ডা. ওয়াজেদ খান | শনিবার, ২০ জুন ২০২০
যুক্তরাষ্ট্র এখন স্মরণকালের ভয়াবহ সংকটে নিপতিত। করোনা মহামারীতে প্রাণহানি এখনো থামেনি। অনেক শহরে লকডাউন বিদ্যমান। স্থবিরতা কাটেনি জনজীবনে। এর মধ্যেই দেশজুড়ে চলছে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন। স্লোগান ও বিক্ষোভে উত্তাল শতাধিক নগরী। সামাল দিতে পারছে না সরকার। সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে জাতীয় নেতৃত্বহীনতা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি ও সামরিক শক্তির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। অপ্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি। আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধান ও খবরদারিতে সিদ্ধহস্ত। এ দেশ এখন হিমশিম খাচ্ছে অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসনে। এ সংকট ত্রিমাতৃক।
১. পুলিশি নির্যাতন ও বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভ : মিনেসোটায় গত ২৫ মে, একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ মামুলি ঘটনায় জর্জ ফ্লয়েড নামে একজন কৃষ্ণাঙ্গকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ঘটনায় হত্যাকারী ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তি এবং প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ অবসানের দাবিতে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ চলছে। শুরুতে নিউইয়র্কসহ অনেক শহরে সহিংস রূপ ধারণ করে বিক্ষোভ। অবাধ লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে মেতে ওঠে অনেক সুযোগসন্ধানী। এসব সামাল দিতে বিভিন্ন শহরে জারি করা হয় কারফিউ। পুলিশের পাশাপাশি রাস্তায় নেমেছে ন্যাশনাল গার্ড। সহিংসতা ও আইন অমান্য করায় গ্রেফতার করা হয়েছে ১০ সহস্রাধিক বিক্ষোভকারীকে। অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের ইতিমধ্যেই গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। তারপরও থামেনি আন্দোলন। টানা দুই সপ্তাহ ধরে দিন-রাত বিরামহীন চলছে বিক্ষোভ। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ স্লোগানে মুখর রাজপথ। ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, পেশা নির্বিশেষে বিবেক সম্পন্ন মানুষ নৈতিক সমর্থন জানিয়েছেন আন্দোলনে। সাদা পুলিশের হাতে কালো মানুষের মৃত্যুর ঘটনা নতুন কিছু নয়। অতীতে এসব নিয়ে অনেক আন্দোলনও হয়েছে। কিন্তু জর্জ ফ্লয়েড খুনের ঘটনায় সৃষ্ট আন্দোলন নজিরবিহীন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, জর্জ ডব্লিউ বুশ, বিল ক্লিনটন ও জিমি কার্টার এ আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। একজন আফ্রিকান-আমেরিকান ফ্লয়েড খুনের ঘটনাই কি আন্দোলনকে এতটা বেগবান করেছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে উঠে এসেছে নাগরিক হতাশার কথা। বিগত তিন বছরে ট্রাম্পের অপশাসনে হাঁপিয়ে ওঠা জনগণ নিঃশ্বাস ফেলতে চায়। তারা বড় বেশি ক্লান্ত-ক্ষুব্ধ। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ট্রাম্প তাদের ঠেলে দিয়েছেন খাদের কিনারে। সীমাহীন অনিশ্চিয়তা ও ঝুঁঁকির মধ্যে। এসব পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, অপ্রাপ্তি ও যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বর্ণবাদী আন্দোলনে। দীর্ঘ লকডাউনে বন্দী মানুষ কিছুটা স্বস্তি খুঁজছেন রাস্তার বিক্ষোভে। বিক্ষোভকারীরা বয়সে তরুণ। জাতি, ধর্ম, বর্ণের বাছ-বিচার নেই তাদের মাঝে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলে যাচ্ছে আন্দোলনের বর্ণবাদী চরিত্র।
২. করোনা মহামারী সংকট : মহামারী করোনায় আক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্র। লাশে লাশে সয়লাব হাসপাতাল নার্সিং হোম। দেশটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমাধিক্ষেত্র। সরকারি হিসাবেই মৃতের সংখ্যা এক লাখ ১৫ হাজার। একজন মৃত ব্যক্তি মানে একটি পরিবার। ঘরে ঘরে শোকের মাতম। প্রকৃত মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। আক্রান্ত হয়েছেন ২০ লক্ষাধিক। এখনো প্রতিদিন মরছে মানুষ। অথচ সংক্রমণের শুরুতে ট্রাম্প প্রশাসন সচেতন হলে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হতো। এমনটি মনে করছে অভিজ্ঞ মহল। করোনার ভয়াবহতার বিষয়টি মোটেও আমলে নেননি ট্রাম্প। উল্টো করোনা নিয়ে বাহাস করেছেন তিনি। এমন বিপজ্জনক একজন নেতার হাতে নাগরিকদের জানমাল নিরাপদ নয়।
৩. জাতীয় নেতৃত্বহীনতার সংকট : গোটা বিশ্বই এখন ভুগছে নেতৃত্ব শূন্যতায়। রাজনৈতিক নেতার ছড়াছড়ি থাকলেও দেশে দেশে প্রকট হয়ে উঠেছে জাতীয় নেতৃত্বের অভাব। যুক্তরাষ্ট্রও এর বাইরে নয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টই প্রথানুযায়ী এ দেশের জাতীয় নেতা। যিনি শপথ নেন ৩৩ কোটি নাগরিককে একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। ক্ষমতার অপব্যবহার দেখে মনে হয় না সংবিধান, নিজ দায়িত্ব ও এখতিয়ার সম্পর্কে ট্রাম্পের ন্যূনতম কোনো ধারণা আছে। সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের প্রতি বৈরী আচরণের জন্য বরাবরই নিন্দিত তিনি। মিনেসোটায় হত্যাকাণ্ডের পর পরই জাতীয় নেতা হিসেবে ট্রাম্পের উচিত ছিল ফ্লয়েড পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা। অতিদ্রুত তদন্ত ও ন্যায় বিচার নিশ্চিতের নির্দেশ দেওয়া। পুলিশি নির্যাতন, আচরণ বিধি ও ফৌজদারি অপরাধ আইন সংশোধনে রাজ্য সরকারগুলোকে পরামর্শ দেওয়া। তা না করে ক্ষমতার দাপট দেখান তিনি। হুমকি দেন সেনাবাহিনী দিয়ে বিক্ষোভ ভ-ুল করার। ফলে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি চলে যায় বিক্ষোভকারীদের অনুকূলে। বেগবান হয় আন্দোলন। দাবি-দাওয়ায় যোগ হয় নতুন মাত্রা। সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাটিস ট্রাম্পকে একজন অপরিপক্ব, অদূরদর্শী ও অমানবিক নেতা বলে মন্তব্য করেন। তাকে অভিযুক্ত করেন যুক্তরাষ্ট্রকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য। বর্ণবাদ ও রাজনীতি : রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দাসত্ব প্রথার অবসান ঘটে ১৮৬৫ সালে। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন সংবিধানে ১৩তম সংশোধনী এনে কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্ত করে দেন। তারপরও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন তারা। পঞ্চাশ দশকের শেষার্ধে ড. মার্টিন লুথার কিংয়ের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘সিভিল রাইটস মুভমেন্ট’। ১৯৬৪ সালে প্রণীত ‘সিভিল রাইটস অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে কর্মস্থলে নিষিদ্ধ করা হয় বৈষম্য। কালোরাও সাদাদের মতো লাভ করে ভোটাধিকার, ন্যায় বিচার, সরকারি চাকরি, জনশিক্ষা ও রাষ্ট্রীয় গণসুবিধাসহ পাঁচটি মৌলিক অধিকার। এরপর কেটে গেছে অর্ধ শতাব্দী।
যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বদলায়নি শুধু কালোদের জীবনযাত্রা। এখনো তারা লিপ্ত অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। আর এসব নিয়ে প্রায়শই গরম হয়ে উঠছে রাজনৈতিক অঙ্গন। এবারও যেমনটি হচ্ছে। কিন্তু কেন, এর শেষই বা কোথায়? সময় এসেছে বিষয়টি খতিয়ে দেখার। বারাক ওবামাসহ চারজন সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো বর্ণবাদ কি গত তিন বছরে প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে? বারাক ওবামা তো এর আগে টানা আট বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বর্ণবাদ অবসানে তিনি কী অবদান রেখেছেন? নিজ অধিকার আদায়ে কালোদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আগামী ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্ধারিত হবে ট্রাম্পের রাজনৈতিক আয়ু। তিনি হারলে হয়তোবা ফলাফল মানতে চাইবেন না। আর জয়ী হলে আগামী দিনের ভোর হবে রাতের চেয়েও অন্ধকার। রাজনৈতিক দেউলিয়া ট্রাম্প নৈতিক মূল্যবোধ ও মূলধন দুটোই হারিয়েছেন। নাগরিকদের প্রতি তার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। নেই কোনো শ্রদ্ধাবোধ। তিনি কার্যত একজন ব্যর্থ প্রেসিডেন্ট। কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকা এখনো মহান অদ্বিতীয়।
লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ নিউইয়র্ক।
Posted ৬:৫৫ অপরাহ্ণ | শনিবার, ২০ জুন ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh