| বৃহস্পতিবার, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২
তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তরুণদের মত বাংলাদেশের তরুণদের কাছেও ইউরোপ-আমেরিকা স্বপ্নের দেশ। যেকোনো উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করে ঝুঁকিপূর্ণ দুর্গম পার্বত্য পথ, শ্বাপদসঙ্কুল বনজঙ্গল, উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে স্বপ্নের দেশগুলোতে পৌছার বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে যে জীবন যেতে পারে, সে ব্যাপারেও তারা নির্বিকার। অবৈধ উপায়ে দালালের হাত ধরে ইউরোপ আমেরিকায় যাওয়ার পথে বহু বাংলাদেশীর মৃত্যুর খবর আগেও এসেছে এবং শেষবার এলো গত ২৫ জানুয়ারি। লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইটালি যাওয়ার পথে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় সাত বাংলাদেশির মারা গেছে। জানা যায় ২৮০ জন অভিবাসন প্রত্যাশীকে বহনকারী একটি নৌকা বিপজ্জনকভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপের দিকে যাওয়ার সময় তাদের মৃত্যু ঘটে।
কর্মসংস্থানের জন্য বৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ ক্রমেই সীমিত হয়ে আসছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছাড়াও মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, মালদ্বীপ, ব্রুনেই এর শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি শ্রমিকদের যে পরিমাণ বেতন দেওয়া হয় তাতে শ্রমিকরা যে ব্যয় করে ওইসব দেশে পাড়ি জমায় তিন-চার বছর হাড়ভাঙা খাটুনির পরও তারা সেই খরচ উঠাতে পারে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তরুণরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়। আফ্রিকার দেশগুলোতেও অসংখ্য বাংলাদেশী পাড়ি জমিয়েছে এবং আফ্রিকা থেকে ইউরোপ আমেরিকার পথ ধরছে এমন দৃষ্টান্তও অনেক। প্রতিটি অবৈধ উপায়ই ঝুঁকিপূর্ণ এবং জীবন হারানোর আশঙ্কা পদে পদে। সরকার হরহামেশাই দেশের উন্নতির কথা বলে, দেশ ইতোমধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে এমন দাবী তো করেই, আগামী এক দশকের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌছে যাবে এমন দাবী করতেও দ্বিধা করে না। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো বাংলাদেশ এখনো স্বপ্লোন্নত দেশ হিসেবেই রয়ে গেছে এবং এই তকমা ঘোচাতে বাংলাদেশকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। তাছাড়া কর্মসংস্থানের আশায় হোক, উন্নত জীবনের আশায় হোক, বাংলাদেশের তরুণদের বিদেশমুখী স্রোত কিছুতেই প্রমাণ করে না যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির লক্ষ্যণীয় কোনো উন্নতি হয়েছে। কিছু লোকের পকেট ভারি করা এবং অবকাঠামোগত কিছু উন্নতি ঘটলেও ব্যাপক জনমানুষের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিণতি হয়নি। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে গত এক দশকে ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধ পথে যেসব দেশের তরুণরা গেছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশীদের স্থান দশম, কিন্তু ২০২১ সালে বাংলাদেশীদের স্থান ছিল প্রথমে এবং তখন ইউরোপ পৌছে গ্রেফতার হয়েছিল ৩,৩৩২ জন তরুণ।
গতমাসে সাত বাংলাদেশীর মৃত্যুর ঘটনা ভূমধ্যসাগরে পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার পথে ঘটা একমাত্র ঘটনা নয়। এর আগেও গতবছর জুন মাসে তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকাডুবিতে ১৭ বাংলাদেশীর মৃত্যু ঘটেছে। গতবছরের জুলাই মাসেও ভূমধ্যসাগরে ইটালি গমনেচ্ছুদের নৌকা ডুবে যে ৪৩ জনের মৃত্যু ঘটে তার বেশির ভাগই বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন বলে জানিয়েছিল তিউনিসিয়ার রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। এছাড়াও লিবিয়া ও তিউনিসিয়ার উপকুল রক্ষীরা গতবছরের জুন মাসে এবং জুলাই মাসে ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া বিভিন্ন নৌকা থেকে অন্যান্য দেশের নাগরিকদের সাথে ৮০০ শতাধিক বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছেন। উদ্ধারপ্রাপ্তদের গন্তব্য ইউরোপ হয়নি, তিউনিসিয়া ও লিবিয়ার সরকার তাদের বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার পথে বাংলাদেশের অভিবাসন প্রত্যাশি মানুষের প্রাণহানির মত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা রোধে কর্তৃপক্ষের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরী হয়ে পড়েছে। সরকার যে কঠোর পদক্ষেপ নেয়নি তা নয়, কিন্তু তাগিদ যেখানে বেশি সেখানে আইনি ফাঁকফোকড় ও প্রশাসনিক নজরদারি এড়িয়ে দেশ ছাড়ার হিড়িক থামাতে পারছে না সরকার। মানবপাচারকারী চক্রগুলোকে দমন করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বার বার এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। এসব অকাল মৃত্যুর জন্য দায়ী তা নিয়ে জনমনে বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
Posted ৯:০৯ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh