বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর ২০২১
নিউইয়র্ক সিটিতে গত এক দশকে সবচেয়ে দ্রুত বেড়েছে এশিয়ান-আমেরিকান জনগোষ্ঠী। বিশেষ করে সিটির কুইন্স বরোতে। কোন কোন এলাকায় শুধু জনবসতির ক্ষেত্রে নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এশিয়ানদের প্রাধান্য বিস্তারের দৃশ্য যে কারো নজর কাড়ে সহজেই। বাণিজ্যিক এলাকাগুলোর অট্টালিকা সারির বাইরে বিভিন্ন এশিয়ান ভাষায় লেখা সাইনবোর্ড ঝুলছে, সন্ধ্যার পর নানা রঙয়ের আলো ঘোষণা করছে এশিয়ানদের সদর্প উপস্থিতি। গত ১৮ অক্টোবর, ২০২১ তারিখের নিউইয়র্ক টাইমসে “ইনসাইড দ্য এনওয়াইসি নেহবারহুড উইথ ফাষ্টেস্ট গ্রোয়িং এশিয়ান পপুলেশন” শিরোনামে প্রকাশিত এক দীর্ঘ রিপোর্টে পরিসংখ্যান ব্যুরোর চলতি আগস্ট মাসের রিপোর্টের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে নিউইয়র্ক সিটির সামগ্রিক জনসংখ্যায় এশিয়ান জনসংখ্যা ২০১০ সাল থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে ৭.৭ শতাংশ, যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বৃদ্ধি। ২০১০ সাল থেকে সিটির এশিয়ান জনসংখ্যা ৩ লাখ ৪৫ হাজারের চেয়েও বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় নিউইয়র্ক সিটিতে এশিয়ান জনসংখ্যার অনুপাত দাঁড়িয়েছে ১৫.৬ শতাংশ। জনতত্ত্ববিদরা কয়েকবছর আগেও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে বিভিন্ন কারণে নিউইয়র্ক সিটির জনসংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকবে। কিন্তু এশিয়ান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তাদেরকেও বিস্মিত করেছে। সিটির পাঁচটি বরোতে বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠী হিসেবে শুধু এশিয়ান সংখ্যাই বেড়েছে।
কুইন্সের যেসব স্থানে এশিয়ান জনসংখ্যা অধিক, সেখানে যে কোন শ্রেনিপেশার লোকজনকে পাওয়া যাবে। প্রতিটি এশীয় জাতিগোষ্ঠীর নাপিতের দোকান থেকে শুরু করে গ্রোসারি, রেস্টুরেন্ট, ফার্মেসি, বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস, ইলেক্ট্রনিকস শপ সবই রয়েছে। কুইন্সের পশ্চিম কোণায় লং আইল্যাণ্ড সিটির এস্টোরিয়ার বিরাট অঞ্চল জুড়ে এখন তাইওয়ানিজ বংশোদ্ভুত এশিয়ান-আমেরিকানদের দখলে। সারি সারি দোকান, সাইডওয়াক ভেন্ডররা প্রায় সবাই তাইওয়ান থেকে আগত ইমিগ্রান্ট।
একইভাবে জ্যাকসন হাইটসের কয়েকটি স্ট্রিট, জ্যামাইকার হিলসাইড এভিনিউয়ের বেশ কয়েক ব্লক জুড়ে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান। এসব স্থানে সাইডওয়াকে পান, ঝালমুড়ি ও ফুচকার দোকান থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্ট, গ্রোসারি, ফার্মেসি, ডাক্তারের অফিস, আইনগত সহায়তাদানকারী প্রতিষ্ঠান, মসজিদ সবই বাংলাদেশী মালিকানাধীন। সেবা গ্রহণকারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বাংলাদেশী। এসব এলাকায় বাড়িঘর বিক্রি হলেও বাংলাদেশী ক্রেতারাই এগিয়ে যায়। এক দেশের, এক ভাষায় কথা বলা মানুষের সান্নিধ্যে থাকতে ও তুলনামূলকভাবে অধিক নিরাপত্তার আশায় একই কমিউনিটি লোকজন প্রাইভেট বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে ভাড়াটে হয়ে আসে।
যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে যারা এশিয়ান হিসেবে পরিচিত, তাদের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি, যারা ২০টির বেশি দেশ থেকে ইমিগ্রান্ট হয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রে এবং বেশির ভাগই বসবাসের জন্য বেছে নিয়েছে নিউইয়র্ক, লস এঞ্জেলেস, হিউস্টন, সিয়াটেল, মিশিগান, স্যান ফ্রান্সিসকোর বড় বড় সিটিতে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নর্থ ডাকোটা, ইণ্ডিয়ানা, নর্থ ক্যারোলিনার মত স্টেটের বড় সিটিগুলোতেও এশিয়ানরা স্থান করে নিতে শুরু করেছে। এক লাখের মত লোকের বসবাস এমন সিটিতেও এশিয়ান গ্রোসারি ও রেস্টুরেন্ট দেখা যায় এখন। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় মোট জনসংখ্যা হ্রাস পেলেও এশিয়ান সংখ্যা লক্ষ্যণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টে নিউইয়র্ক সিটির কুইন্স বরোর লং আইল্যান্ড সিটির নেইবারহুডগুলোতে এশিয়ান জনসংখ্যা ২০১০ সালের চেয়ে পাঁচ গুণ বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে প্রায় ১১,০০০ এশিয়ান বাস করে, যা ওই নেইবারহুডগুলোর মোট বসবাসকারীর প্রায় ৩৪ শতাংশ। এছাড়াও ব্রুকলিনের বেনসনহার্স্ট থেকে ব্রঙ্কসের পার্কচেষ্টারে মত স্থানগুলোতে এশিয়ানরা রিয়েল এস্টেট মার্কেট, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে এশিয়ানদের প্রাধান্য চোখে পড়ার মত। সিটি কাউন্সিলের জন্য নির্বাচনে প্রার্থিতা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে গত জুন মাসে অনুষ্ঠিত ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে লং আইল্যান্ড সিটির আসনসহ ছয়জন এশিয়ান আমেরিকান জয়ী হয়েছেন। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী লং আইল্যান্ড সিটির বেশির ভাগ এশিয়ান মূলত চাইনিজ, তাইওয়ানিজ, জাপানিজ ও কোরিয়ান। ম্যানহাটানের চাইনাটাউন তো আছেই, দক্ষিণ ব্রুকলিনে নতুন চায়নাটাউন গড়ে উঠছে।
লং আইল্যান্ড সিটির আরেকটি অংশ কুইন্সব্রিজ হাউজিং, যেটি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সরকারি আবাসিক কমপ্লেক্স, ২০১৯ সালের হিসাবে সেই কমপ্লেক্সে ভাড়াটেদের ১১ শতাংশই এশিয়ান। ম্যানহাটান ও এস্টোরিয়া এলাকায় আবাসন ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ায় চাইনিজ, কোরিয়ান ও বাংলাদেশীরা সেসব এলাকা ছেড়ে কুইন্সে ভিড় করছে এবং কুইন্সব্রিজ এলাকা যাতে মাঝারি আয়ের লোকদের সাধ্যের মধ্যে থাকে, সেজন্য তারা লাক্সারী অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প নির্মাণের বিরোধিতা করে আন্দোলন পরিচালনা করছে।
দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারীদের ১০.৪% এশিয়ান
নিউইয়র্ক সিটিতে এশিয়ান জনগোষ্ঠী ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেলেও তাদের মধ্যে দারিদ্রও বেড়েছে। সিটিতে বসবাসকারীদের মধ্যে যারা দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে, তাদের ১০.৪ শতাংশ এশিয়ান আমেরিকান। ২০১০ সালে এই হার ছিল ৯.২ শতাংশ। এশিয়ান আমেরিকান ফেডারেশন এর সমীক্ষা অনুযায়ী নিউইয়র্ক সিটিতে দারিদ্র ২০১০ সালের ২৫২,০০০ থেকে ২০১৯ এ ২৯০,০০০ এ উন্নীত হয়েছে। দারিদ্রের কারণে অনেক এশিয়ান আমেরিকান নিউইয়র্ক সিটি ছেড়ে সিটির প্রান্তে ছোট ছোট শহরে বসত গড়ছে নিউইয়র্ক সিটির অত্যধিক আবাসিক ব্যয়ের কারণে, যা অধিকাংশ মানুষের পক্ষে নির্বাহ করা কষ্টকর। তবে সাম্প্রতিককালে এশীয় দেশগুলো থেকে যারা যুক্তরাষ্ট্রে ইমিগ্রান্ট হিসেবে আসছেন, তারা নিউইয়র্ক সিটিতে বসবাস করাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। এর পেছনে কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে নিউইয়র্ক সিটিতে নতুন ইমিগ্রান্টরা তাদের নিজ ভাষায় কথা বলার ও সাংস্কৃতিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ লাভ করে, এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি থাকায় যে কারো পক্ষে কাজ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে, নিউইয়র্ক সিটিতে চিকিৎসা সেবার সুবিধা অন্য স্টেটের চেয়ে বেশি, যাতায়াতের জন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে ব্যাপক ও সুলভ।
এশিয়ান আমেরিকান ফেডারেশনের এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর জো-অ্যান ইয়ো বলেছেন, দারিদ্রের মধ্যে পতিত এশিয়ানদের বিপুল সংখ্যক সিটি প্রান্তের দিকে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় স্থানীয় ও স্টেট এজেন্সিগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে, যাতে এশিয়ানরা প্রয়োজনীয় সার্ভিসগুলো সহজে পেতে পারে। কংগ্রেসওম্যান গ্রেস মেং বলেছেন, দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী এশিয়ান আমেরিকানদের সংখ্যাবৃদ্ধি আশঙ্কাজনক এবং তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য আরো মনোযোগী হতে হবে, যাতে তারা শীঘ্র দারিদ্রসীমার বাইরে চলে আসতে সক্ষম হয়। নিউইয়র্ক স্টেট সিনেটর জন সি ল্যু বলেছেন, এশিয়ান আমেরিকানরা দীর্ঘদিন ধরেই দারিদ্রের শিকার এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। এ অবস্থার অবসানের লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ জরুরী। একই সাথে তিনি এশিয়ান আমেরিকান কমিউনিটির উপর বিদ্বেষপ্রসূত আচরণ ও উগ্রতার বৃদ্ধির প্রবণতাকে মোকাবিলার জন্যও তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের আহবান জানান। এশিয়ান আমেরিকান ফেডারেশনের রিপোর্টটি কোভিড ১৯ ছড়িয়ে পড়ার পূর্ববর্তী সময়ের সমীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে এবং এতে ফুটে উঠেছে যে, এশিয়ানদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি দারিদ্রের মধ্যে রয়েছে, তারা প্রধানত: মঙ্গোলিয়ান, বার্মিজ, বাংলাদেশী, কম্বোডিয়ান, চাইনিজ, পাকিস্তানি ও মালয়েশিয়ান।
Posted ৩:৩২ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh