ডা. ওয়াজেদ খান : | বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪
ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান সাংবিধানিক ধারা মেনে ঘটেনি। জনগণ পতন ঘটিয়েছে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার। অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগষ্ট দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর পদ তাকে ত্যাগ করেছে এটাই বাস্তবতা। ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে নতুন অন্তবর্তীকালীন সরকার। নানাবিধ প্রতিকূলতার মাঝে আড়াই মাস কাটলো তাদের। তারপরও হাসিনার পদত্যাগপত্র কী খুব জরুরী? হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন উৎকন্ঠিত দেশবাসীকে এমন সুখবর দেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ্জামান।
৫ আগষ্ট দুপুরেই তিনি নিশ্চিত করেন স্বৈরাচার পতনের বিষয়টি। সেদিন রাত ১১টা ২০মিনিটে বঙ্গভবনে তিন বাহিনীর প্রধানের উপস্থিতিতে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু পুনরাবৃত্তি করেন হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি। পরে জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেন। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত গ্রহণ করেন চুপ্পু। আদালতের সম্মতিতেই ৮ আগষ্ট গঠন করা হয় ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন সরকার। একটি মহল অন্তবর্তীকালীন সরকারের বৈধতা নিয়ে তারপরও প্রশ্ন তুলছেন। কথা চালাচালি করছেন হাসিনার পদত্যাগের সত্যতা নিয়ে। এমন একটি পর্যায়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার আমলে নিপীড়নের শিকার খ্যাতিমান সাংবাদিক মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমানকে রাষ্ট্রপতি জানান-‘হাসিনার পদত্যাগপত্রের দালিলিক কোন প্রমাণ নেই।’
জনতার চোখ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সংবাদটি মুহুর্তেই ভাইরাল হয় সোস্যাল মিডিয়ায়। পরিণত হয় টক অব দ্যা কান্ট্রিতে। রাষ্ট্রপতি চুপ্পুর এমন মন্তব্যে ব্যাপক সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় উঠে দেশজুড়ে। তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন অন্তবর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ডঃ আসিফ নজরুল। চুপ্পুর মন্তব্যকে তিনি মিথ্যাচার এবং রাষ্ট্রপতির শপথ লংঘনের শামিল বলে অভিহিত করেন। শুধু তাই নয় তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন রাষ্ট্রপতি পদ ধরে রাখার ক্ষেত্রে তার যোগ্যতা নিয়ে। আইন উপদেষ্টা রাষ্টপতিকে স্মরন করিয়ে দেন জাতির উদ্দেশ্যে তার প্রদত্ত ভাষণের কথা।
তিনি চুপ্পুর স্ববিরোধীতাকে রাষ্ট্রীয় অসদাচরণ, এমনকি তার মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিষয়টি তিনি উপদেষ্টামন্ডলীর সভায় উত্থাপনের ঘোষণা দেয়ায় মুখ খুলেছেন চুপ্পু। রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে শেখ হাসিনার পদত্যাগ একটি মীমাংসিত বিষয় বলে এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রশ্ন হলো রাষ্ট্রপতি চুপ্পুর আহ্বানেই কি সব বিতর্কের অবসান ঘটবে। রাষ্ট্রের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত থেকে এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে তার মন্তব্য কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। চুপ্পু কোনভাবেই চুপ রাখতে পারেননি নিজেকে। ধর্মের কল যেমন বাতাসে নড়ে উঠে চুপ্পুও নিজের অজান্তেই এমন আওয়াজ দিয়েছেন।
দেশে প্রতিবিপ্লব আসন্ন। পতিত স্বৈরাচার আবার ফিরছে। বিভিন্ন স্থানে ফ্যাসিবাদের দোসররা চেষ্টা করছে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে। হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির পর একধরণের অস্থিরতা বিরাজ করছে ফ্যাসিস্ট শক্তির মাঝে। প্রবাসী সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখছে তারা। চ্প্পুু হয়তো বা সে স্বপ্নে বিভোর হয়েই এমন কথা বলেছেন। চুপ্পুকে বঙ্গভবনে বসিয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকারের পক্ষে নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে রাষ্ট্র পরিচালনা করা সহজ হবে না। রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তাও রক্ষিত হবে না তার দ্বারা। পতিত হাসিনার অতিশয় অনুগত ও সার্টিফাইড দুর্নীতিবাজ চুপ্পুকে যত দ্রুত সরিয়ে দেয়া যাবে রাষ্ট্রের জন্য ততই হবে তা মঙ্গলজনক।
হাসিনা পলায়নের আগে পদত্যাগ করেছেন কি, করেন নাই গণঅভ্যুত্থানের পর নুতন বাংলাদেশে এটা কোন আলোচ্য বিষয় নয়। দেশের জনগণ বিতাড়িত করেছে তাকে। জুলাই আগষ্টের গণঅভ্যুত্থান সংবিধান মেনে হয়নি। নতুন সরকার, নতুন সংবিধান, নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্যই হয় অভ্যুত্থান-বিল্পব। এখানে অন্তবর্তীকালীন সরকারের সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্ন অবান্তর। যারা এখন সংবিধান ও বৈধতার প্রশ্ন তুলেছেন তারা এতো বছর কোথায় ছিলেন? একটি অনির্বাচিত, অবৈধ মাফিয়া চক্র যখন দেড় দশক ধরে দেশকে একটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে তখন তাদের কোন উদ্বেগ ছিলো না। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ন্যায় বিচার, মানবিক মর্যাদা সবকিছু লংঘন করে হাসিনা এতোদিন বজায় রেখেছেন অবৈধ শাসন। দেশের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুটপাটকারীদের হয়নি শেষ রক্ষা। গণঅভ্যুত্থানের পর দেশ ছেড়ে দলে দলে পালিয়েছে তারা। ফ্যাসিবাদের নেত্রী হাসিনা দলের নেতাকর্মীদের এতিম বানিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। নেতাদের অনেকে ভারতের এতিমখানায় নাম লিখাচ্ছে এখন। আর সেখানে বসে চেষ্টা করছে কলকাঠি নাড়ার।
হাসিনা গণহত্যার আসামী। মূল পরিকল্পনাকারী। হাসিনা পারেন না এমন কোন অপকর্ম নেই। ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অর্থপাচার, গুম, অপহরণ সবধরণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। হাসিনা ৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীণ চট্টগ্রামে এক সমাবেশে একটি লাশের পরিবর্তে দশটি লাশ ফেলার হুকুম দেন। হাসিনার এক সময়ের ঘনিষ্ট ও বিশ্বস্থ সহচর মতিয়ুর রহমান রিন্টু “আমার ফাঁসি চাই’ বইয়ে হাসিনা যে বস্তাভরা টাকা গ্রহণে অভ্যস্থ এমন উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এছাড়া বেফাঁস কথা বলার অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী থাকাবস্থায় উচ্চ আদালত তাকে মানসিক বিকারগ্রস্থ বলে মন্তব্য করেন। ওয়ান ইলেভেন সরকার শেখ হাসিনাকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক ব্যক্তি ঘোষণা করে। ২০০৭ সালের ২৩ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রেসনোট জারি করে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়। যাতে তিনি বিদেশী কোন বিমানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে ফিরতে না পারেন। পরবর্তীতে একই বছর জুলাই মাসে চাঁদাবাজি ও ঘুষ গ্রহণ সহ ডজনখানেক মামলায় গ্রেফতার করা হয় তাকে। এসবই ছিলো তখনকার সময়ের ঘটনাবলী। গণঅভ্যুত্থানে চিরতরে পালিয়েছেন হাসিনা। এবারের টিকিট তার ওয়ানওয়ের।
“বঙ্গবন্ধু কন্যা পালায় না” বলে দলীয় নেতাকর্মীদের ধোঁকা দিয়ে নিজের জীবন বাঁচিয়েছেন তিনি। পলাতক স্বৈরাচার কখনোই নিজ দেশে ফিরতে পারে না। হাসিনাও পারবেন না। এপ্রসঙ্গে একটি জনপ্রিয় গান-“আমায় ডেকোনা ফেরানো যাবে না; ফেরারী পাখীরা কুলায় ফেরেনা-এর মর্ডান প্যারালাল-হাসিনাকে ডেকোনা ফেরানো যাবে না, পলাতক স্বৈরাচার দেশে ফেরে না।” শেখ হাসিনা এখন শেষ হাসিনা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষয়িত একটি নাম। তার শাসনামল ছিলো একটি কলংকিত অধ্যায়। প্রাকৃতিক নিয়মেই এর যবনিকাপাত ঘটেছে। নতুন বাংলাদেশে চুপ্পুরা বিষয়টি আমলে নিয়ে সতর্ক হয়ে যাবেন এমন প্রত্যাশাই দেশবাসীর।
Posted ১২:৫৫ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh