ডা. ওয়াজেদ খান : | বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০
করোনাকালে ভালো নেই ম্যানহাটানের রিক্সাচালকরা। যাত্রীর অভাবে আর্থিক অনটনে দুর্বিষহ দিন কাটছে তাদের। আগে সেন্ট্রাল পার্ক ও মিডটাউন এলাকায় ভাড়া খাটতো তিন শতাধিক পেডিক্যাব রিক্সা। করোনা মহামারির কারণে এখন দিনে চলছে মাত্র ১৫-২০টি। ভাড়া কমানো হয়েছে অর্ধেকের বেশী। তারপরও মিলছে না যাত্রী। স্বাভাবিক সময়ে সপ্তাহে ৫দিন রিক্সা চালালে তাদের নূন্যতম আয় হতো এক হাজার ডলার। এজন্য দিনে তারা কাজ করতো ৬থেকে ৮ঘন্টা। এখন সে আয় নেমে এসেছে ৩০-৪০ ডলারে। এমনকি কোন দিন তাদেরকে ঘরে ফিরতে হচ্ছে শূণ্য হাতে। নিউইয়র্ক পোস্টের এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ফলে আর্থিক দূরাবস্থা ও অনিশ্চয়তায় রয়েছে রিক্সাচালকরা। দু’পা দিয়ে চালিত তিন চাকার এ যানকে আমরা চিনি রিক্সা হিসেবে। কিন্তু নিউইয়র্ক সিটির এই যানের পরিচিতি ‘পেডিক্যাব’ নামে। আর রিক্সাচালকদের এখানে বলা হয় পেডিক্যাব ড্রাইভার। পর্যটক নগরী বলে খ্যাত নিউইয়র্ক সিটির বিশেষ আকর্ষন এই পেডিক্যাব বা রিক্সা। নিরাপদ ও আনন্দঘন সময় কাটানোর জন্য ভ্রমণ পিপাসুদের অনেকেই বেছে নেন তিন চাকার এই যান। বয়স্ক ও শিশুভেদে তিনজন যাত্রী অনায়াসে একসাথে বসতে পারেন আরামদায়ক এ রিক্সায়। সেন্ট্রাল পার্কের আনাচে কানাচে চষে বেড়াতে হলে পেডিক্যাবের জুড়ি নেই।
ম্যানহাটানে ২০০৫ সাল থেকে যাত্রী বহন করে আসছে এসব আধুনিক রিক্সা। নিউইয়র্ক সিটির মতো পেডিক্যাব চালকদেরও বিনিদ্র রাত কাটে। তারা যাত্রীবহন করে দিনরাত ২৪ঘন্টা। পেডিক্যাবের ভাড়া কতো হবে তার নির্ধারণ করে দিয়েছে সিটি কর্তৃপক্ষ। সাধারণত: প্রতিমিনিটে ভাড়া ৩ থেকে ১০ডলার। আবার ১ঘন্টার চুক্তিতে যাত্রী বহন করলে ৬০ থেকে ৬৫ ডলার ভাড়া গুণতে হয়। এছাড়া রেওয়াজ আছে ১৫থেকে ২০ শতাংশ হারে টিপস দেয়ার। যদিও তা নির্ভর করে যাত্রী সেবার মানের উপর। যাত্রীরা ক্যাশ ছাড়াও ভাড়া দিতে পারেন ডেবিটকার্ড, ক্রেডিট কার্ড, চেক, ভেনমো, জেল অথবা স্কোয়ারের মাধ্যমে। নিউইয়র্ক সিটির পাঁচ বরোর বাসিন্দারা রিক্সায় ভ্রমণের জন্য বুকিং দিতে পারেন পূর্বাহ্নেই। তবে সিটির লোকজন খুব কমই চড়েন পেডিক্যাবে। নিউইয়র্কের বাইরের রাজ্য এবং অন্যান্য দেশ থেকে আগত পর্যটকরাই মূলত ম্যানহাটানের রিক্সার যাত্রী। করোনার কারণে পর্যটকের ঢেউ নেই সিটিতে। পর্যটকের অভাবে খাঁ খাঁ করছে গোটা সিটি। আর এজন্য অন্যান্য পেশার মানুষের মতো কপাল পুড়েছে তাদের।
যে কেউ ইচ্ছে করলেই পেডিক্যাব চালাতে পারবে না। এজন্য তাদেরকে সিটির ডিপার্টমেন্ট অব কনজ্যুমার থেকে নিতে হবে লাইসেন্স। আর তারাই লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে যাদের বয়স অনুন্য ২১বছর। যাদের আছে বৈধ ড্রাইভার্স লাইসেন্স। ইংরেজীতে কথা বলতে পারে অনর্গল। অভিজ্ঞতা রয়েছে দিনে ৬ থেকে ৮ ঘন্টা করে বাইসাইকেল চালানোর। পেডিক্যাব লাইসেন্সের জন্য প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। গাড়ীর মতো রিক্সাচালকদের জন্য ইন্সুরেন্স অত্যাবশক। সাধারণত স্মার্ট এসব পেডিক্যাবচালক যাত্রীদের গাইড হিসেবে কাজ করে দর্শণীয় স্থানগুলোতে। শুধু মিডটাউন ও সেন্ট্রাল পার্ক নয়। রিক্সায় চড়ে যাত্রীরা অনায়াসে ঘুরে বেড়াতে পারেন পর্যটকদের জন্য আকর্ষনীয় সিটির বড় বড় স্থাপনা সমূহ। এসবের মধ্যে ব্রডওয়ে থিয়েটার পাড়া, টাইম স্কোয়ার, মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম, রকফেলার সেন্টার, রেডিও সিটি, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, ফিফথ এভিন্যুর বিখ্যাত বিপনি বিতান সহ অন্যান্য ল্যান্ডমার্ক সমূহ। ম্যানহাটানের রাস্তায় চলমান পেডিক্যাবগুলো তৈরী হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রেই। কলরাডোর ব্রুমফিল্ডে ইউএস পেডিক্যাব ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে।নিউইয়র্ক সিটির আগেও যুক্তরাষ্ট্রে রিক্সার প্রচলন হয় পশ্চিম উপকূলীয় ওয়াশিংটন স্টেটের সিয়াটল শহরে ১৯৬২ সালে।
রিক্সার প্রচলনের ইতিবৃত্তঃ
বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে আধুনিক যানবাহন তৈরীর অন্যতম দেশ জাপান। রিক্সার আবিষ্কারকও জাপানীরা। ১৮৬৯ সালে জাপানে প্রথম মানুষ টানা রিক্সার প্রচলন ঘটে। দু’চাকার এ যানকে বলা হতো জি-রিকি’শ। জাপানী ভাষায় জি শব্দের অর্থ হলো মানুষ। রিকি শব্দের অর্থ টানা এবং শ এর অর্থ হলো যান। অর্থাৎ মানুষ টানা যান। কলকাতা সহ ভারতের কোন কোন শহরে এখনো চালু আছে মানুষ টানা রিক্সা। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম রিক্সার প্রচলন কাশ্মীরের সিমলায়। তখন ভারতবর্ষের রাজধানী ছিলো কলকাতা। গ্রীষ্মে ব্রিটিশ শাসকরা সময় কাটাতেন সিমলায়। সেখানে বিলাস ভ্রমণের জন্য তারা প্রথম ব্যবহার করেন মানুষ টানা রিক্সা। পরবর্তীতে ১৯১৪ সালে কলকাতায় ভাড়া খাটার কাজে বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয় রিক্সার। কালক্রমে রিক্সা প্রস্তুতিতে আসে পরিবর্তন। মানুষের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় তৃতীয় চাকা। রিক্সা উন্নত হয়েছে অটো রিক্সায়। সম্প্রতি রিক্সার উন্নত সংস্করণ পরিলক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশে। ঢাকা নগরীর বাইরে অধিকাংশ রিক্সা চালককে এখন আর প্যাডেল মারতে হয় না। ব্যাটারী চালিত রিক্সায় পা ভাঁজ করে বসে থাকে চালকরা। তারপরও দেশে দেশে বিরামহীন ঘুরছে তিন চাকার এ যান।
কলকাতার রিক্সার রয়েছে অতীত ঐতিহ্য। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা শহরের রিক্সাকে উপজীব্য করে সৃষ্টি হয়েছে নাটক-সিনেমা ও উপনাস্যের অনেক কাহিনী। বিখ্যাত ফরাসী লেখক দোমানিক ল্যাপিয়ের উপন্যাস ‘সিটি অব জয়’ বা আনন্দ নগরী। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত উপন্যাসটি নিয়ে পরবর্তীতে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯৯২ সালে। সাড়া জাগানো এ উপন্যাসের মূল চরিত্রে আছেন হাশারি নামের এক ব্যক্তি যিনি কলকাতার বস্তির একজন রিক্সাচালক।কলকাতায় রিক্সার প্রচলনের পর কালক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে ভারত বর্ষের বিভিন্ন শহরে। এখন ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনস, থাইল্যান্ড সহ বিভিন্ন দেশে প্রচলন আছে রিক্সার। অনেক দেশে রিক্সা দরিদ্র মানুষের জীবিকা নির্বাহের উপায়। আবার এই রিক্সা উন্নত দেশগুলোতে সীমিত আকারে চলছে মানুষের আনন্দ বিলাসের জন্য। যেমনটি চলছে ম্যানহাটানের রাস্তায় পেডিক্যাব নামে।
ম্যানহাটানের পেডিক্যাব ও বাংলাদেশের রিক্সার মধ্যে কাঠামো ও গুণগত পার্থক্য রয়েছে। ব্যবধান এবং বৈষম্য রয়েছে এসবের চালকদের মাঝে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে বলা হয় রিক্সার শহর। বিশ্বের কোন শহরেই এতো রিক্সা চলে না। ধারণা করা হয় ঢাকায় নাকি পাঁচ লক্ষাধিক রিক্সা চলাচল করে। আমাদের দেশের হতদরিদ্র মানুষ তিন চাকার এই যানে সাধারণত বহন করে দু’জন যাত্রী। বাংলাদেশে রিক্সার লাইসেন্স প্রয়োজন হয়। কিন্তু চালকের লাইসেন্স থাকার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। হালে সাধারণ মানুষ রিক্সায় সোয়ারী হচ্ছে। অথচ একসময় এই রিক্সাই ব্যবহৃত হত রাজা-রানীদের বিলাস ভ্রমণের জন্য।
Posted ৯:৫১ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh