ডা. ওয়াজেদ খান : | বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫
বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির চেয়ারপার্সন। কোটি কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় এই নেত্রী আজ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক অসুস্থতা তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর মোহনায়। তিনি এখন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। তার অবস্থা মুমূর্ষ। তিনি আজ বড় বেশী অসহায়। অসুখ মানেই সুখ নেই। তার অসুখ নিয়ে উদ্বেগ উৎকন্ঠায় প্রহর কাটছে দেশবাসীর।
খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া চাইছেন তারা। দলমত নির্বিশেষে দাঁড়িয়েছেন তার পাশে। একাশি’র ৩০ মে’র পর গোটা বাংলাদেশ যেমন দাঁড়িয়েছিল তার শহীদ স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কফিনের সামনে। খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে অনন্য ইতিহাস সৃষ্টিকারী একটি নাম। আমরা তাকে যেভাবেই দেখিনা কেন, ডানে ঝুঁকে কিংবা বায়ে বেঁকে সবদিক থেকেই তিনি এক এবং অতুলনীয়। জেল-জুলুম নির্যাতন নীপিড়ন কখনো অবদমিত করতে পারেনি তাকে। নিজ দল বিএনপিকে তিনি ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষা করেছেন বারকয়েক। শুধু তাই নয় একাধিকবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন দলটিকে। খালেদা জিয়া তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে নিবিড় আত্নিক সম্পর্ক গড়ে তুলেন দেশ ও দেশের মানুষের সাথে।
যে কারণে ওয়ান ইলেভেনের মতো চরম দুর্দিনেও দেশ ছাড়তে রাজি হননি তিনি। আশির দশকের প্রথমার্ধে বিএনপির হাল ধরে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে দাঁড় করান সুদৃঢ় ভিত্তির উপর। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধকে অবিভাজ্য সম্মিলনের মধ্য দিয়ে তিনি এগিয়ে নিয়ে যান বিএনপিকে। খালেদা জিয়ার নেতৃেত্ব ঘটে অসাধারণ ঘটনা। রাজনীতিতে তিনি ধারাবাহিকভাবে ধরে রাখেন সফলতা। সংগঠিত করেন জনগণকে। তিনি নিজে স্বপ্ন দেখেন এবং স্বপ্ন দেখান তার অনুগামীদেরকে। নেতাকর্মীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে নেতৃত্ব দেন এরশাদ বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ছিল জিয়ার কালজয়ী দর্শন। এই দর্শনকে সামনে রেখে খালেদা জিয়া জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বাতিঘর হিসেবে আর্বিভূত হন।

খালেদা জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির চেয়ারপার্সন টানা ৪২ বছর ধরে। জাতীয় রাজনীতিতে ১৯৮২ সাল থেকে ২০২৫ সাল দীর্ঘ চার দশকেরও অধিক সময়কালের সাক্ষী তিনি। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে খালেদা জিয়া আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার নেতৃত্ব। বিএনপির নেতা কর্মীদের চোখে খালেদা জিয়া একজন আপসহীন দেশনেত্রী। দল ও সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে বহুবার তিনি মোকাবিলা করেছেন চরম সংকট ও ক্রান্তিকাল। যদিও রাজনীতিতে তার অভিষেক সাধারণ গৃহবধূ থেকে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বরণের পর পাল্টে যায় খালেদা জিয়ার জীবন ধারা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি বাধ্য হন বিএনপির হাল ধরতে। আনুষ্ঠানিকভাবে দলটির সদস্যপদ গ্রহন করেন ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি। চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন ১৯৮৪ সালের ১০মে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ৭বার গৃহবন্দী হন খালেদা জিয়া। ওয়ান-ইলেভেন ও হাসিনার আমলে মিথ্যে মামলায় দু’বার গ্রেফতার হয়ে কারাবাস করেন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর কারামুক্ত হন তিনি।
খালেদা জিয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরাবরই ছিলেন অপরাজেয়। চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ৬টি জেলা থেকে ১৮টি আসনে নির্বাচন করে জয়ী হন সবকটি আসনেই। ১৯৯১ সালে পঞ্চম, ‘৯৬ সালের জুনে সপ্তম এবং ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ৫টি করে আসনে জয়লাভ করেন তিনি। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৩টি আসনে প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হন খালেদা জিয়া। এই নির্বাচনে প্রথমবারের মতো একজনের প্রার্থীতা সীমিত করা হয় তিনটি আসনে। অপরদিকে শেখ হাসিনা ১৯৯১ সালে দু’টি এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে একটি আসনে পরাজিত হন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এভাবেই সবাইকে ছাড়িয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌছান খালেদা জিয়া। জাতীয় নেতৃত্বের আসনে সুদৃঢ় করেন তার অবস্থান ও ভাবমূর্তি। ২০১৮ সালে কারান্তরীন হওয়ার পর খালেদা জিয়া নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন রাজনীতিতে। এমতাবস্থায় পুত্র তারেক রহমান দায়িত্ব নেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মোড় ঘুরে যায় দেশের রাজনীতির। শুরু হয় আওয়ামী দুঃশাসন। জিয়া পরিবার ও বিএনপি’র ঘাড়ে চেপে বসে স্বৈরশাসনের দৈত্য। গুম, খুন, অপহরণ ও মিথ্যে মামলা হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বিএনপির রাজনীতির ভিত। বড় সন্তানের নির্বাসন এবং ছোট সন্ত্রানের মৃত্যু শোকে মুহ্যমান খালেদা জিয়া চেষ্টা করেন ঘুরে দাঁড়াতে। তার আগেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা তাকে মিথ্যে মামলায় নিক্ষেপ করেন কারাগারে। এর মাঝেই ঘাতক ব্যাধি বাসা বাঁধে তার দেহে। বারবার অনুমতি চেয়েও সুযোগ মিলেনি বিদেশে চিকিৎসার। আজকে তার এই বিপন্ন প্রায় জীবনের জন্য দায় নিতে হবে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকেও। আপসকামী হলে খালেদা জিয়া হয়তো অনেক বিপদ এড়াতে পারতেন। নির্বিঘ্ন হতো তার জীবন চলার পথ। কিন্তু দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সে পথে হাঁটেননি তিনি। অনন্য নেতৃত্বের গুনাবলীই আজকে তাকে আসীন করেছে মহীয়সী নারীর আসনে।
অশীতিপর খালেদা জিয়া দীর্ঘস্থায়ী গুরুতর শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। অন্যান্য জটিলতার পাশাপাশি সম্প্রতি সংক্রমন ছড়িয়ে পড়েছে তার হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসে। ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসকরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছেন তাকে। তার দেহের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অঙ্গ মারাত্নকভাবে আক্রান্ত ঘাতক ব্যাধিতে। বিশেষ করে লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, ফুসফুস ও কিডনীর সমস্যা, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস ও বার্ধক্যজনিত জটিলতা। কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন তিনি। এসব কারণে বারবার তাকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে হাসপাতালে।
অন্যের সাহায্য ছাড়া স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছেন না তিনি। তাকে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে ফেলে লিভার সিরোসিস। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রয়োজন ছিলো তার দেহে স্থায়ী লিভার প্রতিস্থাপন। বাংলাদেশে এই চিকিৎসা সুযোগ না থাকায় প্রয়োজন ছিলো তাকে বিদেশে নেয়ার। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময় তাকে লন্ডন নেয়া হলেও বয়স এবং অন্যান্য জটিলতার কারণে লিভার প্রতিস্থাপন সম্ভব হয়নি। গত ৭ জানুয়ারি থেকে ৫ মে পর্যন্ত লন্ডনে ছিলেন তিনি। হার্টের মারাত্নক সমস্যায়ও ভুগছেন খালেদা জিয়া। ২০২৪ সালের জুনে পেসমেকার সংযোজন করা হয়েছে তার হার্টে। ইলেক্ট্রোনিক এই ডিভাইসটি তার হৃদকম্পন স্বাাভাবিক রাখছে। তার হার্টের তিনটি ব্লকের মধ্যে একটিতে রিং পরানো আছে। দীর্ঘস্থায়ী আথ্রাইটিস সম্প্রতি ভয়াবহ জাটিলতা সৃষ্টি করেছে তার দু’হাতে। দীর্ঘস্থায়ী আথ্রাইটিস সম্প্রতি ভয়াবহ জাটিলতা সৃষ্টি করেছে তার দু’হাতে। গত ২১ নভেম্বর সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে তার দু’হাতের অস্বাভাবিক স্ফীতি ও বিকল অবস্থা দেখে শিউড়ে উঠেছেন প্রত্যক্ষদর্শী অতিথিগণ।
রাজনীতিতে আসার পূর্বে খালেদা জিয়া ছিলেন অনেকটাই নিভৃতচারী। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে স্বামীর সাহচর্য ছাড়া কোথাও দেখা যেতো না তাকে। জিয়ার শাহাদাত বরণের পর দু’সন্তান নিয়ে কঠিন দুঃসময় পাড় করেন তিনি। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বের আসন যারা অলংকৃত করেছেন তিনি তাদের অন্যতম। খালেদা জিয়াই বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯৩ সালে সার্কের প্রথম মহিলা চেয়ারপার্সনও নির্বাচিত হন তিনি।
বাকসংযমী ও রাজনৈতিকভাবে দূরদর্শী খালেদা জিয়া মানুষের কথা শুনেন আগ্রহভরে। খালেদা জিয়ার আত্নবিশ্বাস, আকষর্নীয় ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাধারা অগণিত মানুষের আস্থাভাজন করে তুলে তাকে। একাত্তুরে ২৫মার্চ থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশের বহু ঘটনার নীরব সাক্ষী তিনি। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা প্রেসিডেন্ট থেকে প্রধানমন্ত্রী শাষিত এবং বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যায়। এমন একজন নেত্রীকে তার ৩৭ বছরের ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে নির্মমভাবে উচ্ছেদ করা হয় সপরিবারে।
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে এই কাজ করেন শেখ হািসনা। দল এবং সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি যে ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে ছিলেন এমনটি নয়। অনেক সীমাবদ্ধতাও ছিলো তার জীবন ও কর্মে। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জয়িাউর রহমান পারবিারকি রাজনীতি থকেে দূরে থাকতে সফল হলওে তার প্রতষ্ঠিতি বএিনপতিে সইে ধারাবাহকিতা রক্ষা করতে পারনেনি তার উত্তরসূররিা। জয়িা অনকেটা এড়য়িইে চলতনে আত্মীয়স্বজনক।ে জিয়া পরিবারের দ্বিতীয় পুরুষ তারেক রহমান বিএনপির জেষ্ঠ্য যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পান ২০০২ সালে। পরবর্তীতে ২০১৮সালের ৮ ফেব্রুয়ারি নিযুক্ত হন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন। বিএনপিতে জিয়ার নিজ পরিবারের তেমন কেউ রাজনীতিতে নেই। কিন্তু খালেদা জিয়ার পরিবারের অনেকেই ফুলটাইম রাজনীতি করছেন বিএনপিতে। কিন্তু নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ থেকে তিনি বিচ্যুত হয়েছেন এমন অভিযোগ উঠেনি কখনো। খালেদা জিয়ার বিরল দেশপ্রেম ও নেতৃত্ব রাষ্ট্র হিসেবে বাাংলাদেশকে মর্যাদাশীল করেছে বিশ্ব দরবারে।
অন্তিম সময়ে তার প্রতি দেশবাসীর ভালোবাসা আরো গভীরতর হয়েছে। খালেদা জিয়া স্বার্থপরতা পরিহার করে নিজেকে নিবেদিত করেন সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে। দেশ ও জাতির অনাগত ভবিষ্যত সম্পর্কে তার চিন্তা-চেতনা পাথেয় হয়ে থাকবে রাষ্ট্র বিনির্মাণে। জীবনের খানিকটা আকাশ শূণ্যতার পরিবৃত্তে সীমিত থাকে প্রত্যেকেরই। হয়তো বা খালেদা জিয়ারও রয়েছে। এই শূণ্যতা তখনই পূর্ণতা পাবে যদি তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সার্থকতা দেখে যেতে পারেন। মহান আল্লাহ তা’য়ালা তাকে সুস্থ করে তুলবেন এটাই আমাদের কাম্য।
লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, নিউইয়র্ক।
Posted ১:০৬ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh