বাংলা প্রেস, নিউ ইয়র্ক : | বৃহস্পতিবার, ২০ জুলাই ২০২৩
যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেফতার ও সাজা হবার পরও স্বপদে বহাল রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামীলীগের তিন নেতা। বহিস্কার তো দুরের কথা তাদের বিরুদ্ধে ‘টু শব্দও’ করতে পারছেন না দলের দায়িত্বশীল নেতারা। মোটা অঙ্কের ডলারের বিনিময়ে এসব পদ কিনেছিল গ্রেফতার ও সাজাপ্রাপ্ত নেতারা। ফলে তাদেরকে দল থেকে কোনভাবেই বহিস্কার করতে পারছেন না যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামীলীগ। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিউদ্দিন দেওয়ানকে গত ১২ জুলাই বুধবার বিকেলে নিউ ইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ১১০ কুইন্স প্রিসিনক্টে আটক করা হয়। ওইদিন বিকেলে তিনি নিউ ইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কুইন্স প্রিসিনক্টে বাংলাদেশ সোসাইটির কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় তার সাথে সংঠনের কোষাধ্যক্ষ নওশেদ হোসেনের মধ্যে বাক-বিতন্ডা ও হাতাহাতির ঘটনার জবানবন্দি দিতে গিয়েছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছাড়াও বাংলাদেশ সোসাইটির কার্যনির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতি।
গত রোববার ২ জুলাই বাংলাদেশ সোসাইটির কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় মহিউদ্দিন দেওয়ানের সাথে সংঠনের কোষাধ্যক্ষ নওশেদ হোসেনের মধ্যে বাক-বিতন্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে উভয়ের মধ্যে ঘুষাঘুষিসহ চেয়ার ও পানির বোতল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ সময় সংঠনের সভাপতি আব্দুর রব মিয়া ও সাধারন সম্পাদক রুহুল আমিন সিদ্দিকী অনেক চেষ্টা করেও তাদেরকে থামাতে পারেননি। এ ঘটনায় আহত হন নওশেদ হোসেন। তার সর্মথকরা চড়াও হয়ে ওঠেন মহিউদ্দিনের ওপর। দু’দিন কারাবাসের পর নিউইয়র্কের আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন মারামারির ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আটক আওয়ামীলীগ নেতা মহিউদ্দিন দেওয়ান। শুক্রবার (২৪ জুলাই) নিউ ইয়র্কের কুইন্সের আদালত থেকে বিকেলে জামিন পেয়ে ঘরে ফিরে যান। দলের বাইরে অন্য ঘটনায় গ্রেফতার হলেও যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামীলীগ তার বিরুদ্ধে দলীয় কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি আবুল কাশেম ওরফে একাশি কাশেম গত ২১ জুন মধ্যরাতে যুক্তরাষ্ট্রে আসার উদ্দেশ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালে ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। গত এক মাসেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ। উল্লেখ্য, নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনের বাসিন্দা নির্মাণ ব্যবসায়ী আবুল কাশেম ওরফে একাশি কাশেম ২০০৮ সালে জাসদ থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতাদের ম্যানেজ করে মোটা অঙ্কের ডলারের বিনিময়ে তিনি দলের ১০ নম্বর সহ-সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন। যুক্তরাষ্ট্রে তার রয়েছে নির্মাণব্যবসা। পিপলস ব্যাংক গঠনের জন্য আবুল কাশেম যেসব সম্পদের হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছিলেন তার একটিরও সত্যতাও খুঁজে পায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ সরকারের একজন সাবেক উচ্চ পদস্থ ব্যক্তির কাছে ‘ পিপলস ব্যাংক’ নামে নতুন একটি ব্যাংকের মালিক হওয়ার আশ্বাস পেয়ে ২০১৭ সালে দেশে ফিরে যান আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র শাখার সহ-সভাপতি আবুল কাশেম। অনুমোদন পাওয়ার আগেই রাজধানীর বনানী ডিওএইচএসে ‘প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংক লিমিটেড’ নামে সাইনবোর্ড ব্যবহার করে কার্যালয়ও খোলেন তিনি। এরপর ব্যাংকের পরিচালক বানানোর আশ্বাস দিয়ে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মূলধন ও বাড়তি খরচ সংগ্রহ শুরু করেন। এভাবে কাটে প্রায় দুই বছর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পিপলস ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ও সিটিজেন ব্যাংকের নীতিগত অনুমোদন দেয়। নীতিগত অনুমোদন পাওয়া পিপলস ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন আবুল কাশেম। ওই অনুমোদনের পর বেঙ্গল কমার্শিয়াল ও সিটিজেন ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করলেও পিপলস ব্যাংক আর আলোর মুখ দেখেনি।
শর্ত পালন করতে না পারায় ব্যাংকটির প্রাথমিক অনুমোদনও বাতিল করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু অনুমোদনের আগে ব্যাংকের নামে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ আর ফেরত দেননি আবুল কাশেম। ব্যাংকের পরিচালক বানানোর কথা বলে এসব অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিল। সেই টাকায় আবুল কাশেম নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে বেশ কয়েকটি বাড়ি, গুলশানে ফ্ল্যাট এবং দামি গাড়ি কিনে সদর্পে ঘুরে বেরিয়েছেন ঢাকা শহর আর নিউ ইয়র্কে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকটি দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। ব্যাংকটিকে লেটার অব ইনটেন্ট বা আগ্রহপত্রও দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। তবে তিন বছরে কয়েক দফায় সময় নিয়েও সেই আগ্রহপত্রের শর্ত পূরণ করতে পারেনি ব্যাংকটি।
এদিকে ব্যাংক গঠনের জন্য আবুল কাশেম যে অর্থ সংগ্রহ করেন, তার সব টাকা তিনি ব্যাংক হিসাবে জমা করেননি। আবার যেসব অর্থ জমা করেন, তা ব্যাংকের নামে না করে নিজ হিসাবে জমা করেন। আবার যাঁদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়, তাঁদের সবাইকে পরিচালক বা উদ্যোক্তা পদও দেওয়া হয়নি।
শুরুতে যাঁদের পরিচালক করা হয়েছিল, পরে তাঁদের কয়েকজনকে বাদ দিয়ে ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান, তার মা শিরিন আক্তারসহ নতুন কয়েকজনকে পরিচালক হিসেবে যুক্ত করার উদ্যোগ নেয় ব্যাংকটি। পাশাপাশি শর্ত পরিপালনের জন্য আরও সময় চায়। সাকিব আল হাসান ও আবুল কাশেম ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবীরের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি জানান। তবে ২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি নতুন করে সময় বাড়ানোর আবেদন নাকচ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকটিকে দেওয়া আগ্রহপত্রও বাতিল করা হয়। ফলে ভেস্তে যায় ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, সাকিব আল হাসান ৪০ কোটি টাকা দিয়ে ব্যাংকটির দুটি পরিচালক পদ নিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল শনিবার রাতে গণমাধ্যমকে বলেছেন, পিপলস ব্যাংক বলতে দেশে কিছু নেই। অনেক আগেই এর উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। যাঁরা পরিচালক হওয়ার জন্য টাকা জমা দিয়েছেন, তাঁরা নিজ দায়িত্বে দিয়েছেন। তাঁদের টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু করার নেই। পিপলস ব্যাংক গঠনের উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যবসায়ী ও ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা জানান, ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার আশায় কাশেমের সঙ্গে যুক্ত হন অনেকে। এখন ব্যাংকও হয়নি, টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না।
নব্বইয়ের দশকে তিনি নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে একটি বাড়ি কেনেন। সাম্প্রতিক সময়ে আরও দুটি বাড়ি কিনেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে সন্দ্বীপে তিনি জাসদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
২০২০ সালের ২৬ জুলাই আলেশা মার্ট যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে আলেশা মার্টের যাত্রা শুরু হয় ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি। প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংকের পরিচালক হতে এবং শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া ১০০ কোটি টাকা আবুল কাশেমকে দিয়েছিলেন আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম শিকদার। ফলে আলেশা মার্টের গ্রাহকদেরও বড় অঙ্কের টাকা আটকে গেছে আবুল কাশেমের কাছে।
এ ঘটনায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম শিকদার, তাঁর স্ত্রী সাদিয়া চৌধুরী, পিপলস ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবুল কাশেমসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেছে সিআইডি। সম্প্রতি রাজধানীর বনানী থানায় এ মামলা করেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার (এসপি) আল মামুন। এরপরই আবুল কাশেমকে আটক করা হয়।
২০১৭ সালে দেশে আসার কিছুদিন পর প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংকের পরিচালক হতে আগ্রহী এক ব্যক্তি আবুল কাশেমকে গুলশানে একটি বাসা ভাড়া করে দেন। ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ভেস্তে গেলেও তিনি গুলশান-২ এলাকার ১০৯ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়ির ওই ফ্ল্যাট কিনে নেন। আটকের পর ওই বাসার নিচে পড়ে থাকতে দেখা যায় তার ঢাকা মেট্রো-গ-৪৫-৭৮২১ নম্বরের গাড়িটি।এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক উত্তম কুমার মণ্ডল অর্থ পাচার প্রতিরোধে নিয়োজিত
সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে ১ জুন একটি চিঠি দেন।
সেখানে বলা হয়, আবুল কাশেমের হাতে ব্যাংক চেয়ারম্যান হওয়ার মতো সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে বসে আমেরিকায় ৪০ কোটি টাকার সম্পদ দেখান। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টের মালিক মঞ্জুর আলম শিকদার যুক্তরাষ্ট্রে আবুল কাশেমের কাছে ১৫০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী জানান, মানুষ এখন বৈধ-অবৈধ বিভিন্ন উপায়ে টাকা উপার্জন করছেন। ব্যাংকের মালিক হওয়া প্রতিপত্তির বিষয়, এ জন্য অনেকেই তাকে টাকা দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাথমিক অনুমোদন দিয়ে তাকে স্বীকৃতিও দিয়েছে। আসলেই দেশে ব্যাংকের প্রয়োজন আছে কি না, তা বিবেচনা করা হয়নি। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এই ব্যাংকের প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এ জন্য ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার জন্য একটা ভালো মানদণ্ড ঠিক করা উচিত। শুধু আর্থিক নয়, সামাজিক মর্যাদাও বিবেচনা করা উচিত। তাহলে প্রতারণার কারণে জেলে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রটি আরও জানায়, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর ব্যবসা সীমিত করে ফেলেন আবুল কাশেম। ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলে তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন তিনি। তখন ওই ব্যক্তি আবুল কাশেমকে ব্যাংকের সনদ দেওয়ার আশ্বাস দেন।
এরপরই তিনি দেশে এসে পিপলস ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ নেন। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংক গঠনে ৫০০ কোটি টাকা মূলধন লাগে। বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়া ব্যাংকটির আবেদনপত্রে পরিচালক হিসেবে ছিলেন দিশারি ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক ফারজানা হোসাইন, তমা কনস্ট্রাকশনের পরিচালক মুকিতুর রহমান, গাড়ি বিক্রয়কেন্দ্র কার সিলেকশনের মালিক আসলাম সেরনিয়াবাত, সুমি অ্যাপারেলসের প্রতিনিধি রেজাউল হোসেন, মদিনা ফার্মাসিউটিক্যালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহা. জাকির হোসেন পাটওয়ারী, খান ব্রাদার্স গ্রুপের এমডি তোফায়েল কবির খান, গুলশানের খন্দকার টাওয়ারের মালিক খন্দকার বদরুল আহসান, দিগন্ত সোয়েটারের প্রতিনিধি তানজিমা শাহতাজ, শোয়ান ইন্টারন্যাশনালের এমডি আমজাদ খান ও সাইনেস্ট অ্যাপারেলের প্রতিনিধি সামিহা আজিম। এ ছাড়া মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আলিম খানও ছিলেন তার সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পরিচালক হতে আগাম টাকা দিয়েছিলেন। তাঁদের অনেকে এখন সেই টাকা ফেরত পাচ্ছেন না।
জানা গেছে, পিপলস ব্যাংকের পরিচালক বানানো ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের কথা বলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্ট থেকেও ১০০ কোটি টাকা নিয়েছিলেন আবুল কাশেম। এ ঘটনায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। পাশাপাশি তার বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গত বুধবার মধ্যরাতে রাজধানীর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে আবুল কাশেম কারাগারে রয়েছেন।
আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান জানান, বৃহস্পতিবার সকালে সিআইডির কাছে আবুল কাশেমকে বুঝিয়ে দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। এরপর রিমান্ড চেয়ে তাকে আদালতে পাঠানো হলে শুনানির জন্য ২৫ জুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়। সেই সঙ্গে আবুল কাশেমকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।
ব্রুকলিনের সন্দ্বীপ প্রবাসী বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে স্পারো কন্ট্রাকটিংয়ে মালিক আবুল কাশেম ওরফে একাশি কাশেম। ১৯৮৭ সালে গড়ে তোলেন কাশেম কন্ট্রাকটিং। প্রায় ২০ বছর আগে ব্রুকলিন ভিত্তিক সন্দ্বীপ অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে সভাপতি হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ৮১টি ভোট পেয়েছিলেন। সেই থেকে অত্র একালায় তার নাম হয়েছে একাশি কাশেম। এ নামেই তিনি নিউ ইয়র্কে পরিচিত।
আবুল কাশেমের জন্ম ১৯৫২ সালে। তার বাবা চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের রহমতপুরের আবু বকর সিদ্দিক। সন্দ্বীপের এবি হাইস্কুল থেকে ১৯৭৩ সালে মাধ্যমিক, ওমর গনি কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক ও চট্টগ্রামের নাজিরহাট ডিগ্রি কলেজ থেকে ১৯৭৮ সালে তিনি বিএ সম্পন্ন করছেন বলে ব্যাংকে জমাকৃত নথিতে উল্লেখ করেন আবুল কাশেম। আশির দশকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর থেকে ব্রুকলিনে বসবাস শুরু করেন।
আবুল কাশেমের ন্যায় যুক্তরাষ্ট্রের আওয়ামী লীগ অর্ধশত নেতাকর্মী দেশে বিভিন্নভাবে নানা ব্যবসা বানিজ্যের সাথে জড়িত রয়েছেন। তারা সকলেই দেশ-বিদেশে অবাধে করছেন অর্থ লেনদেন। আবুল কাশেমের গ্রেফতারের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আতঙ্কিত হয়েছে পড়েছেন। ফলে এখন আর কেউই দেশে ফিরছেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবুল কাশেম গ্রেফতারের এক মাস পার হলেও এখনও তিনি স্বপদে বহাল রয়েছেন। গত এক মাসেও দলের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
অপরদিকে, গত বছর ২০২২ সালের ১৪ অক্টোবর মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ভিত্তিক নিউ ইংল্যান্ড আওয়ামীলীগ নেতাকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠায় ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের সালেম সিটি’র সুপিরিয়র কোর্টের বিচারক টমাস ড্রেচসলার। তার বিরুদ্ধে ধর্ষণসহ গুরুতর অভিযোগের পাশাপাশি শ্বাসরোধের অভিযোগের জামিন প্রত্যাহার করে মুলতুবি দণ্ডাদেশে আসিফ আহমেদ চৌধুরী ওরফে আসিফ বাবু (৬২) কে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠানো হয়।
আসিফ বাবু বোস্টনে দু’গ্রুপে বিভিক্ত নিউ ইংল্যান্ড (বোস্টন) আওয়ামী লীগ (ইউসুফ-ইকবাল)গ্রুপের সহ-সভাপতি এবং বোস্টন ভিত্তিক বাংলাদেশ অ্যাসোশিয়েশন অব নিউ ইংল্যান্ড (বেইন) এর সাবেক সভাপতি। বোস্টন সংলগ্ন মেডফোর্ডের বাসিন্দা তিনি। সপ্তাহব্যাপী সকল বিচারিক কার্য্য শেষে তাকে কারা হেফাজতে রাখার আদেশ দেন। গত বছর ৮ নভেম্বর আসিফ বাবুকে দোষী সাব্যস্ত করে চূড়ান্ত দণ্ডাদেশে প্রদান করা হয়। আসিফ বাবুর দেশের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার পাহাড়তলীর থানার কাটতলী গ্রামে।
জানা যায়, আসিফ বাবুকে সালেম সিটি’র একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীর উপর অশ্লীল আক্রমণ এবং ব্যাটারির জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তিনি দুই বছর আগে ভাড়ার জন্য একটি রুম সম্পর্কে তার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। সালেম সুপিরিয়র কোর্টের জুরি দ্বারা আসিফ আহমেদ চৌধুরী ওরফে আসিফ বাবু ধর্ষণসহ আরও গুরুতর অভিযোগের পাশাপাশি শ্বাসরোধের অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছিলেন। এক সপ্তাহব্যাপী বিচারের পর গত ১৪ অক্টোবর বিচারক টমাস ড্রেচসলার চৌধুরীর জামিন প্রত্যাহার করে এবং মুলতুবি দণ্ডাদেশে তাকে হেফাজতে রাখার আদেশ দেন। গত ৮ নভেম্বর আসিফ বাবুকে অশ্লীল হামলা হামলা ও ব্যাটারি দোষী সাব্যস্ত করা হয়। কৃষ্ণাঙ্গ ঐ নারী সালেমের ফেডারেল স্ট্রিটে জরুরী আশ্রয়কেন্দ্রে বাস করছিলেন। তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন মহামারীর কারণে চাকরি হারানোর পরে ভাড়া দিতে অক্ষম হয়েছিলেন। তার তৎকালীন ৯ বছর বয়সী মেয়ের সাথে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকাকালীন সময় তিনি মেডফোর্ডে থাকার জন্য একটি বাসার অনুসন্ধান করেছিলেন যাতে তার মেয়ে উচ্ছেদের আগে যে স্কুলে পড়াশোনা করেছিল সেখানে ফিরে যেতে পারেন। প্রসিকিউটর কেট ম্যাকডুগালের জিজ্ঞাসাবাদে এ সাক্ষ্য দিয়েছেন ঐ নারী।তিনি বিচারকদের বলেন, একটি একক রুমে থাকার জন্য তার সামর্থ্য ছিল। তিনি আসিফ বাবুর ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে বাসা ভাড়ার একটি বিজ্ঞাপনে দেখে সাড়া দেন এবং রুমটি নেওয়ার পরিকল্পনা করেন।
কিছু দিন পরে ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ সালে আসিফ বাবু সালেমের ওই মহিলার সাথে দেখা করার পরিকল্পনা করেছিলেন যাতে তিনি একটি ভাড়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে পারেন। ওই বৈঠকের সময় উক্ত নারীর উপর অশ্লীল আক্রমণ ও হামলার ঘটনাটি ঘটে বলে সাক্ষ্য দেন তিনি।
মহিলার ৯ বছর বয়সী মেয়ে বিচারকদের বলেন যে তিনি ‘অনেক বিশৃঙ্খলার’ শব্দে জেগে উঠেন এবং শোবার ঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখেন আসিফ বাবু তার মায়ের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি কিছুতেই উঠতে পারেননি। মেয়েটি বিচারকদের বলেন সে বেডরুমে ফিরে এসে পুলিশের জরুরি নম্বর ৯১১ ফোন করেন।
উক্ত ঘটনায় আসিফ বাবু দুই বছরের সাজা হলে দল থেকে বহিস্কারের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি নিউ ইংল্যান্ড (বোস্টন) আওয়ামীলীগ (ইউসুফ-ইকবাল) গ্রুপ। উল্টো ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ অভিযুক্ত কারাভোগী আসিফ বাবুকে ছাড়ানোর জন্য একটি আবেদন পত্রে স্বাক্ষর প্রদান করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামীলীগ নেতারা জানার পরও কোন ব্যবস্থা নেননি।
গ্রেপ্তার ও সাজা হওয়া এসব নেতাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আওয়ামীলীগ কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে? তারা কি এখনো যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের কমিটিতে রয়েছেন, নাকি তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে? এসব প্রশ্নের জবাবে কোন উত্তর দেননি যুক্তরাষ্ট্রের আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান ও ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক আব্দুস সামাদ আজাদ।
আবুল কাশেম গ্রেফতারের পর ড. সিদ্দিকুর রহমান তার ফেসবুক পেজে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেন, প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংকের চেয়ারম্যান যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবুল কাশেম অর্থ পাচারের অভিযোগে ঢাকার পুলিশ গ্রেফতার করেছেন বলে দেশে প্রবাসে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হয়েছে যা যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তির অবনতি ঘটিয়েছে। কেন্দ্রের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সংগঠনের নিয়ম অনুযায়ী যথাযথ গুরুত্ব সহকারে যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, কিন্তু এক মাসেও কোন ব্যবস্থা নেননি তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, যেহেতু কাশেম দন্ডিত হয়নি, তাই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি দল। তবে বোস্টনের সাজাপ্রাপ্ত নেতা আসিফ বাবু এখনো স্বপদে বহাল রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে দল কোন সিদ্ধান্তই নেননি।
Posted ১২:৪৭ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২০ জুলাই ২০২৩
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh