| বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২১
ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে উদ্ভট চরিত্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সংবিধান ও বিচার ব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন। গোটা জাতিকে করেছেন দ্বিধা বিভক্ত। উসকে দিয়েছেন বর্ণবৈষম্য। অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়ে নিজ স্বার্থে করেছেন সবকিছু। বৈশ্বিক মহামারি নিয়ে করেছেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। সর্বশেষ নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দিতে বেছে নিয়েছেন আত্মঘাতি সন্ত্রাসের পথ। ক্যাপিটল হিলে নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছেন গত ৬ জানুয়ারি । নির্বাচনে পরাজিত ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উসকানিতে তার সমর্থকরা এই ন্যক্কারজনক ঘটনার অবতারণা করে। তারা কংগ্রেস ভবন দখল করে নেয়। সেখানে চালায় ভাঙচুর ও লুটপাট । নৈরাজ্য সৃষ্টি করে তার সশস্ত্র সমর্থকরা ।
এই ঘটনায় পুলিশের একজন সদস্যসহ ৬ জন নিহত হয়। দেশটির সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন ঘটনার নজির নেই। হামলার পরও বিজয়ী জো বাইডেনের প্রত্যয়ন ঠেকে থাকেনি। বরং তীব্র উল্টো প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। হামলার সব দায় এককভাবে ট্রাম্পের ওপরই বর্তাচ্ছে। আবারো অভিশংসনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার মন্ত্রিসভা এবং হোয়াইট হাউজের বেশ ক’জন স্টাফ সদস্য পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। ট্রাম্প যাতে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিতে না পারেন সে জন্য সেনাপ্রধানের সাথে কথা বলেছেন কংগ্রেসের স্পিকার। এর চেয়ে অসম্মানজনক আর কী ঘটতে পারে একজন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের জন্য? অবস্থা বেগতিক দেখে ট্রাম্প পরাজয় মেনে নিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলছেন। ক্যাপিটল হিলে হামলার পর অনেকেই এটিকে আমেরিকার গণতন্ত্রের পতনের আলামত হিসেবে দেখছেন। কেউ বা বলছেন, আমেরিকার কাছ থেকে শিক্ষা নেয়ার আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সন্দেহ নেই, আমেরিকার মতো গণতান্ত্রিক দেশে এমন একটি উগ্রবাদী সহিংসতার ঘটনা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
এবারের নির্বাচনে ট্রাম্পকে ঠেকানোর জন্য গণতান্ত্রিক শক্তি যখন মরিয়া হয়ে বাইডেনকে ভোট দিয়েছে তখন অগণতান্ত্রিক শক্তিও পিছিয়ে থাকেনি। দেখা গেছে, বাইডেন যা ভোট পেয়েছেন তার চেয়ে ট্রাম্পের পাওয়া ভোট খুব কম নয়। অর্থাৎ গণতন্ত্রের ভেতরে থেকেই অগণতান্ত্রিক শক্তি প্রায় সমানে সমানে এগিয়ে গেছে। ট্রাম্পের চার বছরে বর্ণবাদী হয়ে উঠেছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। যারা আগে বর্ণবিদ্বেষ লুকিয়ে রাখত। এখন তারা সেটি প্রকাশ্যে বলার এবং কাজেকর্মে করে দেখানোর মতো অনুকূল পরিবেশ পাচ্ছে। মাফিয়া ধরনের শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী সংগঠনগুলো রীতিমতো সোচ্চার ও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
এমনই এক পরিস্থিতিতে আমেরিকায় গণতন্ত্রবিরোধী ও বর্ণবাদী সহিংস মন-মানসিকতার বিস্তার সহসাই থমকে যাবে এমনটা আশা করার কোনো কারণ নেই। ট্রাম্প যে রিপাবলিকান দলের নেতা, সে দলটি আগাগোড়াই ট্রাম্পের সব অপকর্মে সমর্থন দিয়ে এসেছে।তার পরও দেশটির গণতন্ত্র নিয়ে এখনই হতাশ হওয়ার খুব কারণ নেই । যে ধস নেমেছে সেটা যদি অব্যাহতও থাকে তবু দেশটির পক্ষে তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের মতো একনায়কতন্ত্রী বা স্বৈরতন্ত্রী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা যথেষ্ট ক্ষীণ। ট্রাম্প যেভাবে নির্বাচনী ফল পাল্টে ফেলার প্রয়াস পেয়েছেন। যেভাবে একাধিক রাজ্যের নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত শীর্ষ কর্মকর্তাকে নিজে ফোন করে তাকে বিজয়ী ঘোষণার নির্দেশ দিয়েছেন সেটি কিন্তু সফল হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সেটি ব্যর্থ করে দিয়েছেন। একজন প্রেসিডেন্টের নির্দেশ নাকচ করে দেয়ার এই শক্তি তাদের কে জুগিয়েছে? সেটি গণতন্ত্র। তারা জানতেন, দেশে আইন-আদালত আছে এবং বিচারব্যবস্থা নিজরূপে। সুতরাং প্রেসিডেন্টের অন্যায় আদেশ মানতে তারা বাধ্য নন। সুপ্রিম কোর্টসহ সব রাজ্যের আদালতও ট্রাম্প ও তার দলের সব মামলা অগ্রাহ্য করেছেন। বলেছেন, নির্বাচনে কারচুপির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া এসব অভিযোগ আমলে নেয়ার প্রশ্নই আসে না।
একই সাথে গণমাধ্যমের শক্তিমত্তার বিষয়টিও মনে রাখুন। খোদ দেশের প্রেসিডেন্ট দিনে কয়টি মিথ্যা কথা বলছেন সেই হিসাব তারা নিয়মিত প্রকাশ করছেন। প্রেসিডেন্টের নানা অপকর্মের বিস্তারিত ফিরিস্তি তুলে ধরছেন একেকটি রিপোর্টে। নির্বাচনের ফল পাল্টে দেয়ার জন্য টেলিফোনে নির্দেশ দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট। সেই টেলিফোন সংলাপের ভিডিও প্রকাশ করে দিচ্ছে সংবাদপত্র। সম্প্রতি ট্রাম্পের এ ধরনের তিনটি ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে। এসব সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে কিছু মামলা-মোকদ্দমা অথবা হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে কোনো কোনো সংবাদপত্র বা ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে। মারাত্মক হুমকিও এসেছে নানা সময়ে। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানও সরকার বন্ধ করে দিতে পারেনি আমেরিকায় নির্বাচনী কর্মকর্তাদের কিনতে পারেননি ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনে যতদিন নীতিবোধসম্পন্ন মানুষ থাকবে, যতদিন আইনের শাসন থাকবে, যতদিন স্বাধীন গণমাধ্যম টিকে থাকবে, ততদিন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও চলমান থাকবে। গণতন্ত্রের এই অবনতি একটি চলমান প্রক্রিয়া। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বকে নতুন কোনো বিশ্বব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ট্রাম্পের উন্মাদনা ও হঠকারিতা যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আরও সুদৃঢ় করবে। চূড়ান্ত বিচারে জয় হয়েছে গণতন্ত্রের। ব্যর্থ হয়েছে ট্রাম্পের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা।
Posted ৮:৩৫ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh