বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ১৩ আগস্ট ২০২০
মানুষ সামাজিক জীব। নিজ পরিবারের বাইরে তাই গড়ে তুলে সমাজ। পারস্পরিক সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন করে সুদৃঢ়। সুদিন-দুর্দিনে, সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ায় একে অপরের। একই ভাষাভাষী ও জাতি গোষ্ঠির মানুষ হলেতো কথাই নেই। তা তারা যেখানে, যতদূরে বা যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন প্রয়োজনে সমবেত হয় একই ছায়ায়। আবদ্ধ হয় নিবিড় সামাজিক বন্ধনে। এগিয়ে নিয়ে যায় তাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যের ধারাকে।
বাংলাদেশীদের মাঝে সামাজিক এ বন্ধন ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত। এছাড়া সংগঠন প্রিয়তা বাংলাদেশীদের একটি বিশেষ গুণ। এ কারণেই বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশীরা বিদেশ বিভূয়েও পছন্দ করেন সমাজবদ্ধ থাকতে। আর এজন্যই গড়ে তুলেন বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক সংগঠন। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশীরা এর বাইরে নয়। এরাও কঠোর পরিশ্রমের ফাঁকে স্বদেশী-স্বজনদের সাথে একত্রিত হয়ে ভাগাভাগি করতে চান আনন্দ-বেদনা। আয়োজন করেন উৎসব অনুষ্ঠান। সমবেত হন বিভিন্ন পালা পার্বনে। নিউইয়র্ক সিটিতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের রয়েছে কয়েকশত সংগঠন। এসব সংগঠনের মধ্য থেকে নিজ কর্মগুণে উঠে এসেছে জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটি জেবিএফএস। নিউইয়র্ক সিটির জ্যামাইকা এলাকায় বসবাসকারী বাংলাদেশীদের একটি সামাজিক সংগঠন।
জ্যামাইকায় বাংলাদেশী অভিবাসীরা একটি সুন্দর প্রতিবেশ গড়ে তুলেছেন। ম্যানহাটান ও লং আইল্যান্ডের গেইটওয়ে বা প্রবেশদ্বার জ্যামাইকা এখন বিভিন্ন শ্রেনী পেশার বিপুল সংখ্যক মানুষের বাসস্থান। বিশেষ করে জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার সহ বেশ কয়েকটি মসজিদ গড়ে উঠেছে। হিলসাইড এভিন্যু জুড়ে বাংলাদেশীদের জমজমাট ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। এলাকাটিতে স্বদেশী একটি আবহও আমেজের সৃষ্টি করেছে। এমন একটি পরিবেশ প্রায় দ্ইু দশক আগে গোড়াপত্তন ঘটে জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটির। স্থানীয় হিলসাইড এভিন্যুর ফাতেমা ব্রাদার্সের সর্ব কনিষ্ঠ ভ্রাতা ফকরুল ইসলাম দেলোয়ারের উদ্যোগে গড়ে উঠে সংগঠনটি। সমমনা বেশ কয়েকজন তরুণকে নিয়ে দেলোয়ার প্রতিষ্ঠা করেন জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটি। আর তখন তার উপরই ন্যাস্ত করা হয় প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব। এসময় তরুণদের পাশাপাশি সংগঠনটির উপদেষ্টা পরিষদে সম্পৃক্ত করা হয় স্থানীয় কম্যুনিটির বিভিন্ন শ্রেনী পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তি বর্গকে।
সেই থেকে বিরামহীনভাবে পথ চলছে জেবিএফএস। একে একে নেতৃত্বে উঠে আসছে অনেক তরুণ । স্থানীয় কম্যুনিটির সাথে মিশে যাওয়া এ সংগঠনটি জন্মের পর থেকেই আয়োজন করে আসছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি। ফি বছর বৈশাখী মেলা, ইফতার মাহফিল, বনভোজন, বাংলা স্কুল, স্থানীয় জন প্রতিনিধিদের সাথে টাউন হল মিটিং, দেশ ও প্রবাসে দুর্যোগে নিপতিতদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করেছে তাদের দক্ষতা ও প্রয়োজনীয়তা। এসব সমাজ কল্যাণমূলক কর্মকান্ডে নিউইয়র্ক সিটির বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে জ্যামাইকা ফ্রেন্ডস সোসাইটির সুনাম।
করোনা ভাইরাস মহামারিতে গোটা যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে যখন জাতীয় জরুরী অবস্থা বিদ্যমান। নিউইয়র্ক সিটিতে প্রতিদিন প্রাণহানি ঘটছে শত শত মানুষের। অবরুদ্ধ এ লাশের নগরী রাস্তাঘাট জনমানব শূণ্য। মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত মানুষ দিশেহারা। ঘরের বাইরে যাওয়ার সাহস নেই। কম্যুনিটির দু’চারজনের মৃত্যু খবর আসছে প্রতিদিন। এমন একটি অবস্থায় স্থানীয় বাংলাদেশীদের সাহায্যে এগিয়ে আসে জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটি। জীবনের ঝুকি নিয়ে রাস্তায় নামে সংগঠনটির কর্মকর্তাগণ। এগিয়ে আসে মানবতার সেবায়। ঘরে ঘরে খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌছে দেয়ার কাজে নিয়োজিত করে নিজেদেরকে। করোনাকালে সংগঠনের কর্মকর্তাগণ নিজ অনুদানের মাধ্যমে সংগৃহিত অর্থে খাদ্য সামগ্রী ক্রয় করে তা মানুষের মাঝে বিতরণ করেন। এছাড়া নিউইয়র্ক সিটি সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা সাহায্য-সামগ্রী পৌছে দেন মানুষের দোড় গোড়ায়। কম্যুনিটিতে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে মাস্ক, গ্লোবস, স্যানিসাটাইজারও বিতরণ করা হয় সংগঠনের পক্ষ থেকে। জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটির বর্তমান সভাপতি ফকরুল ইসলাম দেলোয়ার, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আল আমিন রাসেল ও প্রধান উপদেষ্টা এবিএম ওসমান গণির নেতৃত্বে সংগঠনের প্রতিটি সদস্য এই সেবামূলক কর্মকান্ডে নিরলসভাবে কাজ করেছে। করোনাকালেও জ্যামাইকা ফ্রেন্ডস সোসাইটির খাদ্য বিতরণ কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছেন কংগ্রেস ওম্যান গ্রেস মেং সহ অন্যান্য জনপ্রতিনিধি। তাদের এ প্রচেষ্টা এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে জানান সভাপতি ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার। সম্প্রতি অন্যান্য সংগঠনের সাথে সম্মিলিতভাবে কোভিড-১৯ ও এন্টিবডি টেস্ট কার্যক্রমে অংশ নিয়ে জ্যামাইকা ফ্রেন্ডস সোসাইটি প্রশংসা কুঁড়িয়েছে মানুষের।
নিউইয়র্কে সপ্তাহব্যাপী ফ্রেন্ডস সোসাইটির ফুড ডিস্ট্রিবিউশন
জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটির উদ্যোগে করোনাভাইরাস ক্ষতিগ্রস্থ আনডকুমেনেটেড প্রবাসী বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন কমিউনিটির মানুষদের মাঝে সপ্তাহব্যাপী ‘ফুড ডিষ্ট্রিবিউশন’করে। পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এতে তিন শতাধিক পরিবার পয় ‘ঈদ উপহার’ সামগ্রী। এছাড়াও অর্ধ শতাধিক পরিবারের বাসা-বাড়িতে গিয়ে হোম ডেলিভারির মাধ্যমে ‘ঈদ উপহার’ পৌছে দেয়া হয়। ফ্রেন্ডস সোসাইটি সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ মে ‘ইফতারি বক্স’ বিতরণের মধ্য দিয়ে সংগঠনের ‘ফুড ডিষ্ট্রিবিউশন’ কার্যক্রম শুরু হয়। জ্যামাইকার হিলসাইড এভিনিউর ফাতেমা গ্রোসারী আর জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার (জেএমসি) এর সামনে থেকে সভাপতি মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোস্তফা আল আমীন রাসেলের নেতৃত্বে কর্মকর্তারা উল্লেখিত কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেন। কর্মসূচির শেষ দিনে গত ১২ মে দুপুর ১২টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ১৬৮ স্ট্রীট ও হিলসাইড এভিনিউতে এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এসময় সর্বস্তরের তিন শতাধিক পরিবার হিলসাইড এভিনিউ থেকে হাইল্যান্ড এভিনিউ পর্যন্ত ১৬৮ স্ট্রীটে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ‘ফুড ও ইফতারী বক্স’ গ্রহণ করেন।
দুপুরে ‘ফুড ডিষ্ট্রিবিউশন’ কর্মসূচির শুরুতে বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করেন করেন ফ্রেন্ডস সোসাইটির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। এসময় ফ্রেন্ডস সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার এবং সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোস্তফা আল আমীন রাসেল ছাড়াও কর্মকর্তাদের মধ্যে উপস্থিত প্রধান উপদেষ্টা এবিএম ওসমান গণি, উপদেষ্টা ও সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদ এ খান, উপদেষ্টা ও জেএমসি’র সেক্রেটারী মনজুর আহমেদ চৌধুরী, সাবেক সভাপতি শেখ হায়দার আলী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে মিসবাহ উজ্জামান, রেজাউল আজাদ ভুইয়া, সেবুল মিয়া, ইফজাল আহমেদ চৌধুরী, যুগ্ম সম্পাদক এডভোকেট কামরুজ্জামান বাবু সহ সৈয়দ আতিকুর রহমান, মন্নাফ তালুকদার, আনোয়ার হোসেন, সুমন খান, হামিদুর রহমান, বাবুল হাওলাদার, আখতার বাবুল, মুরাদ খন্দকার, মাহিন রহমান, রিজু মোহাম্মদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও বাপা সভাপতি ক্যাপ্টেন কারাম চৌধুরী ও কোষাধ্যক্ষ রাশেক মালিকসহ বেশ কয়েকজন বাপা কর্মকর্তা ফ্রেন্ডস সোসাইটির ‘ফুড ডিষ্ট্রিবিউশন’ কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন। সভাপতি ফখরুল ইসলাম দেলোয়ারকে জানান, কোভিড-১৯ শুরুর সময় থেকেই ফ্রেন্ডস সোসাইটির পক্ষ থেকে জ্যামাইকাবাসী বাংলাদেশীদের সেবায় সহযোগিতার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। বিশেষ করে জ্যামাইকায় বসবাসকারী বাংলাদেশী সহ অন্যান্য কমিউনিটির আনডকুমেনটেডদের জন্যই ব্যাপকারে ‘ফুড ডিষ্ট্রিবিউশন’ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় এবং সবার সহযোগিতায় এই কর্মসূচি সফল হয়েছে। ফ্রেন্ডস সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোস্তফা আল আমীন রাসেল জানান, এই কর্মসূচীর আওতায় এমন ৩’শটি পরিবারের মাঝে ফ্রেন্ডস সোসাইটির উপহার সামগ্রী (চাল-ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় গ্রোসারী) এবং ইফতারি বক্স বিতরণ করা হয়। এছাড়াও যারা অসুস্থতার কারণে বাসার বাইরে বের হতে পারেননি এমন আরো প্রায় ৭৫টি পরিবারের বাসায় উপহার বক্স পৌঁছে দেয়া হয়।
ফ্রেন্ডস সোসাইটির কর্মকান্ড সামাজিক সংগঠনগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত
জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটির উদ্যোগে আয়োজিত ‘কভিড-১৯ ভার্চুয়াল কমিউনিটি এসিসটেন্স অনুষ্ঠান’-এ বক্তারা ফ্রেন্ডস সোসাইটির কর্মকান্ডের প্রশংসা করে বলেছেন, প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসেরর এই মহামারীতে সংগঠনিটি যেভাবে মানবাতার সেবায় এগিয়ে এসেছে এবং বিভিন্ন কর্মসূচী অব্যাহত রেখেছে তা কমিউনিটির সামাজিক সংগঠনগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ফ্রেন্ডস সোসাইটির কর্মকর্তা ও সদস্যগণ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করারও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বক্তারা বলেন, যেকোন বিপদ-আপদে কমিউনিটির সেবায় সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে, একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়াতে হবে। তারা আগামী দিনেও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার উপর গুরুত্বারোপ করেন এবং আগামী ২৩ জুন অনুষ্ঠিতব্য প্রাইমারী নির্বাচন ভোটারদের ভোট প্রদান ও সেনসাস-২০২০ কর্মসূচীতে সকলের নাম অন্তর্ভূক্ত করার আহাবান জানান। এবি টিভির সহযোগিতায় রোববার রাত ১০টায় অনুষ্ঠিত এই ভার্চুয়াল আলোচনায় অংশ নেন ডাক্তার, আইনজীবি, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, রিয়েল এস্টেট বিশেষজ্ঞ সহ বিভিন্ন পর্যায়ের কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এক ঘন্টার অনুষ্ঠানটি এবি টিভি সরাসরি সম্প্রচার করে। এছাড়াও ফেসবুক লাইভে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হয়।
Posted ৮:১২ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৩ আগস্ট ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh