০০৯ সালে এমনি এক রমজান মাসে তিনি ফোন করে আমাকে তার সাথে ইফতার করতে বলেন। গিয়ে তাঁকে শয্যাশায়ী অবস্থায় পাই। তিনি রোজা রাখতে পারতেন না। সেই শেষ দেখা। উচ্চ ডায়াবেটিস তাঁর প্রাণশক্তি কেড়ে নিয়েছিল। আমাদের অনেক স্মৃতি। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই তার সাথে পরিচয়। দু’জনই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। মোহাম্মদপুরের একটি মেসে আরো কয়েকজন ছাত্রের সাথে থাকতাম। তাদের মধ্যে আমরা দু’জনই এইচএসসি পরীক্ষার্থী। আমাদের সব বই ছিল না। একাধিক দিন এমন হয়েছে মোহাম্মদপুর থেকে পায়ে হেঁটে বাংলাবাজার গিয়ে পুরোনা বই কিনে আবার হেঁটে মোহাম্মদপুর এসেছি। বই কিনে আমি বাড়ি চলে আসি। পরীক্ষার সময় ঢাকায় এসে পরীক্ষা দেই। ফলাফল ঘোষণার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। এরপর আবার আমাদের দেখা হয়। তাহের ভাইও রাষ্ট্র রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছেন এবং এস এম হলে এচাচড হয়েছেন। আমারও একই বিভাগ এবং একই হল। হলে সিট বরাদ্দ হওয়ার আগে আমরা দু’একজন সিনিয়র ভাইকে বলেছিলাম তারা যাতে আমাদের একই রুমে সিট বরাদ্দ করার ব্যবস্থা করে দেন। তাই হয়েছিল। এসএম হলের ওয়েষ্ট হাউজের নিচতলায় ১৪৯ নম্বর রুম বরাদ্দ হয় আমাদের। চার সিটের রুমে চট্টগ্রামের নাসির আহমেদ (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী) ম্যানেজমেন্টের ছাত্র এবং বরিশালের সৈয়দ আবদুল্লাহ শহীদ আইনের ছাত্র (জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে অবসর নিয়েছেন)। আমরা সবাই একই ব্যাচের। অনার্স পরীক্ষার এক বছর আগে তাহের ভাই ও আমার জন্য দোতলায় দুই সিটের ১৫২ নম্বর রুম বরাদ্দ হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ সময় পর্যন্ত আমরা ওই রুমেই ছিলাম। অবশ্য শেষ দিকে তাঁর সাংগঠনিক দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ায় তিনি হলে থাকতেন না। এক রুমে আমরা দু’জন একে অন্যকে আরো বেশি জানতে পেরেছি। লাঞ্চের পর ক্লাস না থাকলে রুমে এসে তিনি প্রায়ই গান গাইতেন, “হাম দর্দ কা আফসানা দুনিয়া কো সুনা দেঙ্গে —,” অথবা ‘ইক দিলকে টুকরে হাজার হুয়ে, কোঈ ইঁহা গিরা কোঈ উহা গিরা –।” কখনো তিলাওয়াত করতেন, “ফাবি আইয়ে আলায়ি রাব্বি কুমা তুকাজ্জিবান!” তাঁর তিলাওয়াত শুনে শুনে ‘আর-রাহমান’ সুরা আমার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। আমিও অনেক সময় আবৃত্তি করতাম। মাইকেল মধুসূদনে মেঘনাদ বধ কাব্যের মুখস্থ করা কয়েকশ’ লাইন:

“কি কহিলি বাসন্তি? পর্বত-গৃহ ছাড়ি/ বাহিরায় যাবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে/কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি——” আমরা একে অন্যের শ্রোতা। আমরা একে অন্যের প্রশংসা করি।


১৯৭৭ সালের শুরু থেকেই আমি সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম। বিভিন্ন প্রোগ্রামে যেতে হয়। সাংবাদিক সম্মেলন হলে কিছু গিফটও পাওয়া যায়, যার মধ্যে প্রায়ই সিগারেটের প্যাকেট থাকে। আমি ধুমপান করি না। সিগারেটের প্যাকেট টেবিলে রাখি। অনেক বন্ধু ধুমপান করে তারা এসে সিগারেট নিয়ে যায়। রুমে বসেও টানে। একদিন তাহের ভাই আমাকে অবাক করে দিয়ে একটি সিগারেট নেন। ১৪৯ নম্বরে থাকতে কখনো নেননি। তখন আমার আনা সিগারেট নিতেন রুমমেট নাসির ভাই। তিনি সিগারেট খান না। নিয়ে স্যুটকেসে রাখেন এবং বলেন যে তার আম্মা সিগারেট খান। একথা বলতে তাঁর রাখঢাক ছিল না। আমি চট্টগ্রামে তাঁদের বাসায় বেশ ক’দিন ছিলাম তখন খালাম্মাকে সবার সামনেই ধুমপান করতে দেখেছি। আমার সিগারেটের সরবরাহ দেখে তাহের ভাই একটি লাইটার কিনেছিলেন। তিনি আমাকে ধুমপানের অভ্যাসের সূচনা সম্পর্কে বলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা- সাবসিডিয়ারি, অনার্স ও মাষ্টার্স আমরা পাশাপাশি আসনে বসে দিয়েছি। আমাদের ক্লাসে দুটি সেকশন ছিল। কোনো একটি পেপারে আমরা দুই সেকশনে ছিটকে পড়েছিলাম। তাহের ভাইয়ের সেকশনে শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক শামসুল হুদা হারুন, আমার সেকশনের শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক নাজমা চৌধুরী। আমি তাহের ভাইয়ের সেকশনে ক্লাস করেছি। এতে বেশ ঝামেলাও হয়েছিল। নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্লাসে হাজির না থাকলে পরীক্ষার হলে বসার জন্য ক্লিয়ারেন্স দেয়া হবে না বলে কড়া নোটিশ সার্ভ করার পর আমি বাধ্য হয়ে নাজমা চৌধুরীর ক্লাসে গেলাম। রোল কল করার সময় আমি ওঠে দাঁড়ালে নাজমা চৌধুরী আমার দিকে তাকালেন। উনি আগে কখনো আমাকে দেখেননি। হাজিরা খাতায় আমি বরাবর অনুপস্থিত। কারণ জানতে চাইলে আমি তাঁকে বললাম যে, আমি শামসুল হুদা স্যারের ক্লাস করছি। তিনি ক্ষুব্ধ হলেন। হঠাৎ করে তার ক্লাসে আসার কারণ জানতে চাইলে হাজিরার কড়াকড়ি করার কারণেই যে আমি তাঁর ক্লাসে এসেছি সে কথা বললাম। তিনি হয়তো মনক্ষুন্ন হয়েছিলেন। আমাকে বলেন যে তাঁর ক্লাস যেহেতু আমার ভালো লাগে না, অতএব তাঁর ক্লাসে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন আমার নেই। আমার ক্লিয়ারেন্স দিয়ে দেবেন। একথা বলে তিনি আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দেন। আমি তাহের ভাইয়ের সাথে তাঁর সেকশনেই ক্লাস করতে থাকি। নাজমা চৌধুরী আমাকে আটকে দেননি। অধ্যাপক শামসুল হুদা হারুনের সাথে তাহের ভাইয়ের অম্লমধুর সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। হুদা স্যার একদিন ক্লাসে বলছিলেন যে মুসলমানরা তরবারির জোরে বিভিন্ন দেশ দখল করেছে এবং দখল করা দেশের জনগোষ্ঠীকে জবরদস্তি করে ইসলামে দীক্ষিত করেছে। মুসলমানরা বিভিন্ন যুদ্ধে কত অমুসলিমকে হত্যা করেছে তার একটি সংখ্যাও তিনি উল্লেখ করেন। তাহের ভাই আমাকে বলেন, এর প্রতিবাদ হওয়া দরকার। আমিও বলি, যদি জানা থাকে তাহলে দাঁড়ান। তিনি ওঠে দাঁড়ান এবং স্যারের অনুমতি নিয়ে চার খলিফা, উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগে মুসলমানদের সাথে অমুসলিমদের যুদ্ধে নিহতদের একটি সংখ্যা উল্লেখ করেন বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থের রেফারেন্স দিয়ে। ক্লাসে সবাই মুগ্ধ হয়ে শোনে এবং হুদা স্যারের বিব্রতভাবে দেখে খুশি হয়। এ ঘটনার পর স্যার ক্লাসে এসেই খোঁজ নিতেন, “হোয়ার ইজ তাহের?” কোনো এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিতে একবার তাহের ভাই মালয়েশিয়ায় যান। হুদা স্যার তাঁকে ক্লাসে না পেয়ে জানতে চান তাহের কোথায়। সামনের দিক থেকে কেউ বলে যে উনি মালয়েশিয়া গেছেন। তাহের ভাই ফিরে আসার পর স্যার তাহের ভাইয়ের কাছে সফর অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে সেদিনের ক্লাস তাহের ভাইয়ের বক্তব্য দিয়েই শেষ হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ব্যাচগুলোর মধ্যে আমাদের ব্যাচই প্রথম নিয়মিত ব্যাচ ছিল। আগে থেকেই সেশন জট বেঁধে ছিল। সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের শিক্ষাবর্ষ ১৯৭৩-৭৪ হলেও আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছিল ১৯৭৪ এর সেপ্টেম্বরে। মাষ্টার্স পরীক্ষা হয় ১৯৮০ সালে। প্রায় সাতটি বছর আমরা একত্রে কাটিয়েছি। এক সাথে ঘুম থেকে উঠা, নাশতা করা, ক্লাসে যাওয়া, দুপুরে খাওয়া, নামাজ পড়া, ঘুমানো- সব এক সাথে। তাহের ভাইকে খুব একটা পড়াশোনা করতে দেখিনি। কিন্তু তাঁর স্মৃতি শক্তি ছিল অসাধারণ।

এখনো দেখতে পাই তাহের ভাই ও আমি হাত ধরাধরি করে সোনারগাঁও হোটেলের মোড় থেকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের (বর্তমান ঢাকা শেরাটন হোটেল) দিকে দৌড়াচ্ছি রাস্তার মাঝের ডিভাইডার দিয়ে। হাত ধরে দৌড়ানোর কারণ, যাতে বিপুল জনস্রোতে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ি। ঘটনাটি ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের। মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী ঢাকায় আসছেন। আমরা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছি তাঁকে দেখতে ঢাকা এয়ারপাের্টে যাবো (পুরনো তেজগাঁও এয়ারপোর্ট)। কিন্তু শাহবাগ মোড়ে পৌঁছে দেখি রাস্তা লোকে লোকারন্য। সবাই এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছে। আমরাও জনস্রোতে মিশে গেলাম। কোনোমতে বর্তমান সোনারগাঁও হোটেলের মোড় (তখনো সোনারগাঁও হোটেল নির্মিত হয়নি) পর্যন্ত গেলাম। আর এগুনো সম্ভব নয়। কোনোমতে ডিভাইডারে ওঠে দাঁড়ালাম। মোহাম্মদ আলীকে বহনকারী গাড়ি ভিড় ঠেলে আসছে। জানালা দিয়ে মোহাম্মদ আলীকে দেখা গেল। আমরা উচ্ছসিত। গাড়ি আমাদের অতিক্রম করা মাত্র আমরাও ছুটছি ডিভাইডার ধরে। গাড়িটি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ঢুকে গেলে আমরা গতি মন্থর করলাম। তখনই খেয়াল হলো আমাদের পরনের পাঞ্জাবি ডিভাইডারের গাছের পাতার সংস্পর্শে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। এ অবস্থায় হলে যাই কি করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের অজুখানায় গিয়ে পাঞ্জাবি ধুয়ে আধা শুকানো হওয়া পর্যন্ত গেঞ্জি গায়ে সেখানে দীর্ঘক্ষণ কাটাতে হলো।

এরও আগে ১৯৭৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে রমজানের ছুটির শেষ দিকে চট্টগ্রাম বেড়াতে গেলাম। আমাদের এক রুমমেট ছিলেন চট্টগ্রামের নাসির আহমেদ। তার চন্দননগরের বাসায় এক সপ্তাহ কাটিয়ে ঈদের পরদিন তাহের ভাইয়ের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। সেদিন বাতাসের সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। তাহের ভাই পথের বর্ণনা দিয়েছিলেন। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় সাম্পানে কর্ণফুলী পার হওয়া কঠিন ছিল। সবাই দোয়া-দরুদ জপছিল। আনোয়ারা পর্যন্ত রাস্তা পুরোটাই কাঁচা। বৃষ্টিতে কাঁদা হয়ে গেছে। লোকজন বললো, বৃষ্টি না থাকলে হয়তো রিকশা পাওয়া যেত। বৃষ্টি মাথায় হেঁটে পুরো পথ অতিক্রম করলাম। পথ বলতে ভেড়ি বাঁধ। দু’পাশে বাবলা বন। কোথাও একটা বাড়ি বা ছাপড়া দোকান পর্যন্ত ছিল না যে বৃষ্টি থামা পর্যন্ত দাঁড়াতে পারবো। তাহের ভাই একটি বাজারের কথা বলেছিলেন, যে বাজারে পৌঁছে তাঁর বাড়ির কথা বললে লোকজন দেখিয়ে দেবে। বাজারের নাম এতোদিনে মনে নেই। দু’একজনকে বলার পরই একজন আমাকে সাথে নিয়ে তাঁর বাড়ি পৌছে দিলেন। তাহের ভাই বাড়িতেই ছিলেন। আমরা আলিঙ্গনবদ্ধ হলাম।

আমি যে যাব তিনি ধারণাই করতে পারেননি। ততোক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। জামা খুলে শরীর থেকে কাদামাটি ধুয়ে খেয়ে বিশ্রাম নেওয়ার পর তাহের ভাই আমাকে বাজারে নিয়ে এলেন। লোকজন তাকে দারুন সমীহ করে। সব বয়সের মানুষ তাঁকে ঘিরে ধরেছে। তিনি সবার সাথে কথা বলছেন। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। আছর নামাজের সময় হলো। বাজারের পাশেই মসজিদ, সামনে পুকুর। যারা নামাজ পড়তে এসেছে তারা প্রায় প্রত্যেকেই বিড়ি টানছিল। যাদের বিড়ি শেষ হয়ে এসেছে জোরে কয়েকটি টান দিয়ে বিড়ির গোড়া একদিকে ছুঁড়ে দিয়ে অজু করে মসজিদে ঢুকে গেল। আর যারা একটু আগেই বিড়ি ধরিয়েছে তারা বিড়ি নিভিয়ে কানে গুজে অজু করে মসজিদে প্রবেশ করলো। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে অনেকে কানে গুঁজে রাখা বিড়ি বের করে ধরালো। অন্যেরা নতুন বিড়ি ধরালো। আমি হতবাক হয়েছিলাম।

কর্ণফুলী পার হওয়ার সময় এবং সেখান থেকে ভেড়ি বাঁধের ওপর দিয়ে আসার সময় যতোটুকু সাগর চোখে পড়ে ওইটুকুই প্রথম সাগর দর্শন। মসজিদ থেকে তাহের ভাই বাড়ি হয়ে পশ্চিম দিকে নিয়ে চললেন। এবার অবারিত সাগর। একটি লাইট হাউজ ছিল। আমরা লাইট হাউজের চূড়ায় উঠলাম। দূরে বহি:নোঙরে কিছু জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। লাইট হাউজ থেকে নেমে ভেড়ি বাঁধের সবুজ ঘাসের গালিচায় নামাজ পড়ে আমরা বাড়ি ফিরলাম। বাইরের ঘরে চৌকির মতো মাটির ঢিবি বিছানা। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা কথা বললাম। সাগরের অবিশ্রাম গর্জনে সারারাত ঘুম আসেনি। পরদিন তাহের ভাইয়ের সাথে আশপাশের এলাকা, বাজার ঘুরে সন্ধ্যায় আবার ভেড়ি বাঁধ, লাইট হাউজ। দু’জন অনেক রাত পর্যন্ত সাগরের গর্জন শুনে ফিরে এলাম। পরদিন দুপুরে খাওয়ার পর তাহের ভাই বাজার পর্যন্ত এসে আমাকে বিদায় দিলেন।

তিনি রাজনীতি বেছে নিয়েছিলেন, আমি সাংবাদিকতা। ১৯৮০ সালে তাহের ভাই ডাকসু নির্বাচনে সহ-সভাপতি পদে নির্বাচন করেন। আমি তাঁকে বলেছিলাম, নির্বাচনে প্রার্থী না হলে কী হতো না। কিন্তু কী করার ছিল তাঁর! সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত হলে তাঁকে মেনে নিতেই হবে। আমি যে ভোট দিতে যাবো না সেজন্য যাতে তিনি কিছু মনে না করেন সেকথাও তাঁকে বলেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরই তিনি বিয়ে করেন। যাকে বিয়ে করেন তাঁকে জানতাম। ফজিলা বেগম মিতুু। একই বাড়ির পাশাপাশি থাকতাম আমরা। হিজাব পরতেন বলে কখনো তাঁর মুখ দেখিনি। তাহের ভাইয়ের সাথে যেহেতু আমার খোলামেলা সম্পর্ক ছিল, তিনি আমার কাছে জানতে চান যে আমি মিতু আপাকে দেখেছি কিনা। তাঁকে বলি, আমি দেখিনি। তিনি আমাকে বলেন কোনোভাবে দেখে তাঁকে জানাতে। আমি বিয়ে করবো না বলে আমার মোটামুটি একটা সিদ্ধান্ত ছিল। সেজন্য কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বা পাড়ায় কখনো কোনো মেয়েকে মনোযোগ দিয়ে দেখার তাগিদ অনুভব করিনি। তাহের ভাই বলায় আমি একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাই। পাপ-পূন্য নিয়ে আমার তেমন মাথা ব্যথা ছিল না। কিন্তু লুকিয়ে দেখাটা যদি মিতু আপা টের পান তাহলে আমার স্বভাব চরিত্র নিয়ে বাজে ধারণা পোষণ করবেন, যা আমার কাম্য নয়। তবুও আমি নানা কৌশলে দেখার চেষ্টা করি। স্বচ্ছ চিত্র আঁকার মতো না হলেও মোটামুটি একটা ধারণা দেয়ার মতো দেখে ফেলি। মিতু আপাকে দেখার চেষ্টার এই সময়ে একদিন কোনো এক ব্যক্তিকে রিসিভ করার জন্য তাহের ভাই এয়ারপোর্টে যান এবং আমাকে সাথে নেন। পথে আমার কাছে মিতু আপার চেহারা সম্পর্কে জানতে চান। আমি যথাসম্ভব বলি। এয়ারপোর্টে পৌঁছে তিনি অনেকটা কিশোরসুলভ কৌতুহলে বিভিন্ন মেয়েকে দেখিয়ে মিতু আপা দেখতে কোন মেয়ের মতো তা দেখাতে বলেন।

আমি নানাভাবে বর্ণনা করে তাঁর কৌতুহল মেটাতে চেষ্টা করি। যাহোক, বিয়ে হয়ে যায়। আমার জরুরী কাজ থাকায় বিয়েতে উপস্থিত হতে পারিনি। পরে ঢাকা জিলা ক্রীড়া সমিতি মিলনায়তনে বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়, আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। তাহের ভাইকে বলি, মিতু আপাকে লুকিয়ে দেখার কারণে অপরাধবোধে ভুগছি। তিনি হেসে বলেন, তওবা করলেই হবে। আমি বলি, অন্যায় তো আমার ছিল না, আমি কেন তওবা করবো? তিনি বলেন, দু’জন একসাথেই তওবা করবো এবং এর পর যখন দেখা হয়, আমরা তওবা করি। এভাবে দেখার ঘটনাটি তিনি মিতু আপাকেও বলেছেন এবং মিতু আপা যে টের পেয়েছেন তা তিনি তাহের ভাইকে বলেছেন। আমি অত্যন্ত লজ্জা বোধ করেছি। চট্টগ্রামে চলে যাওয়ার আগে ঢাকায় তাহের ভাইয়ের বাসায় গেলেই বার বার ঘটনাটি মনে পড়তো। কিন্তু বিব্রত হতাম না বা লজ্জাবোধ করতাম না। কারণ আমি তখন প্রবলভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে, বিয়ের আগে ছেলে ও মেয়ের দেখাসাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হওয়া উচিত। আমরা তো কতো মেয়েকে পথেঘাটে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালতে প্রয়োজনে দেখি, কথা বলি। সেক্ষেত্রে যাকে বিয়ে করতে হবে তাকে ভালোভাবে না দেখার কী কারণ থাকতে পারে!

advertisement

Posted ৫:২০ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০৭ আগস্ট ২০২০

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আমরা মরি কেন?
আমরা মরি কেন?

(631 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.