ডাঃ ওয়াজেদ খান : | সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বন্ধের দাবি দীর্ঘদিনের। ছাত্র-জনতার আগস্ট অভ্যুত্থানের অন্যতম এই দাবি ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্খার ন্যায্যতা মেনে নিয়ে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মচারীদের প্রচলিত দলীয় রাজনীতির পথ রুদ্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে শিক্ষার্থী ও জনগণ। দাবি উঠেছে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সরকারকে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইনের মাধ্যমে কার্যকর করতে হবে এই সিদ্ধান্ত ।
গত সপ্তাহে জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’টি নির্মম হত্যাকাণ্ড এই দাবির ন্যায্যতা আরো জোরদার করেছে । শিক্ষাঙ্গনে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বন্ধের বিষয়টি নিয়েও একটি মহল সৃষ্টি করছে বিতর্ক।
ছাত্র রাজনীতি ও দলীয় লেজুড়বৃত্তির বিষয়টি গুলিয়ে ফেলছেন তারা। ছাত্র রাজনীতি অবশ্যই থাকবে এবং তাতে দোষের কিছু নেই। তবে সে রাজনীতি হবে শিক্ষাঙ্গণভিত্তিক ছাত্র সংসদ নির্ভর। যেখানে প্রাধান্য পাবে শিক্ষার উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণ। শিক্ষা সম্পৃক্ত বিষয় ছাড়াও রাষ্ট্রীয় এবং জনস্বার্থে শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দেবে, সোচ্চার হবে, নামবে রাজপথে। যেমনটি করেছে তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। যে আন্দোলন-অভ্যুত্থান বাংলাদেশকে দিয়েছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শতভাগ রাজনীতি ছিলো। কিন্তু দলীয় লেজুড়বৃত্তির কোনো বাতাবরণ ছিলো না। দলীয় লেজুড়বৃত্তি মুক্ত শিক্ষার্থীরা দেশ ও জাতির প্রয়োজনে ভবিষ্যতে এধরনের ভূমিকা পালন করবে। এজন্য প্রয়োজন হবে না কোনো দল, পরিবার বা ব্যক্তির আনুকূল্য। এ বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
গণঅভ্যুত্থানের মূল আকাঙ্খা ফ্যাসিবাদমুক্ত একটি বৈষম্যহীন, মানবিক, কল্যাণকর, আইনের শাসনের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। এই চেতনার আলোকে অন্তর্বতীকালীন সরকার শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মচারীদের সরাসরি দলীয় রাজনীতির পথ রুদ্ধ করতে যাচ্ছে। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড এবং শিক্ষার্থীরা হচ্ছে তার ভবিষ্যত। তাই স্বভাবতই শিক্ষাঙ্গনে প্রয়োজন শিক্ষার সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিবেশ। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনে বরাবর বিরাজ করছে চরম নৈরাজ্য ও অস্থিরতা। অপ্রতিরোধ্য সন্ত্রাস ক্রমাগত গ্রাস করেছে শিক্ষাঙ্গনগুলোকে। ছাত্র রাজনীতির নামে সর্বত্র চলছে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি। শিক্ষার্থীরা পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর লাঠিয়াল বাহিনীতে। রাজনৈতিক আদর্শের চেয়ে ব্যক্তি ও দলীয় ক্যাডার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে তারা। কথায় কথায় সংঘাত-সংঘর্ষে রক্তাক্ত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর, পড়ছে লাশ। বিগত ৫০ বছরে শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ে ৮৩টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কারণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল মধ্যরাতে মহসিন হলে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে একসঙ্গে প্রাণ হারায় ৭ জন শিক্ষার্থী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০টি বড় ধরনের সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে ১৭ জন শিক্ষার্থী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রায়শই ঘটছে সহিংস ঘটনা। দলীয় ক্যাডারদের আত্নঘাতী সংঘাত ও খুনোখুনিই শুধু নয়, ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ললাটে লেপন করেছে ভয়ংকর কলঙ্ক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের এক নেতা শতবার ছাত্রী ধর্ষণ করে ভূষিত হয়েছে “সেঞ্চুরিয়ান ধর্ষক” খেতাবে। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির একটি গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। আজকের মতো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি নয় বরং ছাত্র সংগঠনগুলোই তখন নিয়ন্ত্রণ করেছে রাজনৈতিক দলগুলোকে। স্বাধীনতার পরপরই ছাত্র রাজনীতিতে দেখা দেয় মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়। একানব্বই থেকে দেশে ছাত্র রাজনীতিতে বিস্তার ঘটেছে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির। ছাত্র নেতৃত্বের মাঝে প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে রাতারাতি অর্থ বিত্তের মালিক হওয়ার। ফলে সকল ধরনের অপকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়ছে তারা।
ছাত্ররা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেবে। দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে ক্যাম্পাসের বাইরে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ছাত্রদের ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততাতেও দোষের কিছু নেই। ছাত্ররা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যা, নিজেদের কল্যাণ এবং উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ছাত্র সংসদের মাধ্যমে কাজ করবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররা এভাবেই নেতৃত্ব দেয়। জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের নিকট পেশ করে দাবি-দাওয়া । প্রয়োজনে আন্দোলনে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে ছাত্র সংসদে প্রতিনিধিত্ব না করে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কল্যাণের দিক না দেখে, দুর্বৃত্তায়িত দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করছে ছাত্র সমাজের বড় একটি অংশ। রাজনীতির কারণে পিছিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত ও নির্ধারিত পরীক্ষা। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দরিদ্র অভিভাবক। সিংহভাগ শিক্ষার্থী চায় শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। রাজনীতির সাথেও নেই তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা। তারপরও মুষ্টিমেয় দলবাজ শিক্ষার্থীর হাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জিম্মি। অছাত্র এবং সন্তানের জনক-জননী এমন অনেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছে দলীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর। ক্যাম্পাসে এবং বাইরে টেন্ডারবাজি, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণসহ নানাবিধ অপকর্ম করে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তারা করছে কলঙ্কিত। ছাত্র রাজনীতির নামে অস্ত্রধারী দলীয় ক্যাডাররা হলে বিনা পয়সায় থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। হলে তারা গণরুমের নামে চালু করেছে নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা। অনেক ছাত্র নেতার রয়েছে গাড়ি-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ্রেণির শিক্ষক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন দলবাজ শিক্ষার্থীদের। আলোর পথ থেকে সরিয়ে ছাত্রদের যারা অন্ধকার গলিতে ঠেলে দিচ্ছেন তাদের সন্তানরা কিন্তু ঠিকই পড়াশোনা করছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেজড়বৃত্তির রাজনীতি চর্চা বন্ধ করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। যাতে প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃত শিক্ষার্থীরা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন অভিভাবকরা। জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণকারী দলগুলো শিক্ষাঙ্গণে যাতে কোনো ছাত্র অঙ্গ-সংগঠন না রাখতে পারে সেজন্য শর্ত আরোপ করতে হবে নির্বাচন কমিশনে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৮ সালের আগস্টে সহিংস ঘটনার পর গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন জোড়ালো সুপারিশ করে শিক্ষাঙ্গনে সরাসরি ছাত্র-শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি বন্ধের। ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ শিক্ষকদের এবং ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলের বিধি ছাত্রদের দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে যে সুযোগ সৃষ্টি করে তা বিলোপের পরামর্শও দেয়া হয় ১৮৩ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ্রেণির শিক্ষকও দলবাজি করে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশকে বিষিয়ে তুলেছেন।
লাল, নীল ও গোলাপী বিভিন্ন রঙয়ের সংগঠন করে দলীয় লেজুড়বৃত্তি করছেন তারা। শিক্ষাদানের চেয়ে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার এবং আন্দোলনের মন্ত্রণা দিয়ে ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি অস্থির করে তুলছেন। দলীয় লেজুড়বৃত্তিকারীদের শিক্ষাঙ্গনে প্রভাব, প্রতিপত্তি ও বিলাসবহুল জীবন যাপন করতে দেখে হতাশাগ্রস্ত অনেক সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী ঝুঁকে পড়ছে রাজনীতির দিকে। দলীয় সরকারের আনুকূল্যে চাকরি লাভের সুযোগ পাওয়ায় বিত হয়েছে মেধাবীরা। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র,শিক্ষক ও কর্মচারীদের দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে মুক্ত করতে ’৭৬ এর রাজনৈতিক দলের বিধান এবং ‘৭৩ এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশটি বাতিল করে বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকারের উচিত হবে অধ্যাদেশ জারি করা। ডাকসুসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও হল সংসদ সমূহে নিয়মিত দলনিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে মেধাবী, সৎ ও যোগ্য ছাত্র প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা করা। গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্খার বাংলাদেশের জন্য এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও টেকসই গণতন্ত্র। শিক্ষার্থীরা যদি দেশের ভবিষ্যত এবং শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদণ্ড, তাহলে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যতের জন্য জাতিকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড় করাতে দলীয় লেজুড়বৃত্তির সহিংস ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কোনো বিকল্প নেই।
ডাঃ ওয়াজেদ খান
সম্পাদক
সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, নিউইয়র্ক।
Posted ৫:১৮ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh