বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩
নিউজার্সিতে বসবাসরত সাবেক ছাত্রনেতা, বিশিষ্ট সংগঠক, রাজনীতিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিকুর রহমান সালু আর নেই (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। ৫ ডিসেম্বর মঙ্গলবার ভোর পৌনে ৫টার দিকে নিউজার্সির একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যা, নাতিসহ বহু আত্নীয়-স্বজন, গুণগ্রাহী ও অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী-ভক্ত রেখে গেছেন। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর খবরে বাংলাদেশি কমিউনিটির পরিচিত মহলে শোকের ছায়া নেমে আসে।
আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির চেয়ারম্যান ও ফোবানা’র সাবেক চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান সালুর চলতি বছরের মাঝামাঝি শরীরে মরণব্যাধি ক্যান্সার রোগ ধরা পড়ে। এরপর থেকেই তার চিকিৎসা চলছিল এবং তিনি চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়মতি কেমো নিচ্ছিলেন। গত সপ্তাহে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে ৩০ নভেম্বর শনিবার তাকে নিউজার্সির প্যাসাইক সিটির একটি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মূলতঃ তিনি লাইফ সাপোর্টেই ছিলেন।
আতিকুর রহমান সালুর বিদেহী আত্নার মাফফেরাত কামনায় পরিবারের পক্ষ থেকে দেশবাসী ও সকল প্রবাসী বাংলাদেশির দোয়া কামনা করা হয়েছে। ৫ ডিসেম্বর মঙ্গলবার মাগরিবের নামাজের পর জামাইকা মুসলিম সেন্টারে মরহুমের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন ইমাম মির্জা আবু জাফর বেগ। এসময় মরহুম আতিকুর রহমান সালু সম্পর্কে কথা বলেন ডা. মোহাম্মদ বিল্লাহ, হামিদ রেজা খান, মোহাম্মদ হোসেন খান, জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের প্রেসিডেন্ট ডা. মো. সিদ্দিকুর রহমান ও সেক্রেটারি আফতাব মান্নান।
এদিকে ৬ ডিসেম্বর বুধবার নিউজার্সির প্যাটারসনে আরেকটি জানাজার নামাজ শেষে জালালাবাদ কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
আতিকুর রহমান সালু’র জন্ম টাঙ্গাইলে ১৯৪৮ সালে। শৈশব ছাড়িয়ে কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে দূরন্তপনায়। হাইস্কুলের শেষ প্রান্তে নিউ ক্লাশ টেনে পড়াকালে সমগ্র হাই স্কুলের জেনারেল ক্যাপ্টেন এবং পরবর্তীকালে মধ্য ষাট দশকে টাঙ্গাইল জেলার ঐতিহ্যবাহী করটিয়া কলেজ (বর্তমানে সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ) ছাত্র সংসদের এজিএস এবং সেখান থেকে গ্র্যাজুয়েশন ও পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ও পরবর্তীতে আইনে ডিগ্রি লাভ। এর মাঝে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৯ সনের টাঙ্গাইলের প্রতিটি ছাত্র আন্দোলনে তথা ঢাকাসহ তৎকালীন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী ছাত্র-গণ আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান ও কারাবরণ। ক্রমান্বয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন টাঙ্গাইল মহুকুমা-তথা টাঙ্গাইল জেলার সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি পদ ও পরবর্তীকালে অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরবর্তীকালে সংগঠনের (মেনন গ্রুপ) সাংগঠনিক সম্পাদক, পর্যায়ক্রমে পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন তথা বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির পদ অলংকৃত করেন।
এখানে উল্লেখ্য, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের মূল স্লোগান ছিলো ‘মেহনতী জনতার সাথে একাত্ম হও’, এই মূলমত্রে দিক্ষিত হয়ে আতিকুর রহমান সালু শ্রমিক রাজনীতির সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন। একসময় তিনি তৎকালীন টাঙ্গাইল মহুকুমা প্রেস কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। ১৯৬৯ সনের ১১ দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সর্ব দলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় কখনো কখনো করেছেন প্রতিনিধিত্ব। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত সিঁড়ি বেয়ে, ১৯৬৯ এর সুমহান গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ছিলেন অন্যতম সংগঠক। মূলত কবি সালু ছিলেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কর্মী। সেখান থেকে ক্রমে ক্রমে ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ততা।
১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত লক্ষ লোকের সমাবেশে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েমের প্রস্তাব হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পাঠ করেন সংগঠনের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক আতিকুর রহমান সালু। অনেক আত্নত্যাগ ও লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশ, আমাদের সুমহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা অসামান্য। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতে অন্তরীণ মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি করে বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি নামে যে কমিটি গঠিত হয় তিনি ছিলেন সেই কমিটিরও কেন্দ্রীয় সদস্য। বিভিন্ন সময় পট পরিবর্তনের হাওয়াতেও আতিকুর রহমান সালু আদর্শচ্যুত হননি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা ও ফারাক্কা লংমার্চের মহানায়ক মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সান্নিধ্যে থেকে দেশ ও জনগণের জন্যে নির্লোভভাবে কাজ করে গেছেন। ১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চে অংশ গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে ২০০৫ সালের ৪ মার্চ আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির উদ্যোগে উজানে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের প্রতিবাদে ও আমাদের নদী পানির অধিকার রক্ষা ও আদায়ের জন্য কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে অনুষ্ঠিত লং মার্চেও অন্যদের সাথে নিয়ে নেতৃত্ব প্রদান করেন, যেখানে ৫ লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটে। তিনি আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।
আতিকুর রহমান সালু দেশ, জাতি ও জনগণের কল্যাণের জন্য, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পতাকা সমুন্নত রাখার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যান। তিনি একদিকে কবি, গীতিকার, সুরকার, লেখক, অ্যাক্টিভিস্ট ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। ’৬০-এর দশক থেকে সমানতালে চলে তার নিরব কাব্য চর্চা। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আনিকার জন্য কবিতা’। আনিকা ছিলো আতিকুর রহমান সালুর ছোট মেয়ে। ২০০৬ সালের ৩০ মে আমেরিকার ভার্জিনিয়ায় এক গাড়ী দূর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে মারা যান। ‘অন্য রকম কবিতা’ আতিকুর রহমান সালুর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ।
বাংলাদেশ সোসাইটির শোক : নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশিদের আমব্রেলা সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান সালুর মৃত্যুতে সোসাইটির কার্যকরী পরিষদ, ট্রাস্টি বোর্ড ও নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা গভীর শোক এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
এক শোকবার্তায় সোসাইটির সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুর রব মিয়া, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রুহুল আমিন সিদ্দিকী, ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিজ এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার জামাল উদ্দিন জনি মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং সকল প্রবাসীর কাছে দোয়া চান।
Posted ১:০৪ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh