নিউইয়র্ক : | বৃহস্পতিবার, ০৫ জানুয়ারি ২০২৩
বিশিষ্ট সাংবাদিক, জাতীয় প্রেসক্লাব ও নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের অন্যতম সদস্য মাইন উদ্দিন আহমেদের নামাজে জানাজা গত সোমবার বাদ এশা ওজোন পার্কের বায়তুল মামুর মসজিদ এন্ড কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়। ৩ জানুয়ারি মঙ্গলবার বিকেলে তাকে নিউজার্সীর মালবরো মুসলিম কবরস্থানে দাফন করা হয়। উল্লেখ্য, গত ১ জানুয়ারী রোববার রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি জ্যামাইকা মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। তাঁর নামাজে জানাজায় নিউইয়র্কের বাংলা ভাষার মিডিয়াগুলোর সম্পাদক ও সাংবাদিকগণ অংশ নিয়ে তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান।
সাংবাদিক মাইন উদ্দিন আহমেদ গত সপ্তাহে বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি কিডনি সমস্যা সহ নানাবিধ শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, দুই পুত্র আর দুই কন্যা সহ বহু আত্নীয়-স্বজন রেখে গেছেন। তিনি স্ত্রী ও এক পুত্র নিয়ে ওজনপার্কে বাস করছিলেন। তার এক পুত্র আর দুই কন্যা বাংলাদেশ বসবাস করেন।
বাংলাদেশে তাঁর বাড়ী নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলায়। বায়তুল মামুর মসজিদ এন্ড কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত তার নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন মসজিদের খতিব ও পেশ ইমাম মওলানা দেলোয়ার হোসাইন। নামাজের আগে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন মরহুমের ভায়রা আব্দুর রহমান ও পুত্র রিয়াজ আহমেদ। এসময় সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সভাপতি এবং সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা সম্পাদক ও টাইম টিভি’র সিইও আবু তাহের। জানাজায় বিভিন্ন মিডিয়ার সম্পাদক ও সাংবাদিকসহ কমিউনিটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গসহ বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী অংশ নেন। এতে সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদ এ খান, সাপ্তাহিক পরিচয় সম্পাদক নাজমুল আহসান, সাপ্তাহিক বাঙালী সম্পাদক কৌশিক আহমেদ, সাপ্তাহিক নবযুগ সম্পাদক শাহাব উদ্দিন সাগর, নিউইয়র্ক ভিত্তিক বার্তা সংস্থা ইউএনএ সম্পাদক এবিএম সালাহউদ্দিন আহমেদ, নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সাবেক সহ সভাপতি তাসের খান মাহমুদ, সাধারণ সম্পাদক মনোয়ারুল ইসলাম, যুগ্ম সম্পাদক মমিন মজুমদার, কোষাধ্যক্ষ রশিদ আহমদ, ফটো সাংবাদিক সানাউল হক ও নিহার সিদ্দিকী প্রমুখ সাংবাদিক অংশ নেন। এছাড়াও কমিউনিটির বিশিষ্টজনদের মধ্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. রুহুল আমিন, কবি কাজী জহিরুল ইসলাম, সাহিত্য একাডেমীর মোশাররফ হোসেন, সাবেক টিভি প্রযোজক ফিরোজ কবির, কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট কাজি ফৌজিয়া, ড. জাহাঙ্গীর কবির, গোপাল স্যানাল, বৃহত্তর নোয়াখালী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিক মাইন উদ্দিন আহমেদ-এর পুত্র রিয়াজ আহমেদ জানান যে তার পিতা গত ২৭ মঙ্গলবার রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দ্রুত জামাইকা মেডিক্যাল সেন্টারের জরুরী বিভাগে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে প্রাথমিক চেকআপে তার কিডনীতে টিউমার ধরা পরে, ডাক্তাররা ক্যান্সারের সম্ভাব্যতা যাচাই করছিলেন। সার্জারির পরিকল্পনা করা হচ্ছিলো। সার্জারির পর বায়োপসির মাধ্যমে ক্যান্সার বিষয়ক সন্দেহ দূর হবে এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসার দিক নির্ধারণ করা হবে বলে চিকিৎসকগণ জানিয়েছিলেন। তিনি জানান, প্রয়োজনে অব্বাকে মানহাটানস্থ মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে স্থানান্তর করার চিন্তাভাবনা হচ্ছিলো।
সাংবাদিক মাইন উদ্দিন আহমদ তাঁর দীর্ঘ পেশাগত জীবনে ইংরেজি সাংবাদিকতায় দক্ষতা ও মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। সর্বশেষ তাঁর কর্মস্থল ছিল ইংরেজি দৈনিক ডেইলি ইন্ডিপেন্ডেন্ট। তিনি একাধিকবার বিএফইউজে’র কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছিলেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)-এর প্রবীণ সদস্য। নিউইয়র্কের টাইম টেলিভিশন-এর সংবাদ পর্যালোচনামূলক ‘প্রেস ভিউ’ অনুষ্ঠানের নিয়মিত অতিথি আলোচক ছাড়াও নিয়মিত কলাম লিখতেন সাপ্তাহিক দেশ-এ। তাঁর লেখা একাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে।
এদিকে সিনিয়র সাংবাদিক মাইন উদ্দিন আহমেদ-এর আকস্মিক মৃত্যুর খবরে নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু তাহের ও সাধারণ সম্পাদক মনেয়ারুল ইসলাম, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক চৌধুরী মোহাম্মদ কাজল, নিউইয়র্ক ভিত্তিক বার্তা সংস্থা ইউএনএ সম্পাদক এবিএম সালাহউদ্দিন আহমেদ গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। সাংবাদিক মাইন উদ্দিন আহমদ-এর ইন্তেকালে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করে তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করেছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)-এর একাংশের সভাপতি এম আব্দুল্লাহ। এছাড়াও বাংলাদেশ সোসাইটির পক্ষ থেকে সাংবাদিক মাইন উদ্দিন আহমদ-এর ইন্তেকালে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করে তাঁর বিদেহী আত্নার মাগফেরাত কামনা করেছেন সোসাইটির সভাপতি মোহাম্মদ রব মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ রুহুল আমিন সিদ্দিকী এবং ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিজ। নিউইয়র্ক (ইউএনএ)
সাংবাদিক মাইনুদ্দিনের ইন্তেকালে বাংলাদেশ সোসাইটির শোক : বিশিষ্ট সাংবাদিক, ঢাকাস্থ জাতীয় প্রেসক্লাব স্থায়ী সদস্য এবং নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার কলামিস্ট মাইন উদ্দিন আহমেদের ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সোসাইটির কার্যকরী পরিষদ ও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা গভীর শোক। তারা শোকসন্তপ্ত পরিবারের জন্য গভীর সমবেদনা জানান এবং তার রুহের মাগফিরাত কামনা করেন। তারা এক শোকবার্তায় মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনার জন্য সকল প্রবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। সোসাইটির সভাপতি মোহাম্মদ রব মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ রুহুল আমিন সিদ্দিকী এবং ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিজ বলেন, রাব্বুল আলামিন তাকে যেন জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন এবং তার পরিবারকে এই শোক সইবার ধৈর্য দান করেন। সোসাইটির পক্ষ থেকে তার পরিবারের যে কোন প্রয়োজনে পাশে থাকার কথা জানান তারা।
তারপরও তিনি থাকবেন : চৌধুরী মোহাম্মদ কাজল
আমরা তিনজন থাকতাম শহরের তিন প্রান্তে। পলাশ ভাই জ্যামাইকাতে, মাইনুদ্দিন ভাই ওজোন পার্কে আর আমি ব্রুকলিনে। সপ্তাহের ছুটির দিনগুলিতে আমরা একত্রিত হতাম জ্যাকসন হাইটসে। জ্যাকসন হাইটসের ডাইভার্সিটি প্লাজায় চা খেতে খেতে গল্প করা ছিল আমাদের নিয়মিত অভ্যাস। ছুটির দিন ছাড়াও অন্য কোনদিন জ্যাকসন হাইটস আসা হলে ফোন করতাম। তারা চলে আসার চেস্টা করতেন। কিছুদিন আগে আমি স্টেটেন আইল্যান্ডে মুভ হওয়ায় ও শীত চলে আসায় জ্যাকসন হাইটসে আমার আসা একটু কমে গিয়েছিল। কিন্ত টেলিফোনে যোগাযোগ ছিল। মাইনুদ্দিন ভাইয়ের সাথে সম্ভবত শেষ দেখা হয়েছিল নিউইয়র্ক-বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব আয়োজিত প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘ অধিবেশন কভার করতে ঢাকা থেকে আসা সাংবাদিকদের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে।
মাইনুদ্দিন ভাইকে ঢাকা থাকতেই চিনতাম। আমরা একসাথে দি ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকায় কাজ করেছি। আমি আমেরিকা আসার কয়েক বছর পর তিনি সপরিবারে আমেরিকা চলে আসেন। শুরুতে আমেরিকার জীবনযাত্রার সাথে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না। নিউইয়র্কে তার পরিচিত অনেকেই আছেন। কিন্তু প্রথমদিকে অনেকের সাথেই যোগাযোগ ছিলনা। আমার সাথে প্রায়ই আলোচনা করতেন কি করা যায়। কাজ করার জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষনও নিয়েছিলেন। কিন্তু করা হয়নি কোনটিই। তিনি যখন আমেরিকায় আসেন আমি তখন নিউইয়র্ক-বাংলা প্রেস ক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক। আমেরিকা আসার পরপরই আমি তাকে আমাদের ক্লাবের সদস্য করে নেওয়ার উদ্যোগ নিই। এরপর তিনি আবারও লিখালিখি শুরু করেন। নিউইয়র্কের সংবাদপত্র জগতে নিজের একটি অবস্থান তৈরী করে নেন। এখানকার একটি পত্রিকায় ‘কথার কথকথা’ শিরোনামে নিয়মিত কলাম লিখে যথেস্ট পরিচিত হয়ে ওঠেছিলেন। নিউইয়র্ক থেকে প্রচারিত বাংলা টিভি চ্যানেল টাইম টিভিতে সংবাদভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠানে নিয়মিত দেখা যেত তাকে। সাংবাদিকতা করার পাশাপাশি তিনি যে কবিতাও লিখতেন আমার জানা ছিল না। কিছুদিন আগে তার ইংরেজী কবিতার বই ’লাভ ইজ সফটওয়্যার বন্ডেজ’ প্রকাশিত হয়েছে। আমাকে একটি বই গিফট করেছিলেন। আমি সযত্নে রেখে দিয়েছি, পড়া হয়নি কখনও। মাইনুদ্দিন ভাই প্রায়ই বলতেন কবিতাগুলি পড়ে দেখতে। আমি বলতাম বাংলা কবিতাই আমার মাথায় ঢোকেনা, আপনিতো লিখেছেন ইংরেজীতে। তার জীবদ্দশায় তার কবিতাগুলি পড়া হয়নি। এখন হয়তো পড়বো। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। একজন আপাদমস্তক জেন্টেলম্যান। তাকে কখনও উচু গলায় কথা বলতে বা কারো সাথে রাগারাগি করতে দেখিনি।
গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিজেই হাসপাতাল থেকে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন। আতঙ্কজনক কিছু মনে হয়নি। এর দু’দিন পর তার ছেলে পোস্ট দিয়ে জানাল যে অবস্থা গুরুতর। নববর্ষের প্রথম রাতে কাজ থেকে ফিরেছি। পলাশ ভাই ফোন করলেন রাত সাড়ে এগারটার দিকে। বললেন মাইনুদ্দিন ভাইয়ের ছেলে ম্যাসেঞ্জার করেছে ‘আব্বু ইজ নো মোর’। এর অর্থ কি হতে পারে। বললাম এর অর্থতো একটিই – তিনি আর নেই। বিশ্বাস হচ্ছিল না। বিভিন্ন জায়গায় ফোন করলাম। কেউ কিছু বলতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত ফেসবুকেই চূড়ান্ত দুঃসংবাদটি পেলাম।
মাইনুদ্দিন ভাই ঢাকা প্রেসক্লাবের সদস্য ছিলেন। সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা হিসেবেও ভূমিকা রেখেছেন। খেলাধূলার সাথে তেমন সম্পৃক্ততা না থাকলেও একসময় মার্শাল আর্ট প্র্যাকটিস করতেন। কারাতেতে ব্ল্যাকবেল্ট অর্জন করেছিলেন ৪০ বছর বয়সে। এত বেশী বয়সে এর আগে কেউ ব্ল্যাকবেল্ট পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। তার ৬৯ বছর বয়সী জীবনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। নিউজার্সির মার্লবোরো মুসলিম সিমেট্রিতে তার ঠিকানা স্থায়ী হয়েছে। গতকাল তাকে সমাহিত করা হয়েছে (জানুয়ারী ৩, ২০২৩)। আমি আর পলাশ ভাই হয়তো আরও কিছুদিন ডাইভার্সিটি প্লাজায় চা খেতে পারবো। কিন্তু মাইনুদ্দিন ভাই আর ফোন করে বলবেন না আর একটু অপেক্ষা করুন আমি কাছাকাছি চলে এসেছি। কিন্তু.., কিন্তু তারপরও তিনি থাকবেন। তার কথকথার অনুরণন আমাদের হৃদয়ে বাজবে। জ্যাকসন হাইটসের বাতাসে নিশ্চয় তার স্পর্শ পাওয়া যাবে।
Posted ৪:১৫ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৫ জানুয়ারি ২০২৩
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh