বাংলাদেশ ডেস্ক : | বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫
ছবি : সংগৃহীত
নিউইয়র্ক নিউ জার্সির প্যাটারসন। একটি শহর নয় কেবল, যেন একটি দীর্ঘশ্বাস; যার বুকের গভীরে জমে আছে শিল্প বিপ্লবের স্মৃতি আর অভিবাসী জীবনের স্বপ্নছোঁয়া। পাসাইক নদী এখানে সর্পিল হয়ে বয়ে গেছে শহরের কোল ঘেঁষে, তার তীরে দাঁড়িয়ে কখনো দেখা মেলে ফেলে আসা ইউরোপ, এশিয়া, আর দক্ষিণ আমেরিকার ছায়া। এই শহরে প্রতিদিন সূর্য ওঠে এবং অস্ত যায় হাজারো মুখের গল্প বুকে নিয়ে। এখানেই অপরাধ, প্রেম, শ্রম, স্বপ্ন এবং ধ্বংস একে একে গাঁথা হয় জীবনের খণ্ডচিত্রে, যা কখনো ঢুকে পড়ে লোকাল পত্রিকার কোণে, আবার কখনো আদালতের হলঘরে।
এমনই এক শহরে, যেখানে অভিবাসীরা জীবন গড়তে আসে ব্যাগভর্তি স্বপ্নের বোঝা নিয়ে, ঠিক সেখানেই ইতিহাস আর প্রবাসজীবনের আবরণে ঢেকে গিয়েছিল এক ভয়াল প্রতারণাচক্রের গল্প, যার গভীরে ছিল এক বাংলাদেশি-আমেরিকানের পরিকল্পিত প্রতারণা। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন শফিকুল ইসলাম নামে এক তরুণ। নিউ জার্সির প্যাটারসনে এসে প্রথমে একটি লিমো সার্ভিস চালু করেন। তিনি তার নম্রতা আর শব্দচয়নে অচেনাকেও আপন করে নিতে পারতেন। এক বছরের মধ্যেই, ২০১৯ সালে, তিনি গড়ে তোলেন PrimeCare Solutions নামে একটি মেডিকেল বিলিং কোম্পানি। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে বিস্তার ঘটাতে থাকেন তার ব্যবসা। নিউ জার্সি, নিউ ইয়র্ক, পেনসিলভানিয়া ও টেক্সাস, এই চারটি রাজ্যে তিনি অন্তত ১২টি ক্লিনিককে যুক্ত করেন তার নেটওয়ার্কে। কমিউনিটিতে তখন অনেকেই ভাবতেন, তিনি বুঝি মেডিকেল বিজনেসে সফলতা অর্জন করেছেন। কিন্তু কেউ কল্পনাও করেনি যে, তার এই চমকপ্রদ উত্থানের আড়ালে গোপন ছিল এক ভয়ঙ্কর প্রতারণার ছায়া। তিনি ছিলেন এই চক্রের “রিং লিডার”, যার মূল কাজ ছিল ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলোকে
ধোঁকা দিয়ে কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নেওয়া।
এই প্রতারণাচক্রের গঠন ছিল যেন কোনো গ্যাংস্টার সিনেমার কাহিনি। চরিত্রগুলো যেন নিখুঁতভাবে বাছাই করা, আর প্রত্যেকে যেন নিজের ভূমিকায় নিপুণ এক অভিনেতা। ডা. আহমেদ চৌধুরী ব্রঙ্কসের কার্ডিওলজিস্ট, যিনি টাকা পেলে সই করতেন ভুয়া অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি রিপোর্টে। রাজিব হোসেন— ডার্ক ওয়েব ঘেঁটে রোগীর ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করতেন। এমিলি চেন ক্রিপ্টো লন্ডারিং এক্সপার্ট। ৩ জন ফ্রন্ট ডেস্ক কর্মী, ২ জন আইটি হ্যাকার, এবং একজন অভিবাসন আইনজীবী, যিনি অবৈধ অভিবাসীদের কাছ থেকে সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর সংগ্রহ করতেন।
এই চক্রের সবচেয়ে ভয়ংকর কৌশল ছিল Ghost Surgery। তারা এমন রোগীদের নাম ব্যবহার করত, যারা ইতিমধ্যেই মৃত। তাদের নাম ও ইন্সুরেন্স আইডি ব্যবহার করে অস্ত্রোপচারের জাল ক্লেইম করা হতো। এইসব ক্লেইম কখনো কেউ যাচাই করেনি, কারণ তারা বিশ্বাস করেছিল ডাক্তারদের সইকে। কেউ মারা গেছেন ক্যান্সারে; আর সেই নামেই করা হয়েছে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির বিল! বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মধ্যে কার্ডিওলজিস্ট ও অনকোলজিস্টদের নাম সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হতো, কারণ তাদের বিলিং রেট ছিল সর্বোচ্চ। সেইসব বিল পাঠানো হতো অ্যাটনা, ইউএইচসি কিংবা হরাইজনের মতো গ্লোবাল ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে।
এক সময় প্রতারণার এই সিন্ডিকেটের ভেতরে ফাটল ধরতে শুরু করে। রাজিব হোসেন, যিনি ডার্ক ওয়েব থেকে রোগীদের তথ্য জোগাড় করতেন এবং প্রযুক্তিগত দিকটি সামলাতেন, ক্রমে নিজেকে অবমূল্যায়িত মনে করতে থাকেন। বহুবার চাইলেও শফিকুল ইসলাম তার প্রাপ্য এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ডলার কমিশন মেটাননি। ক্ষোভ, অবহেলা আর বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণায় একদিন রাজিব একটি গোপন বার্তা (anonymous tip) পাঠান NYPD-তে।
সে টিপ বা খবর ছিল মূলত ফাঁস করা কিছু ডিজিটাল উপাত্ত; যা তিনি নিজ হাতে তৈরি বা সংগ্রহ করেছিলেন: জাল ক্লেইম ফাইল, ক্রিপ্টো ট্রান্সফারের রেকর্ড, এবং শফিকুলের ইমেইল কথোপকথনের স্ক্রিনশট। তিনি নিজের নাম গোপন রেখে এই টিপ দেন। এফবিআই ও ঘণচউ সেই গোপন তথ্য পেয়েই নজর দেয় এই চক্রের দিকে, এবং এক পর্যায়ে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক স্টিং অপারেশন। ১৮ মাসের গোপন তদন্তে এফবিআই ব্যবহার করে স্পাইওয়্যার, জিপিএস ট্র্যাকিং, এবং undercover agent। এই এজেন্ট, যার ছদ্মনাম ছিল মোহাম্মদ রহিম, শফিকুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে চক্রের অন্তঃস্থলে ঢুকে পড়েন। ১৮ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে, যখন শহর ঘুম ভাঙায় ব্যস্ত, তখন এফবিআই এবং নিউ জার্সি অ্যাটর্নি জেনারেলের যৌথ বাহিনী গোপনে পৌঁছে যায় শফিকুল ইসলামের বাড়িতে। সে সময় তিনি বসে ছিলেন বেসমেন্টে, একটি ল্যাপটপের সামনে। বাইরের দরজায় ধাক্কা, তারপর টর্চলাইটের আলো এবং হ্যান্ডকাফের ক্লিক।
তার বাসা থেকে জব্দ করা হয় দুটি মোবাইল ফোন, একটি রাউটার, এবং সেই ল্যাপটপ, যার হার্ডড্রাইভে পাওয়া যায় প্রায় তিন হাজার জাল মেডিকেল ক্লেইমের রেকর্ড। তল্লাশিতে পাওয়া যায় তিনটি বিদেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিবরণ। এছাড়াও বাংলাদেশে অর্থ গ্রহণকারীদের নাম ও মুদ্রান্তরের রসিদ, যা তার অপরাধমূলক যোগাযোগের শক্ত প্রমাণ। ঠিক চার দিন পর, ২২ জুলাই ২০২৪, সোমবার। নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটের কাতার এয়ারওয়েজ ফ্লাইট ছজ৭০৪ ধরার জন্য শফিকুল ইসলামের স্ত্রী ফারজানা ইসলাম চেকইন লাইনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার হাতে ছিল একটি ছোট স্যুটকেস, চোখে সানগ্লাস, মুখে চাপা টানটান এক চিন্তার রেখা।
ঠিক তখনই DHS (Department of Homeland Security) I CBP (Customs and Border Protection)–এর স্পেশাল ইউনিট গেট নম্বর ৭ এর সামনে হাজির হয়। তাকে ঘিরে ফেলে এক মুহূর্তেই, এবং তার হাতব্যাগ তল্লাশি করে পাওয়া যায়: দুটি এনক্রিপটেড ফ্ল্যাশ ড্রাইভ, একটি ক্রিপ্টো ওয়ালেটের ব্যাকআপ কোড। প্রমাণ হয়ে যায় তিনি ছিলেন শুধু গৃহিণীর মুখোশে এক আন্তর্জাতিক সমন্বয়কারী, যার হাত দিয়েই বাংলাদেশে পাচার হয়েছে কমপক্ষে $৭৫০,০০০। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
২০২৪ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে, নিউ জার্সির ফেডারেল কোর্টে শুরু হয় বহুল আলোচিত এই মামলার প্রাথমিক শুনানি। আদালতের ভিতরে প্রতিটি শ্বাসে যেন জমে ছিল অপরাধ, বিশ্বাসভঙ্গ আর প্রযুক্তির অপব্যবহারের ভয়াবহ দলিল। একজন নার্স স্বাক্ষ্য দেন, “ডাক্তাররা শুধু সই করতেন, রোগী দেখতেন না।” এক সহযোগী বলেন, “আমরা প্রতি সপ্তাহে ২০–৩০টি নতুন রোগীর ডেটা যোগ করতাম।” শফিকুল ইসলামকে আদালতে হাজির করা হয় সাদা পোশাকে। বিচারক তার বিরুদ্ধে উপস্থাপিত প্রমাণ, ডিজিটাল ক্লেইম রেকর্ড, হ্যাকড রোগীর তথ্য, লন্ডার করা অর্থের ট্রেইল পর্যালোচনা করে জামিন আবেদন সরাসরি নাকচ করে দেন। তার ক্রিপ্টো ওয়ালেট, যার মূল্য তখনকার হিসাবে ৩২০,০০০ ডলার আদালতের আদেশে ফ্রিজ করে দেওয়া হয়। একইসঙ্গে আদালত তার বিদেশগমন নিষেধাজ্ঞা জারি করেন, যদিও তার পাসপোর্ট ইতিমধ্যেই জব্দ করা ছিল। অন্যদিকে, ফারজানা ইসলামকেও জামিনের আবেদন জানাতে দেখা যায় আদালতে, তার আইনজীবী যুক্তি দেন তিনি কেবল একজন গৃহিণী এবং পারিবারিক দায়িত্বে যুক্ত।
কিন্তু প্রসিকিউশন পক্ষ সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরে বাংলাদেশে তার মাধ্যমে হুন্ডি ও ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ ডলার পাচার করা হয়েছে এবং তার কাছে থাকা ক্রিপ্টো ব্যাকআপ ও ফ্ল্যাশড্রাইভগুলো থেকে পাওয়া তথ্য তাকে এ মামলার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে চিহ্নিত করে। ফলে তার জামিনও প্রত্যাখ্যান করা হয়। এই মামলার নাটকীয় মোড় আসে যখন ব্রঙ্কসের কার্ডিওলজিস্ট ডা. আহমেদ চৌধুরী আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করে একটি ঢ়ষবধ ফবধষ গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, শফিকুলের অনুরোধে এবং অর্থের লোভে পড়ে তিনি ৪৭টি ভুয়া অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি রিপোর্টে স্বাক্ষর করেন, অথচ কোনো রোগীকে তিনি চোখে দেখেননি।
তার স্বাক্ষ্যে উঠে এসেছে মৃত রোগীদের নাম বেছে নিতে একটি সফটওয়্যার ফিল্টার ব্যবহার হতো, যেখানে বয়স, মৃত্যুস্থান, এবং ইন্সুরেন্স স্ট্যাটাস ফিল্টারিং করা হতো। যদিও তার মেডিকেল লাইসেন্স স্থগিত করা হয়।
তবে তার এই স্বীকারোক্তির বিনিময়ে প্রসিকিউশন পক্ষ তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ডের সুপারিশ করে, যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারত ২০ বছর। এছাড়া তিনি গভর্ণমেন্ট উইটনেস (সরকারি সাক্ষী) হিসেবে আদালতে মূল চক্রের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে সম্মত হন; যার ফলশ্রুতিতে মামলার পরবর্তী ধাপগুলো আরও বিস্ফোরক তথ্য উন্মোচনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ যেন একে একে খুলে যাওয়া প্যান্ডোরার বাক্স, যার ভেতরে লুকিয়ে ছিল মিথ্যা ক্লেইম, অর্থ পাচার, আত্মপ্রবঞ্চনা এবং তথ্যপ্রযুক্তির ভয়াল প্রবাহ। এই ঘটনা শুধু আমেরিকান নয়; আন্তর্জাতিক প্রতারণা চক্রে পরিণত হয়েছিল তা স্পষ্ট হয়।
ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশি রোগীদের ক্লেইম বিশেষ সতর্কতায় যাচাই করছে। এই আস্থা হ্রাস পাচ্ছে পুরো একটি অভিবাসী গোষ্ঠীর উপর। ২০২৫ সালের নভেম্বর। শফিকুল ইসলাম এবং তার চক্রের গ্রেপ্তারের পর কেটে গেছে পুরো একটি বছর। এই সময়জুড়ে ফেডারেল কোর্টে চলছে জেরা, সাক্ষ্য এবং পাল্টা যুক্তির ধারাবাহিক বিস্ফোরণ। জুরি নির্বাচন সম্পন্ন, মূল বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে গত জানুয়ারি থেকে এবং চলছে আপাত-নীরব, কিন্তু বিস্ফোরণবাহী এক বিচারযাত্রা।
আমরা জানি না এই কেসের শেষ রায় কবে আসবে, কিংবা কী পরিণতি ঘটবে। তারা শাস্তি পাবে কি না, তা নির্ভর করবে আদালতের রায়ের ওপর। তবে ইতিহাস তাদের নাম তুলে রাখবে এক অদ্ভুত শিরোনামে, যেখানে চিকিৎসা ছিল না, ছিল শুধু ক্লেইম। বিশ্বাস ছিল না, ছিল শুধু ট্রান্সাকশন। রোগী ছিল না, অথচ মৃতের নামে চলত অস্ত্রোপচারের বিল।
Posted ১১:৪১ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh