| বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারি ২০২৩
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন এক কোটিরও অধিক বাংলাদেশী শ্রমিক। দেশে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় স্বল্প বেতনভ’ক এসব শ্রমিকরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। শিকার হচ্ছেন নিপিড়ন নির্যাতনের। বিগত এক দশকে প্রায় ৩৪ হাজার প্রবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। যার অধিকাংশই অপমৃত্যু। প্রবাসে শ্রমিকদের বড় একটি অংশের মৃত্যু ঘটে স্ট্রোক, হৃদরোগ ও কিডনির সমস্যায়। এরপর রয়েছে কর্মক্ষেত্র ও সড়ক দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, আগুনে পুড়ে মৃত্যু, আত্মহত্যা বা খুন। তবে বাংলাদেশ থেকে যাচাই করা হয় না প্রবাসীদের এমন আকস্মিক মৃত্যুর কারণ । এ জন্য লাশের সঙ্গে আসা মেডিক্যাল রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হিসেবে যা উল্লেখ করা হয়, সেটাই মেনে নিতে হয়। শারীরিক কোনো জখম বা চিহ্ন দেখে মৃত্যুর কারণ নিয়ে প্রশ্ন জাগলে এ ব্যাপারে সঠিক উত্তর পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। এভাবে অনেক ক্ষেত্রে আড়ালে থেকে যাচ্ছে মৃত্যুর সঠিক কারণ। দূতাবাস থেকে প্রবাসীদের মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করে থাকেন সাধারণত সেখানকার হাসপাতালের চিকিৎসকরা। যখন কোনো দুর্ঘটনা বা নিপীড়নের কারণে প্রবাসীর মৃত্যু হয়, তখন দেখা যায় তিনি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন, তারা তাদের পক্ষে মেডিক্যাল রিপোর্ট প্রকাশের জন্য নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এমন ঘটনায় প্রবাসীর পরিবারের পক্ষ সবচেয়ে বেশি জটিলতা।
কয়েক দশকে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে, সে সঙ্গে বাড়ছে রেমিট্যান্স। অনেক বাংলাদেশি আছেন যাঁরা বিভিন্ন উপায়ে বিদেশে গেছেন এবং বৈধ-অবৈধভাবে সেখানে অবস্থান করছেন। প্রবাসী কর্মীর প্রকৃত সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। আবার অনেকে প্রবাসে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন পরিবার নিয়ে, যাঁরা নিয়মিত রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে যে কয়টি খাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ-এর মধ্যে বৈদেশিক আয়ের আসে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ থেকে। প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করছেন তাদের পরিবার-পরিজনদের করে যাচ্ছেন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স সমৃদ্ধ করছে দেশের মূল অর্থনীতিকে ।
২০২০-২১ অর্থবছরে সব মিলিয়ে প্রবাসী আয় এসেছিল প্রায় দুই হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি। বৈধভাবে পাঠানো টাকার বাইরে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে আসে হুন্ডির মাধ্যম।আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০ দেশের একটি। বছরে এখন রেমিট্যান্স আসে ১৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। কথা হচ্ছে যাঁদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনীতি ও অসংখ্য পরিবার সজীব থাকে তাঁরা প্রবাসে ও দেশে কী পান?
প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রধান দায়িত্ব শ্রম কল্যাণ উইংয়ের। বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশি কর্মীরা গেলেও তাঁদের সুরক্ষা ও অধিকার রক্ষায় ২৬টি দেশের বাংলাদেশ মিশনে শ্রম কল্যাণ উইং আছে মাত্র ২৯টি। বিদেশে থাকাকালে সংশ্নিষ্ট বাংলাদেশি দূতাবাসের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পাওয়া, দেশের বিমানবন্দরে নাজেহাল হওয়া, লাগেজ চুরি বা হয়রানি ইত্যাদি বিষয় তাঁদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে, যা অস্বীকার করার উপায় নেই। পাসপোর্ট নবায়নে মাসের পর মাস লাগে। ফলে অনেকের কর্মক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আবার বিদেশে থাকাকালে কোনো ধরনের সমস্যা হলে ওই দেশের বাংলাদেশি দূতাবাসের অবহেলা করার অভিযোগও রয়েছে।
এমনকি প্রবাসে দেশের দূতাবাসের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করতেও বিড়ম্বনা পোহাতে হয় প্রবাসী শ্রমিকদের। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে থাকা অদক্ষ বা স্বল্প শিক্ষিত শ্রমিকদের এমন অভিজ্ঞতা অনেক। দেশে ফেরা প্রবাসী কর্মীরা যাতে বিমানবন্দরে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হন, সেদিকটি নিশ্চিত করতে হবে। তাঁদের লাগেজ চুরি বা প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে সব হারানোর ঘটনা কম নয়। তাই তাঁদের জন্য সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নিতেই হবে। একই সঙ্গে রেমিট্যান্স পাঠানোর ভিত্তিতে তাঁদের বিশেষ সুযোগ বা সম্মান দেওয়ার উদ্যোগ নেয়া। দেশে এলে তাঁদের জন্য বিমানবন্দরে বিশেষ ছাড় এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সুবিধা দিলে তাঁদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, রেমিট্যান্স দিয়েই দেশের অর্থনীতি ও অসংখ্য পরিবারের জীবিকার ব্যবস্থা হয় যাঁদের হাত ধরে, তাঁদের অবহেলা করে রেমিট্যান্স প্রত্যাশা করা যায় না। নিরাপদ অভিবাসন ও কর্মস্থল সুনিশ্চিত করতে অভিবাসন সম্পর্কিত মোবাইল অ্যাপগুলোর প্রয়োগে তরুণ শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত করা, অভিবাসীদের সন্দেহজনক অস্বাভাবিক মৃত্যুর কিছু কেস পুনরায় ময়নাতদন্তের পদক্ষেপ গ্রহণ করা, অভিবাসীদের আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা এবং মানব পাচারসংক্রান্ত মামলাগুলোর প্রসিকিউশনের হার বাড়ানো জরুরী বলে আমরা মনে করি। প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিধানে বাংলাদেশ সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
Posted ৪:০১ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারি ২০২৩
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh