কাজী জহিরুল ইসলাম | বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
একটু এগুতেই মনে হলো জলঘেঁষা হাঁটাপথটি বুঝি এখানে আটকে গেলো। কাছাকাছি হতেই বিভ্রম কাটলো। একটি রেস্টুরেন্ট পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে, ফলে পায়ে হাঁটার রাস্তাটি বেশ সরু হয়ে বাঁ দিকে সরে রেস্টুরেন্টটিকে অর্ধবেষ্টন করে আবার ওপাশে গিয়ে জলের কাছে নেমে গেছে। আমি যখন কিছুটা বিভ্রান্ত, রেস্টুরেন্টে ঢুকবো, নাকি বাঁ দিকে যাবো, এই দ্বিধায় পড়েছি তখন রেস্টুরেন্টের মালিক হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলেন। এসেই তিনি দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গনের ভঙ্গি করে আমাকে রেস্টুরেন্টে ঢোকার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। আমি বলি,
আপনি কি ইংরেজি জানেন?
অফ কোর্স, বলেই তিনি শুরু করলেন। কী খাবেন বলেন, স্টেক, ফিশ গ্রিল, সালাদ সবই আছে।
ভাঙা ভাঙা হলেও ওর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট, বাক্য গঠনে ঝামেলা আছে কিন্তু শব্দের উচ্চারণে কোনো ত্রুটি নেই।
আমি বিনয়ের সঙ্গে একটি হাসি দিয়ে বলি,
কিছুই খাবো না। বসফরাসের রূপ দেখতে এসেছি, ওপাশে যাবার রাস্তা খুঁজছি।
লোকটি ওর বাঁ হাতে আমার পিঠ ছুঁয়ে নিজে আগে আগে হেঁটে আমাকে রাস্তা দেখিয়ে দিল। এই একটি রেস্টুরেন্টেই আমি কর্মী-আধিক্য দেখলাম না। এ-ছাড়া যে হোটেলে উঠেছি সেখানেসহ, এখানকার যে কয়টা দোকান বা রেস্টুরেন্টে উঁকি দিয়েছি সর্বত্রই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি স্টাফ কাজ করছে। বেশি মানে আমেরিকা কিংবা ইউরোপের তুলনায় বেশি। হয়ত শ্রম এখানেও আমাদের দেশের মত সস্তা হবে।
ভদ্রলোক বেশ মিশুক। যেচে পড়ে কথা বলতে চাইছেন। আমিও তো ভ্রমণকালে এমন মানুষই খুঁজি। আলাপের শুরুতেই নাম জেনে নিতে হয়। নিজের নাম বলে এবার আমি করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিই। তিনি আমার হাতটা ধরেই নিজের নাম বলেন,
উফুক।
শুধু উফুক, আর কিছু নেই?
আছে, ইয়েলকেম। উফুক ইয়েলকেম।
আপনার ব্যবসা কেমন চলছে?
ভালো না। কোনো রকমে টিকে আছি। কোভিডের পর থেকে ব্যবসাটা আর আগের মত জমছে না।
হুম, পৃথিবী এখন বদলে গেছে। দোকান সব আকাশে, মাটির মানুষ এখন আকাশে ব্যবসা পেতেছে।
আমার এই মেটাফোরিক কথা তেমন বুঝলো না উফুক। ওর চোখে বিভ্রান্তি। ঠিক এই রকম সময়ে মানুষের মুখের অভিব্যক্তিতে একটা অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে, তখন তাকে একজন বোকা মানুষ মনে হয়। উফুকের মুখে এখন একটা বোকা বোকা হাসি, হাসিটা ফুটছে না আবার মিলিয়েও যাচ্ছে না। যেন এই অর্ধ-প্রস্ফুটিত হাসিটা ধরে রেখেই ও প্রতীক্ষা করছে আমি যা বলেছি তার ব্যাখ্যা শোনার জন্য।
আমি ব্যাখ্যা করে ওকে অনলাইন ব্যবসায়ের কথা বলি। কোভিডের পরে আমাদের এই অ্যাকচুয়াল পৃথিবীর প্যারালাল আরেকটা ভার্চুয়াল পৃথিবী তৈরি হয়েছে। যেহেতু সেই পৃথিবীটা নতুন, তাই সকলেই নতুনের স্বাদ গ্রহণ করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। এখান থেকে একদিন পৃথিবীর মানুষ বেরিয়ে এসে আবার অ্যাকচুয়ালের দিকেই ধাবিত হবে, তবে সেই জায়গায় পৌঁছুতে অনেক সময় লাগবে।
উফুকের ইংরেজি জ্ঞান অতোটা নেই যে এই জটিল কথা বুঝবে। তবে মনে হলো মূল বিষয়টা ধরতে পেরেছে। উবার ইটসহ বেশ কিছু ফুড ডেলিভারি অ্যাপের কথা বলে হতাশা ব্যক্ত করলো।
উফুকের সঙ্গে বেশ অনেকটা সময় কথা হলো। ও আমাকে রেস্টুরেন্টে চা-পানে আপ্যায়ন করতে চাইলো কিন্তু আমি বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করলাম। কারণ আমি চা খেয়ে এই বিকেলটা নষ্ট করতে চাই না। খোলা আকাশে মুখ রেখে বসফরাস থেকে উঠে আসা শীতল হাওয়াটাই খেতে চাই।
আমারই বয়সী এক ভদ্রলোক, ক্রিম কালারের বুরকা পরিহিতা স্ত্রীর হাত ধরে হাঁটছেন। আমার কিছুটা ঈর্ষাই হলো। মুক্তিকে খুব মিস করছি। দুজন একসঙ্গে এই অনিন্দ্য সন্ধ্যায় হাত ধরাধরি করে হাঁটতে পারলে বেশ হত।
আমি আসলেই ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে পড়ি। এগিয়ে গিয়ে ওদের জুটি ভেঙে দিই। ভদ্রলোকের দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলি,
ছবি তুলে দেবেন?
তিনি স্ত্রীর হাত ছেড়ে দিয়ে লম্বা একটা হাসি উপহার দিলেন। আসলে স্থানীয় যারা এখানে বেড়াতে আসে তারা সকলেই বেশ ট্যুরিস্ট ফ্রেন্ডলি। লোকটি আমার কিছু ছবি তুলে দিলো। ফোনটা ফেরত দিতে দিতে আমার দেশের কথা জানতে চাইলো। বাংলাদেশ শুনে খুব খুশি হলো। ওর স্ত্রী, বুরকার ওপরে দৃশ্যমান পূর্ণিমা চাঁদের মত স্নিগ্ধ এবং গোল মুখখানিতে, হাসির আভাস তুললেন। বুঝলাম মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি ওদের সকলেরই একটি ইতিবাচক মনোভাব আছে।
আমরা পরিচিত হলাম। তিনি জানালেন, তার নাম গিজাম, তিনি একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন, ইতিহাস পড়ান। জেনে আমি খুব আনন্দিত হলাম। গিজাম বেশ আগ্রহ নিয়ে বললেন, এই মুহূর্তে সম্ভবত তুরস্কের খুব ভালো বন্ধু বাংলাদেশ।
নিশ্চয়ই। শুধু ধর্মই না দুই দেশের মানুষের মধ্যে অনেক কিছুরই মিল আছে। আপনাদের মত আমরাও খুব অতিথি পরায়ন।ভারতের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক এখন বেশ খারাপ তাই না?
আসলে বাংলাদেশ চেষ্টা করছে ভারতের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে।
কিন্তু ওরা তো চায় নিয়ন্ত্রণ করতে। হ্যাঁ, সেই জায়গাটাতেই সমস্যা হচ্ছে। আগের সরকার এই স্পেসটা ওদের দিয়েছিল। বর্তমান সরকার সেখান থেকে সরে এসেছে। এনি ওয়ে প্রফেসর, এই বিষয়ে আমি আর বেশি কিছু বলতে চাইছি না।
আপনি আমার সঙ্গে নিঃসঙ্কোচে কথা বলতে পারেন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে খুবই ভালোবাসি।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি আরেকটু এগোবো।
অধ্যাপক সাহেবকে ছেড়ে আমি আরো খানিকটা সামনে এগিয়ে যাই। রাজনীতির আলোচনায় না এগিয়ে বসফরাসের অহিংস পাড় ধরে এগোনোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
তখন কাছের কোনো মসজিদ থেকে আসরের আজান ভেসে আসে। বাঁ দিকে লোকালয়টি খাড়া পাহাড়ের ওপরে উঠে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে দেখি সরু, উর্ধগামী একটি রাস্তার ডানে একটি মসজিদ। তুর্কি মিনার দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশে তো আসরের আজান হয়ে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরে নামাজ শুরু হয়, এখানকার অবস্থা কী? যাই, জামাত শুরু না হোক, নামাজটা পড়ে আসি, আর মসজিদের পরিবেশটা দেখে আসি।
খানিকটা পাহাড়ে উঠতে হলো। ডানে মৌনতার গভীরে ডুবে আছে একটি সিমেন্টের গেইট। ভেতরে শ্যাওলা পড়া সুনসান নীরবতা। গা ছমছম করে উঠলো। এটা কী পরিত্যক্ত মসজিদ? কোন জ্বিন আজাদ দিল? তোরণ এবং তোরণের ভেতরের অংশটা গোরস্তানের মত লাগছে। তখন পেছন থেকে কেউ একজন আমার পিঠে হাত রাখলো। আমি চমকে উঠি। ষাটোর্ধ এক ভদ্রলোক, ভাঙা চোয়াল, তুর্কি ভাষায় কিছু একটা বলে আমাকে হাতের ইশারায় ভেতরে ঢুকতে বলছেন। আমার দ্বিধা দেখে তিনি পারেন তো আমাকে জোর করে ভেতরে ঢুকিয়ে দেন। আমি ইশারায় তাকে আগে ঢুকতে বলছি কিন্তু কিছুতেই তিনি আমার আগে ঢুকবেন না।
ভেতরে ঢুকে দেখি অতি পরিচ্ছন্ন একটি অজুখানা। জিন্স এবং শার্ট পরা দুজন মুসুল্লি অজু করছেন। দুজনই সুদৃশ্য চামড়ার জুতো খুলে একপাশে রেখেছেন। অজুখানায় বসার আগে একটু পর্যবেক্ষণ করলাম। প্রথমজন অজু শেষ করে অজুর জায়গাটি একটি ওয়াইপার দিয়ে ভালো করে ওয়াইপ করে, সামনে ঝুলিয়ে রাখা কিচেন টাওয়েল দিয়ে মুছে একদম শুকনো করে তারপর উঠলেন। দামী জুতোজোড়া মসজিদের বাইরে রেখে মোজা পরে ভেতরে ঢুকে গেলেন। অন্যের জন্য ভেজা, নোংরা, স্যাতস্যাতে অজুখানা রেখে গেলেন না। এই দায়িত্ববোধ আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করলো। আমিও ওর শেখানো পাঠ অনুসরণ করে অজু করলাম, জায়গাটি ওয়াইপ করলাম, কিছুটা দ্বিধা নিয়ে আমার দামী এবং একমাত্র জুতোজোড়া বাইরে রেখেই ভেতরে ঢুকলাম। মসজিদ থেকে জুতো চুরি হওয়ার সংস্কৃতি ওদের নেই তো!
ভেতরে ঢুকে দেখি, আমিসহ মাত্র ৮ জন মুসুল্লি। সকলেই পঞ্চাশোর্ধ। বুঝলাম তারুণ্যের উচ্ছাসকে ওরা ধর্মের শৃঙ্খলে বন্দি করেনি বা করতে পারেনি। আমার কিছু কা’যা নামাজ ছিল, তা আদায় করলাম। তৃতীয় সারি থেকে হঠাৎ একজন কামানো মুখের মুসুল্লি আকামত দিতে শুরু করলেন। তখন ইরানীদের মত পাগড়ি পরা এক বৃদ্ধ ইমাম সাহেব শাদা একটি আলখাল্লা গায়ে চাপিয়ে মিহরাবে গিয়ে দাঁড়ালেন, যিনি আকামত দিচ্ছিলেন তিনি হাঁটতে হাঁটতেই আকামত দিতে থাকেন এবং ইমামের পেছনে, প্রথম সারিতে এসে দাঁড়ান, এখানে দাঁড়িয়ে অবশিষ্ট আকামত দেওয়া শেষ করেন।
নামাজ শেষ করে আবার ফিরে আসি বসফরাসের পাড়ে। ততক্ষণে একদল মৎস্য শিকারি টেবিল চেয়ার পেতে পিকনিকে মেতেছে। সকলের হাতে হাতে তুর্কি চায়ের কাপ, টেবিলে নানান রকম বিস্কুট ও বাকলাভা জাতীয় মিষ্টান্ন। একবার ইচ্ছে হলো ওদের সঙ্গে একটু কথা বলি। আমাদের দেশের মতো ওরাও আওয়ামী মৎস্যজীবী সমিতি, জাতীয়তাবাদী মৎস্যজীবী সমিতি এইসব করে কী-না। আমার কেন অনুমান হলো ওরা ইংরেজি জানে না? ক্লাস সমস্যা? যারা মাছ ধরেন, যাদের বয়স কিছুটা হেলে পড়েছে বার্ধ্যক্যের দিকে, তারা অনাধুনিক হবেন, ইংরেজি জানবেন না, আমার এই ধারনা যে ভুল তা বোঝার জন্য আমাকে আরো একটি দিন অপেক্ষা করতে হল। আরো একটু এগুতেও বাঁ দিকে বিশাল এক দূর্গ ভেসে উঠলো। দূর্গের চূড়োয়, পাহাড়ের ওপর পতপত করে উড়ছে বিশাল এক তুর্কি পতাকা। এই দুর্গটির নাম রুমেলি হিসারি।
Posted ২:২৯ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh